• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৩:৫৭ অপরাহ্ন

টাঙ্গাইলে নায়েব ফরহাদ সিন্ডিকেটের কোটি টাকার মাটি বানিজ্য


প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ১৭, ২০২৩, ৬:৪৭ অপরাহ্ন / ১৭১
টাঙ্গাইলে নায়েব ফরহাদ সিন্ডিকেটের কোটি টাকার মাটি বানিজ্য

মোঃ রাসেল সরকার,টাঙ্গাইল থেকে ফিরেঃ টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক, মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও তার নায়েব ফরহাদ সিন্ডিকেট আশ্রায়ন প্রকল্প প্রতিষ্ঠার অন্তরালে কৃষকের তিন ফসলি জমির মাটি জোড়পূর্বক কেটে নিয়ে ইটভাটায় বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে স্থানীয় ভুমি অফিসের নায়েব ফরহাদ হোসেন চান্দুলিয়া গ্রামের শতাধিক কৃষকের তিন পুরুষের রেকর্ডীয় জমি গায়ের জোড়ে সরকারের ১নং খাস খতিয়ানে দেখিয়ে আশ্রায়ন প্রকল্প গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছেন। প্রকল্পটি অনুমোদনের আগেই ভূমি অফিসের নায়েব ফরহাদ হোসেন ভূমিদস্যু শওকতের মাধ্যমে ভেকু দিয়ে মাটি কেটে ট্রাকভর্তি করে ইটভাটায় পাঠাচ্ছেন। এবিষয়ে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েও অদ্যবধি কোন প্রতিকার পাচ্ছে না এসব জমির কৃষকরা।

সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, মির্জাপুর উপজেলার চান্দুলিয়া মৌজাধীন শতাধিক কৃষক পরিবার সিএস রেকর্ড থেকে শুরু করে হালে বিএস রেকর্ড পর্যন্ত কেউ বাপ-দাদার ওয়ারিশসুত্রে, কেউ ক্রয়সুত্রে আবার কেউবা সরকারের ১/১নং খতিয়ানে জমির মালিকানা প্রাপ্ত হয়ে যুগ যুগ ধরে জমিগুলো ভোগদখলে রেখে ফসলের চাষাবাদ করে আসছে। জমিগুলোতে বছরে তিনবার ফসল ফলে।

জমিগুলো কৃষকদের জীবনজীবিকার একমাত্র অবলম্বন। এসব জমির কৃষকরা খুবই সহজ সরল, ক্ষমতাহীন গ্রামের মানুষ। আর এই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে নায়েব ফরহাদ সিন্ডিকেট। একটু ভয়ভীতি দেখালেই তাদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে। একারনে আশ্রায়ন প্রকল্প অনুমোদন হওয়া আগেই মাটি কাটার কাজ চালু করেছেন নায়েব ফরহাদ সিন্ডিকেট। তবে আশ্রায়ন প্রকল্পের নামে মাটি কাটা হলেও মাটি চলেও যাচ্ছে মাটিখেকু শওকত ও সানোয়ার সিন্ডিকেটের ইটভাটায়। প্রতি ট্রাক মাটির দাম ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। দিনে অন্তত সাড়ে ৩শৎ থেকে ৪শৎ ট্রাক মাটি ইটভাটায় বিক্রি করে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে নায়েব ফরহাদ হোসেন, এসিল্যান্ড আমিনুল ইসলাম বুলবুল, মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান, টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দার।

ভুক্তভোগি কৃষকরা জানান, ৩০ নভেম্বর-২০২২ তারিখে এবিষয়ে উল্লেখপূর্বক করে জেলা প্রশাসক জসিমউদ্দিন হায়দার বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করা হলেও অদ্যবধি তিনি কোন প্রকার ব্যবস্থা গ্রহন করেনি। অভিযোগের অনুলিপি প্রদানের মাধ্যমে এসিল্যান্ড আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হাফিজুর রহমানকে জানানো সহ পুরো গ্রামবাসী একাধিকবার তার দপ্তরে উপস্থিত হয়ে অভিযোগ জানিয়ে কোন প্রকার প্রতিকার না পেলেও জমি ছেড়ে দেয়ার হুমকি ধামকি পেয়েছেন অসংখ্যবার।

