• ঢাকা
  • রবিবার, ২৬ মে ২০২৪, ০৮:৪২ পূর্বাহ্ন

কেন বারবার পেছাচ্ছে সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন?


প্রকাশের সময় : অগাস্ট ৭, ২০২৩, ৮:৩৩ পূর্বাহ্ন / ১১৪
কেন বারবার পেছাচ্ছে সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন?

এম রাসেল সরকার, ঢাকাঃ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর ১১ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। তবে এখনও জানা যায়নি এই হত্যাকাণ্ডের কারণ। ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরইমধ্যে শতবার পিছিয়েছে আদালতে এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ। প্রায় একযুগ পার হয়ে যাওয়ার পরও মামলাটির তদন্ত শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে ভুক্তভোগী পরিবারে। স্বজনরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবেই আটকে আছে মামলাটির কার্যক্রম। তাদের ক্ষোভ, তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন করলেও ফল আসবে না, যদি সরকার আন্তরিক না হয়।

চলতি বছরের ২২ জুন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফি উদ্দিনের আদালতে মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু র‌্যাব প্রতিবেদন দাখিল না করায় আদালত পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন ৭ আগস্ট। এদিন দাখিল না হলে শততমবারের মতো পেছাবে প্রতিবেদন জমার তারিখ।

এতবার তারিখ পেছানোর মধ্য দিয়ে মামলাটিতে তদন্ত সংস্থার ব্যর্থতা প্রকাশ পাচ্ছে বলেও দাবি সাংবাদিক দম্পতির স্বজনদের। তবে র‌্যাবের দাবি, মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনাস্থলে আলামত না পাওয়া এবং বিদেশ থেকে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট আশাব্যঞ্জক না হওয়ায় এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না। আদালতে প্রতিবারই এ বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয় এবং এ কারণেই আদালত অধিকতর তদন্তের জন্য সময় দিচ্ছেন। মামলার বাদী মেহেরুন রুনির ভাই নওশাদ আলম রোমান বলেন, র‌্যাব অনেক ঘটনায় তদন্ত করে রহস্য উন্মোচন করেছে। তবে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মামলাটির এখন পর্যন্ত কোনও কূলকিনারা করতে পারেনি। আদৌ র‌্যাব মামলাটির তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দিতে পারবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। যদি তারা দিতে পারতো তাহলে অনেক আগেই দিয়ে দিতো বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি দাবি করেন, ঘটনাস্থল থেকে আলামত জব্দ করা হয়েছে। যদিও র‌্যাব বলছে, আলামত অনেকাংশেই নষ্ট হয়েছে। এটা একটা টালবাহানা। মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য যদি আদালত তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন করে বা অন্য কোনও সিদ্ধান্ত দেন, তাহলে সেটা আদালতের নির্দেশনায় হবে। আমরা তদন্ত সংস্থা পরিবর্তনের জন্য কোনও আবেদন করবো না। তদন্ত সংস্থা যতই পরিবর্তন হোক, সরকার এ বিষয়ে আন্তরিক না হলে এর সুরাহা হবে না। এর আগে ব্যর্থতার দায় নিয়ে র‌্যাব মামলাটির তদন্তভার ছেড়ে দেবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মামলাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এই মামলাটি তদন্ত করা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি সংস্থা ঘুরে র‌্যাবের কাছে মামলাটি যখন আসে তখন আলামত হিসেবে সেরকম কোনও কিছুই পাওয়া যায়নি। কোনও ফুটপ্রিন্টও সেভাবে পাওয়া যায়নি। এছাড়া আমেরিকা থেকে ডিএনএ টেস্টের জন্য যে রিপোর্ট এসেছে, সেখানেও আশানুরূপ কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। আরও কিছু রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে টেস্টের জন্য। সব বিষয় মাথায় রেখেই মামলাটির তদন্তকাজ শেষ করতে তদন্ত করছে তদন্তকারী কর্মকর্তা।’

