নিজস্ব প্রতিবেদক: মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী, আবেদনকারী একজন শহীদজায়া। তিনি আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং এ দেশের এক জন প্রধান কবি এবং বুদ্ধিজীবী হাসান হাফিজুর রহমানের ভ্রাতৃবধূ। হাসান হাফিজুর রহমানও আজ বেঁচে নেই। এই পরিবারের সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা বহুকালের। আবেদনপত্রটির প্রতিটি বাক্য সত্য। আপনি উদ্যোগী হলে এদের ন্যায্য দাবিটি স্বীকৃত হয়। বিনীত শামসুর রাহমান, ১৪/১২/৯৯। একাত্তরে শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ডা. হাসিবুর রহমানের স্ত্রী সৈয়দা রিজিয়া আক্তারের নামে বরাদ্দকৃত রাজধানীর পল্লবীর ১ নম্বর রোডের ২৪ নম্বর প্লটের পাঁচ কাঠা জমির মূল্য ১৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকার পরিবর্তে নামমাত্র মূল্যে বরাদ্দ দিতে কবি শামসুর রাহমান এমনই অনুরোধ করেন তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। কবি শামসুর রাহমানের সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। সেই মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে ২০০২ সালে জমিটি শহিদজায়ার নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এরপর ২০১০ সালে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে তিন ব্যক্তি পাঁচ কাঠা জমির ওপর একতলা বাড়িটি দখল করেন। তারাই আবার ২০১৫ সালে সরকারের পরিত্যক্ত সম্পত্তি জাল দলিলের মাধ্যমে জনৈকা রাশিদা আক্তারের কাছে বিক্রি করে দেন। বর্তমানে ঐ জমিতে একটি ডেভেলপার কোম্পানি ১০ তলা ভবন নির্মাণ করছে।
১৯৭৫ সালের ২৪ মার্চ ঐ বাড়িতে তৎকালীন সরকারি কর্মকর্তা তালেব আলীকে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৮৯ সালে তালেব আলীর মৃত্যুর পর ১৯৯০ সালের জানুয়ারি মাসে তার স্ত্রী রিজিয়া বেগম চৌধুরী শহিদজায়া সৈয়দা রিজিয়া আক্তারে কাছে জমির দখল বুঝিয়ে দেন। ঐ বাড়িতে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করার পর ১৯৯৫ সালের ২১ জানুয়ারি পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ড জমির মূল্য ১৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা পরিশোধ সাপেক্ষে শহিদ পরিবার হিসেবে সৈয়দা রিজিয়া আক্তারের নামে বরাদ্দ দেয়। পরবর্তী সময়ে ২০০২ সালে ৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা পরিশোধ করার পর পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ড ৫ কাঠা জমি ও দোতলা বাড়িটি শহিদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী সৈয়দা রিজিয়া আক্তারের নামে বরাদ্দ দেয়। ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল একদল সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে বাড়িটি দখল করে নেয়। বৃদ্ধা সৈয়দা রিজিয়া আক্তার তার চার ছেলেকে নিয়ে গেন্ডারিয়ার ডিস্টিলারি রোডে তার বোনের বাসায় ওঠেন। বাড়িটি ফিরে পেতে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে শহিদজায়া ও তার চার সন্তান সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক আবেদন করেও কোনো সুবিচার পাননি। ৭৫ বয়সোর্ধ্ব শহিদজায়া সৈয়দা রিজিয়া আক্তার এখন শয্যাশায়ী। তার চার সন্তান সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করে শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতের দারস্থ হন।
২০১৬ সালে উচ্চ আদালত বাড়িটি ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে শহিদজায়ার কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়। রায়ে বলা হয়, সরকারের পরিত্যক্ত সম্পত্তি যেটি একজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে বরাদ্দ দিয়েছে, সেটি কীভাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি দেখিয়ে অন্যের নামে দলিল সম্পাদিত হয়? বিষয়টি নিয়ে বিস্ময়ও প্রকাশ করে উচ্চ আদালত। এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ডের চেয়ারম্যান, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার, পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা মনিটরিং সেলের যুগ্ম-সচিব, গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, রক্ষণাবেক্ষণ সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী ও পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ডের সহকারী কমিশনারকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দেয়।
শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ডা. হাসিবুর রহমানের তৃতীয় ছেলে জিয়াউর রহমান সনেট বলেন, আমরা আদালতের রায়ের কপি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে জমা দিয়েছি। এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি ঐ জমিতে একটি ডেভেলপার কোম্পানি ১০ তলা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে। এ খবর পেয়ে আমরা সেখানে গিয়ে বাধা দিই। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পল্লবীর ১ নম্বর রোডের ২৪ নম্বর প্লটে সাদা রঙের দোতলা বাড়িটি ভেঙে সেখানে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে অনওয়ার্ড নামের একটি ডেভেলপার কোম্পানি। ইতিমধ্যে পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। ভবনের পানির রিজার্ভ ট্যাংক নির্মাণের কাজ চলছে। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেগম রোকেয়া সরণির পূর্ব কাজীপাড়ার ৫৭৪ নম্বর ভবনের দ্বিতীয় তলায় নিমার্ণকারী প্রতিষ্ঠান অনওয়ার্ড ডেভেলপারসের অফিস। এ ব্যাপারে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াজুল রাব্বী ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা জমির দলিল যাচাই-বাছাই করেই সেখানে ভবন নির্মাণ করছি। এ ব্যাপারে আমাদের রাজউকের অনুমতিও রয়েছে। রাজউকের নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।’ শহিদ মুক্তিযোদ্ধার নামে সরকারের বরাদ্দকৃত জমিতে কীভাবে ভবন নির্মাণ করছেন এই প্রশ্ন করা হলে রিয়াজুল রাব্বী ভূঁইয়া বলেন, জমির কাগজপত্র দেখে এ ব্যাপারে মন্তব্য করা যাবে।
আপনার মতামত লিখুন :