• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ০৮:১২ পূর্বাহ্ন

কোটি কোটি টাকা পদ ও কমিটি বাণিজ্য, অতিষ্ঠ বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আজগর আলী নস্কর বিহারী সন্তান


প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ১৬, ২০২৩, ১২:৫৬ পূর্বাহ্ন / ১০৮
কোটি কোটি টাকা পদ ও কমিটি বাণিজ্য, অতিষ্ঠ বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আজগর আলী নস্কর বিহারী সন্তান

বিশেষ প্রতিনিধি,ঢাকাঃ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনে সহযোগী সংগঠন হিসেবে মৎস্যজীবী লীগকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। স্বীকৃতির পর থেকেই একের পর এক বিতর্ক ও সমালোচনার জন্ম দিয়ে চলেছে নুতন এ সংগঠনটি।

বাংলাদেশ আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লায়ন শেখ আজগর আলী নস্কর একজন বিহারী সন্তান। ঠাঁকুরগাঁও জেলার রানী শংকৈল উপজেলার নেকমোরদ ইউনিয়নের গাজীগর বিহারী কলোনীর মৃত ইদ্রিস আলীর ছেলে আজগর আলী। নিজ জেলা ঠাঁকুরগাঁও আওয়ামী লীগের কোন নেতাকর্মী তাকে চিনেন না বলে নিশ্চিত করেছেন ওখানকার আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ।

ব্যাপক অনুসন্ধানে জানা যায়, আজর আলী নস্কর অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে ঠাঁকুরগাঁও ছাড়েন। তিনি দিনাজপুরের একটি মটর গ্যারেজের হেল্পার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে কিছু দিন তিনি ট্রাক ড্রাইভারের কাজ করেন। সে সময় জনৈক যুবলীগের এক নেতাকে হত্যা করেন আজগর নস্কর। দীর্ঘ ১১ বছর সাজাপ্রাপ্ত আসামী হয়ে দিনাজপুর জেলে জেল খাটেন। এ সময় জেলখানায় অন্য আসামীকে দেখতে আসা দর্শনার্থী দিনাজপুরের মিনা মেহের নামে অনার্সে পড়ুয়া মিনা মেহেরের সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে প্রেমের সম্পর্ক ঘটে।

মাঝে মধ্যেই মিনা মেহের তাকে জেলখানায় দেখা করতে যেতেন। দীর্ঘ ১১ বছর জেল খেটে ১৯৯২ সালে ছাড়া পান আজগর আলী। ১৯৯৬ সালে প্রেমিকা মিনাকে বিয়ে করে রাজধানী ঢাকায় চলে যান। ঢাকার খিলগাঁওয়ে একটি ছোট এক রুমের বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকেন তারা।

সে সময় রাজধানীর খিলগাঁওয়ে একটি স’মিলে সামান্য বেতনে (করাতকল) চাকুরী নেন আজগর। কোন মতে সংসার চালিয়ে জীবন পার করছিলেন। এক পর্যায়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে গাছ কিনে করাতকলে ভাঙ্গিয়ে তা খুচরা বাজারে বিক্রি করেন। সে সময় তার এক গ্রাহকের সঙ্গে সখ্যতা হয়। তিনি বিদেশে লোক পাঠান। তার সঙ্গে এক পর্যায়ে আদম আদম ব্যবসা শুরু করেন। আদম ব্যবসার অন্তারালে আজগর হুন্ডির ব্যবসা শুরু করেন। ঘুরে যায় ভাগ্যের চাকা, পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আজগর নস্করকে।

কোটি কোটি টাকা কয়েক বছরেই কামিয়ে নিয়েছেন বিদেশে নারী পাচার ও হুন্ডি ব্যবসার মাধ্যমে। বসবাস করেন বসুন্ধরার আবাসিক এলাকায়। অবৈধ অর্থ রক্ষায় সব সময় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে রাখতেন সুসম্পর্ক। দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ সব তথ্য। ইতিমধ্যে একটি নিউজ পোর্টালে তার বড় ভাই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিএনপির জিয়া পরিবারের সাথে ছিল আমাদের অত্যন্ত সুসম্পর্ক। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার শ্বশুর আমার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আজগর আমার সঙ্গে তাদের বাড়ীতে অনেকবারই গিয়েছিলো। সেই সূত্রে বড় ভাইয়ের হাত ধরেই বিএনপির বড় নেতাদের বাসায় যাতায়াত ছিল আজগর নস্করের। এদিকে, তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টসের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের মূল আসামি দেলোয়ার হোসেনকে ঢাকা মহানগর উত্তর মৎস্যজীবি লীগের সভাপতি এবং সাবেক বিএনপি নেতা আব্দুল জলিলকে সাধারণ সম্পাদক করার পরেই বিতর্ক সামনে আসে।