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে নিজেদের ভাড়া বাসায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি। পরবর্তী সময়ে এ ঘটনায় মেহেরুন রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। থানা পুলিশের তদন্ত শেষে মামলাটি স্থানান্তর করা হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে। গোয়েন্দা বিভাগ থেকে কোনও অগ্রগতি না হওয়ায় আদালতের নির্দেশে সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের তদন্তভার পায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

আলোচিত এ হত্যা মামলায় রুনির বন্ধু তানভীর রহমানসহ মোট আসামি আট জন। অন্য আসামিরা হলেন–বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ, পলাশ রুদ্র পাল ও আবু সাঈদ। আসামিদের প্রত্যেককে একাধিকবার রিমান্ডে নেওয়া হলেও তাদের কেউই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়নি।

এ মামলায় এখন পর্যন্ত তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে ছয় জন। বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মোহাম্মদ শহিদুল আলম সপ্তম ব্যক্তি, যিনি এ মামলা তদন্ত করছেন। মামলায় আদালতে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে ১০ বার।

প্রথমে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন শেরেবাংলা নগর থানার এক উপপরিদর্শক (এসআই)। চারদিন পর চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্তভার হস্তান্তর হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হত্যা মামলাটির তদন্তভার যায় র‍্যাবে।

২০১৪ সালের ২০ মার্চ র‌্যাবের সহকারী পুলিশ সুপার মো. ওয়ারেছ আলী মিয়া তদন্তের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় প্রথম অগ্রগতি প্রতিবেদন দেন। এরপর আরও ছয়বার অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেন তিনি। এরপর র‍্যাবের সহকারী পুলিশ কমিশনার মহিউদ্দিন আহম্মদ ২০১৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এবং ২০১৭ সালে ১৫ মার্চ দুইবার অগ্রগতি প্রতিবেদন দেন।

সর্বশেষ বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা র‍্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মোহাম্মদ শহিদুল আলম ২০১৯ সালের ৭ জুলাই এ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন। এরপর ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর তিনি অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন।

সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মামলাটি যথাযথভাবে তদন্তের লক্ষ্যে জব্দকৃত আলামত ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আদালতের অনুমতিক্রমে আমেরিকার ‘ইন্ডিপেরডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিস’ বরাবর পাঠানো হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আগে পাঠানো আলামতসমূহ এবং গ্রেফতারকৃত আসামিদের বুকাল সোয়াব (Boccol Swab) পর্যালোচনায় অজ্ঞাতনামা দুই জন পুরুষের ডিএনএ পাওয়া গেছে। তাদের চিহ্নিত করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে প্যারাবন স্ন্যাপশট (Parabon Snapshot) নামের আমেরিকার আরেকটি ডিএনএ ল্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে, যারা ডিএনএ থেকে অপরাধী বা জড়িত ব্যক্তির ছবি প্রস্তুত করতে পারে। এই ল্যাবের সঙ্গে আগের প্রতিষ্ঠান ইন্ডিপেনডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিসের সমন্বয়ের মাধ্যমে ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের ছবি প্রস্তুতের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।

এই অগ্রগতি প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, এই কাজের জন্য প্যারাবন স্ন্যাপশটকে সার্ভিস চার্জ হিসেবে ১ হাজার দুইশ’ মার্কিন ডলার ফি পরিশোধ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে অগ্রগতি বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য ই-মেইল করা হয়। ল্যাব কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে এখনও কোনও মতামত দেয়নি। ডিএনএ প্রযুক্তির মাধ্যমে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের প্রচেষ্টাসহ মামলার তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত আছে।

এই মামলার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অপরাধ তথ্য ও প্রসিকিউশন বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এ মামলার কোনও তদন্ত প্রতিবেদন পাইনি। সোমবার (৭ আগস্ট) ধার্য তারিখে প্রতিবেদন দাখিল না হলে নতুন তারিখ পড়বে।’

এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম বলেন, মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্ব সহকারে মামলার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।