• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৬:০২ পূর্বাহ্ন

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মমতাজ গ্রেপ্তার


প্রকাশের সময় : এপ্রিল ৩০, ২০২৩, ৮:১১ অপরাহ্ন / ৬৭
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মমতাজ গ্রেপ্তার

এম রাসেল সরকারঃ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক যুদ্ধাপরাধী মো. মোন্তাজ আলী ব্যাপারী ওরফে মমতাজকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

শনিবার দিবাগত রাতে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানাধীন চন্দ্রা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৩ এর একটি দল। মমতাজ গাইবান্ধা সদরের নান্দিনার মৃত শমেশ উদ্দিন ব্যাপারীর ছেলে।

২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান মামলার শুনানিতে হাজিরা না দেওয়ায় মমতাজের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এরপর থেকেই মমতাজ তার নিজ বাড়ি ছেড়ে গাইবান্ধা সদরে জামাতার বাড়িতে ও পরে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরে তার বড় ছেলে শফিকুল ইসলামের ভাড়ায় আত্মগোপন করেন।

রোববার দুপুরে রাজধানীর টিকাটুলি র‌্যাব-৩ কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের একই মামলার পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ ৪টি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।

১৯৭১ সালে গঠিত জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী মমতাজ জামায়াতে ইসলামীর গাইবান্ধা সদরের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি আব্দুল জব্বার গাইবান্ধা সদর এলাকার শান্তি কমিটি এবং সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীর প্রধান সংগঠক ছিল। জব্বারের সঙ্গে যোগসাজশে মমতাজ শান্তি কমিটির সক্রিয় সদস্য হিসেবে এলাকায় লুটপাট ও বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কার্যক্রম চালান।

১৯৭১ সালের ১ জুন সকাল ১০টায় গ্রেপ্তার মমতাজ, আব্দুল ওয়াহেদ, জাছিজার রহমান, আব্দুল জব্বার এবং রঞ্জু মিয়াসহ হেলাল পার্ক আর্মি ক্যাম্প থেকে একদল পাক হানাদার ও রাজাকারের সমন্বয়ে ২০/২৫ জনের একটি দল গাইবান্ধা সদর থানার বিষ্ণুপুর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর পূর্ব পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হামলা চালায়।

অম্বিকাচরণ সরকার এবং আব্দুর রউফের বাড়িতে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে মমতাজ এবং তার সহযোগী ওয়াহেদ, জাছিজারসহ অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট চালায়। একপর্যায়ে তারা অম্বিকাচরণকে ধরপাকড় করে মুখে, মাথায় এবং বাঁশ দিয়ে বেধড়ক মারপিট করে। আঘাতের ফলে অম্বিকাচরন মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে থাকলে তারা তাকে মৃত মনে করে ফেলে রেখে লুটপাট করা মালামাল নিয়ে স্থান ত্যাগ করে।

এরপর রাজাকার ও পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে মমতাজ এবং মামলার অপর আসামিরা একই গ্রামের দিজেশচন্দ্র সরকারের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট চালায়। এছাড়াও ফুলকুমারী রানি এবং সন্ধ্যা রানিকে পাশবিক নির্যাতন করে জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায়।

ওই ঘটনায় সেই বাড়ির মালিক দ্বিজেশচন্দ্র বাধা দিলে তারা তাকে গাইবান্ধা আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে এবং মরদেহ গুম করে দেয়। এছাড়াও তারা ওই এলাকার অসংখ্য বাড়িতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, অপহরণসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালিয়ে পরিবারগুলোকে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করে।

১৯৭১ সালের ১৮ অক্টোবর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দলকে সঙ্গে নিয়ে মমতাজ, রঞ্জু, জব্বার, জাছিজার ও ওয়াহেদ মিলে গাইবান্ধা সদরের নান্দিনা গ্রামে সশস্ত্র হামলা চালায়। সেই হামলায় তারা ওই গ্রামের আবু বক্কর, তারা আকন্দ, আনছার আলী এবং নছিম উদ্দিন আকন্দকে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ওই সময় আসামিদের নেতৃত্বে একই গ্রামের সামাদ মোল্লা, শাদা মিয়া, ফরস উদ্দিন ও সেকান্দার আলী মোল্লাকে বাড়ির সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। পাশাপাশি সেই দিনে মমতাজের নেতৃত্বে তারা ৪০টিরও বেশি বাড়িঘরে ব্যাপক লুটপাট চালিয়ে সেগুলোতে অগ্নিসংযোগ করে।

একই দিনে তারা ২৫ জন সশস্ত্র রাজাকার ও ৩০ জন পাকিস্তানি সেনা নিয়ে পাশের দৌলতপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে লাল মিয়া বেপারী, আব্দুল বাকী, খলিলুল রহমান, দুলাল মিয়া, মহেশ চন্দ্র মন্ডলকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। এছাড়াও গাইবান্ধা সদর এলাকায় অবস্থিত বেশ কয়েকটি গ্রামে (নান্দিনা, মিরপুর, সাহারবাজার, কাশদহ, বিসিক শিল্প নগরী, ভবানীপুর ও চকগায়েশপুর) সশস্ত্র হামলা চালিয়ে নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক, ইসলাম উদ্দিন এবং নবীর হোসেনসহ মোট সাতজনকে গুলি করে হত্যা করে।

আব্দুর রউফ ২০০৯ সালে গাইবান্ধা অধস্তন আদালতে গ্রেপ্তার মমতাজসহ ৫ জনকে বাদী করে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মামলা দায়ের করেন।

পরে ২০১৪ সালে মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হলে মমতাজসহ অন্যান্য আসামিরা ২০১৬ সাল পর্যন্ত জামিনে থাকেন।

২০১৬ সালে জামিনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এবং পরবর্তী জামিনের আবেদন নামঞ্জুর হলে তখন থেকে আসামিরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর তদন্তে আনীত প্রতিটি অভিযোগ প্রসিকিউশনের মাধ্যমে প্রমাণিত হলে ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৫ জন আসামির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন।

মামলার রায় হওয়ার পর পলাতক অবস্থায় দুই আসামি (আব্দুল জব্বার এবং রঞ্জু মিয়া) মারা যায়। এর আগে মামলার পলাতক আসামি জাছিজার রহমান এবং আব্দুল ওয়াহেদ মন্ডলকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করে।

এরই ধারাবাহিকতায় মামলাটির সর্বশেষ পলাতক আসামি মোন্তাজ আলী ব্যাপারী ওরফে মমতাজকে শনিবার রাতে র‌্যাব-৩ গ্রেপ্তার করে।

র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক আরিফ মহিউদ্দিন বলেন, মামলাটির বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হলে মমতাজ নিজ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে আত্মগোপন করেন। মাঝে মাঝে গোপনে তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতেন। ২০১৬ সাল থেকে মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালীন কখনই আদালতে হাজিরা দেননি তিনি।

২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান মামলার শুনানিতে হাজিরা না দেওয়ায় মমতাজের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। সে সময় মমতাজ বাড়ি ছেড়ে গাইবান্ধা সদরে তার জামাতার বাড়িতে আত্মগোপন করেন। সে সময় তিনি প্রায়ই স্থান পরিবর্তন করে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরে তার বড় ছেলে শফিকুল ইসলামের ভাড়া বাসায় আসা যাওয়া করতেন।

তার ছেলের ভাড়া বাসাটি নিজ জেলা থেকে দূরে হওয়ায় সেখানে বেশি নিরাপদ ভেবে পরে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের দিকে স্থায়ীভাবে গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানাধীন চন্দ্রা এলাকায় ছেলের বাসায় বসবাস শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।