অভিযোগে জমির মালিক মহর আলী ওরফে শহীদুর রহমান সহ শতাধিক জমির মালিক জানান, তারা টাঙ্গাইল জেলা সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে ২২মার্চ-২০২০ তারিখে তাদের মালিকানাধীন রেকর্ডীয় জমির স্বত্ব ঘোষণার মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-৫৭/২০২০। কিন্তু স্থানীয় ভুমিদস্যু শওকত ও সানোয়ার সিন্ডিকেটের কু-প্ররোচনায় ২৯ নভেম্বর-২০২২ তারিখে ইউনিয়ন উপ-সহকারী কর্মকর্তা বা নায়েব ফরহাদ হোসেন উক্ত জমিতে আশ্রায়ন প্রকল্প গড়ে তোলার কথা বলে তাদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদের হুমকি প্রদর্শন করেন। ফলে কৃষকরা ৩০নভেম্বর-২০১২ তারিখে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের আলোকে জেলা প্রশাসক কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় নায়েব ফরহাদের নির্দেশে স্থানীয় ভুমিদস্যু শওকত ও সানোয়ার ভেকু দিয়ে উক্ত ফসলি জমির মাটি কাটতে শুরু করেন। এসময় কৃষকরা বাধা প্রদান করলে তাদেরকে পুলিশ দিয়ে হয়রানী করা হয় এবং বলা হয় এই জমিতে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত আশ্রায়ণ প্রকল্প করা হবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এই জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রি করা হয়েছে। যদিও উল্লেখিত স্থানের অধিকাংশ জমির রেকর্ডীয় কাগজপত্র থাকা স্বত্ত্বেও সেগুলো আমলে নেয়া হচ্ছে না। বিষয়টি বহুরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সহ ১১জানুয়ারী-২০২৩ তারিখে মির্জাপুর উপজেলা চেয়ারম্যানকে বরাবর অবগত করা হয়। উপজেলা চেয়ারম্যান এবিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অনুরোধ করলেও কোন প্রতিকার মিলে না। বরং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ১৫জানুয়ারী-২০২৩ তারিখে শওকত ও সানোয়ারের লোকজন নিয়ে কৃষকদের চাষের জমিতে ব্যবহৃত ডিপ-টিউবয়েলটি বন্ধ করে দেন। ডিপ-টিউবয়েলটি বন্ধ করায় সেচের অভাবে কৃষি জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ রয়েছে “এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী রাখা যাবে না”। অথচ এখানকার প্রশাসনিক কর্মকর্তার অসৎ উপায়ে কৃষি জমির মাটি অন্যত্র বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার লক্ষে কৃষকদের সাথে একধরনের যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। দৃশ্য দেখলে মনে হয় যেন তারা বার্মা থেকে ভেসে আসা রোহিঙ্গা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ভুমিদস্যু শওকত ও সানোয়ারের কর্মচারীরা ভেকু দিয়ে জমির মাটি কেটে ট্র্যাকভর্তি করে ইটভাটায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। আশ্রায়ন প্রকল্পের নামে কৃষকের জমির মাটি জোড়পূর্বক কেটে ইটভাটায় কেন পাঠানো হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে শওকতের কর্মচারীরা জানান এটা তাদের মালিকের নির্দেশেই হচ্ছে। প্রতি ট্র্যাক মাটির দাম ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। দিনে অন্তত ৫শৎ ট্র্যাক মাটি ইটভাটায় পাঠানো হয়। আশ্রায়ন প্রকল্পের তথ্যাবলী সংবলিত সাইনবোর্ড প্রকল্পধীন জমিতে টাঙ্গানো থাকার নিয়ম থাকলেও সেই চিত্রটি খুজে পাওয়া যায়নি। মুলত প্রকল্পটি পুরোপুরি অনুমোদনের আগেই মাটি লুটপাটের কাজ শুরু করে দিয়েছে নায়েব ফরহাদ সিন্ডিকেট। প্রকল্প আওতাধীন এলাকার ভূমিহীন লোকজন অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে উপকারভোগিদের তালিকায় থাকা কথা। কিন্তু চান্দুলিয়া গ্রামের কোন পরিবার এই প্রকল্পে পূর্নবাসন পাবেন বলে তালিকা হয়েছেন এমন কোন পরিবারের তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি স্থানীয় ওয়ার্ডের মেম্বারও এই প্রকল্পের ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট তথ্য জানেন না। এছাড়া রেকর্ডপত্রে মালিকানা প্রাপ্ত জমির মালিকরা জমি অধিগ্রহনের ব্যাপারে কোন নোটিশ পায়নি। ২০২২ সালে ক্রয়কৃত জমির মালিক জানান তিনি অল্প কিছু দিন আগে সাবরেজিষ্ট্রি দলিলের মাধ্যমে নিকট আত্মীয়ের কাছে থেকে জমি কিনেছে এবং কাগজপত্রে কোন সমস্যা নেই। নায়েব ফরহাদ তার মতো শতাধিক কৃষকের জমি সরকারের ১নং খাস খতিয়ানে দাবী করে মাটি কাটার কাজে ভেকু-ট্র্যাক নিয়োগ করেছে-চলমান।