সম্প্রতি সাধারণ সম্পাদক আজগর নস্কর গঠনতন্ত্র অমান্য করে কেন্দ্রীয় পাঁচ নেতাকে অব্যাহতি অব্যাহতি দিয়েছেন তারা হলেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল আলীম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম খাঁ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আহমেদ তালুকদার, দপ্তর সম্পাদক এম এইচ এনামুল হক রাজু ও উপ প্রচার সম্পাদক ইউসুফ আলী বাচ্চু। এতে করে ফুঁসে উঠেছে কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতাকর্মীরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শেখ আজগর নস্কর পূর্বে কখনও আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরে বাংলাদেশ আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের সহ-সভাপতি হিসেবে আজগর তার নাম লেখান। সে সময় দলীয় কর্মসূচিতে তেমন তার উপস্থিতিও ছিলনা তার। ৯ সেপ্টেম্বর দলীয় নেতাকর্মীদের না জানিয়ে দেশের বাইরে যান মৎস্যজীবী লীগর সাধারণ সম্পাদক আজগর নস্কর। কাউকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে না যাওয়ায় সংগঠনের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। ফলে দলীয় কর্মসূচি পালন করতে না পারায় সংগঠনের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে বিষয়টি মৌখিক ভাবে জানান।

ওবায়দুল কাদের বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং ১নং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল আলীমকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়ার নির্দেশনা দেন সভাপতি সাইদুর রহামন সাইদকে। পাশাপাশি মৎস্যজীবী লীগ নেতাকর্মীদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ারও নির্দেশনা দেন। ওবায়দুল ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশ পেয়ে দলীয় কর্মসূচি পালন করেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আর সেকারণেই ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে লায়ন শেখ আজগর নস্কর তাদের অব্যাহতি দেন বলে অভিযোগ করেছেন ওই ৫ নেতা।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে কয়েকজন নেতাকর্মী বলেন, নিজের অপরাধ ঢাকতে এবং একক কর্তৃত্ব ধরে রাখতে মরীয়া সাধারণ সম্পাদক লায়ন শেখ আজগর নস্কর। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাধারণ সম্পাদক একক সিদ্ধান্তে কাউকে অব্যহতি বা বহিষ্কার করার ক্ষমতা রাখেন না। সংগঠনকে ভাগাভাগি করে দোকানে পরিণত করেছেন সভাপতি সাইদুর রহামান সাইদ, কার্যকরী সভাপতি সাইফুল আলম মানিক ও সাধারণ সম্পাদক আজগর নস্কর।

মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে খুনী দেলোয়াকে পদ দিয়েছেন মৎস্যজীবী লীগের এই শীর্ষ তিন নেতা। দেলোয়ারের টাকায় সভাপতি সাইদ মগবাজার ফ্ল্যাট কিনেছেন। এছাড়া দেলোয়ারের ভাড়া করা গাড়িতে এখন তিনি চলাচল করেন (গাড়ি নং ঢাকা মেট্রো-চ ১১৯৯৯১)।

তারা বলেন, ২০১৬ সালে মৎস্যজীবী লীগের কাউন্সিলে নেতৃত্বের স্বাধ নিতে উঠে পড়ে লাগেন। নিজস্ব মালিকানায় রাজধানীর ফকিরাপুলে আবাসিক হোটেলে বিভিন্ন কৌশলে কর্মীদের ডেকে, নেতাদের সান্নিধ্য পেতে লাখ লাখ টাকা খরচ করেন। ২০১৯ সালের ২৯ নভেম্বরে জাতীয় সম্মেলনে আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন আজগর আলী। উক্ত পদ পেতে তার খরচ হয়েছে প্রায় ৮/১০ কোটি টাকা, যা তিনি প্রায়ই নেতা-কর্মীদের সামনে বলেন। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার পর ক্ষমতা ও টাকার গরমে বেপরোয়া হয়ে উঠেন আজগর।

নারীসহ নানা রকম অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েন। তার স্ত্রী বিষয়টি জানতে পেরে বিভিন্ন অপকর্মর বিরোধীতা করেছিলেন। এক পর্যায়ে ২০২১ সালে জোরপূর্বক স্ট্যাম্প পেপারে তার স্ত্রী মিনা মেহেরকে করিয়ে নেন এবং ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া সন্তানদের কথা উপেক্ষা করেও স্ত্রীকে তালাক দিয়ে বাসা থেকে বের করে দেন পাষ- আজগর আলী নস্কর।

নেতাকর্মীরা আরও বলেন, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা সিলেট, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, গাজীপুর, শরীয়তপুর, খুলনা, বগুড়া, রংপুর, ফরিদপুরসহ প্রায় জেলায়ই টাকার বিনিময়ে ছাত্রদল এবং জামায়াত-শিবির নেতাদের দলে ঢুকিয়েছেন তিনি। এমনকি আজগর নস্কর তার নিজের অফিসের জিএমকে মৎস্যজীবি লীগের অর্থ সম্পাদক ও অফিস পিওন জুম্মন হোসেনকে সহ-সম্পাদক করেছেন উভয়েই এক সময় যুবদল-বিএনপি নেতা ছিলেন।

এছাড়া শেখ আজগর নস্কর সংগঠনের নাম ব্যবহার করে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। আজগর নস্করের রাজধানীর বনানীর অফিসে নেতাকর্মীরা নিয়মিত হাজিরা দেন এবং পদ বাণিজ্যের লেনদেন ওই অফিসে বসেই হয়। আজগর নস্কর টাকার বিনিময়ে ক্ষমতার আপব্যবহার করে জামায়াত-বিএনপিসহ অনেক বিতর্কিত লোকদের সংগঠনে পদ পদবী দিয়েছেন। কমিটি ও পদ বাণিজ্য করে এতোদিনে আজগর নস্কর কামিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। আজগর নস্করের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা রয়েছে যারা সারা দেশে কমিটি বাণিজ্য করে লাখ লাখ টাকা আজগর নস্করকে এনে দেন। অধিকাংশ জেলায়ই টাকার বিনিময়ে কমিটি দিয়েছেন তারা। যার ফলে দলের সুনাম যেমন নষ্ট হচ্ছে পাশাপাশি জেলায় জেলায় গ্রুপিংয়েরও সৃষ্টি হচ্ছে।

বিগত মৎস্যজীবী লীগ আয়োজিত একটি সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, তাজরীন ফ্যাশনের দেলোয়ার কি ভাবে মৎস্যজীবী লীগে আসলো। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। কিন্তু ওবায়দুল কাদেরের কথা উপেক্ষ করে আজগর নস্কর দেলোয়ারদের কমিটির চিঠি দেন। অনেক নেতাকর্মীর মনে প্রশ্ন যে, আজগর নস্কর কি ওবায়দুল কাদেরের চেয়েও শক্তিশালী?

অব্যাহতি পাওয়া পাঁচ নেতা বলেন, সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককের পদ বাণিজ্য ও তাদের অর্পকমের প্রতিবাদ করলে গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে আজগর নস্কর অন্যায় ভাবে আমাদের অব্যাহতি দিয়ে হয়রানি করছেন। এ সব অভিযোগ নিয়ে আমরা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছি।

এ ব্যাপারে সংগঠনের সভাপতি সাইদুর রহমান সাইদকে তার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিফ করেননি।

এ ব্যাপারে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আজগর নস্করকে ফোন দিলে তিনি পরে কথা বলবো বলে ফোন কেটে দেন।

বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতে হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগ স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে চলে যাবে এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে পাশাপাশি আওয়ামী লীগের জন্য বিষ ফোঁড়া হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন সংগঠনের তৃনমূল ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা।