• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৫:০৯ অপরাহ্ন

অবৈধ যানে বৈধতার টিকিট : সংশ্লিষ্ট থানাকে ম্যানেজ করে কোটি টাকার বাণিজ্য


প্রকাশের সময় : মার্চ ২৩, ২০২৩, ২:২২ অপরাহ্ন / ৮৭
অবৈধ যানে বৈধতার টিকিট : সংশ্লিষ্ট থানাকে ম্যানেজ করে কোটি টাকার বাণিজ্য

এম. রাসেল সরকারঃ গত ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার অটোরিকশা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এ ধরনের গাড়ি নির্মাণ আমদানি ক্রয়-বিক্রয় বন্ধের নির্দেশ রয়েছে হাইকোর্টের আদেশে। কিন্তু নিষিদ্ধ হলেও রাজধানীর অলিগলিতে অবাধে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা। এসব চলছে শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অধীনে। এদের নিয়ন্ত্রক স্থানীয় নেতা ও প্রভাবশালীরা। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট থানাকে ম্যানেজ করে কোটি টাকার বাণিজ্য করছে। এক-একটি থানা শুধু ব্যাটারিচালিত রিকশার সিন্ডিকেটের কাছ থেকে প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা নিয়ে থাকে।

এসব রিকশা চিহ্নিত করা হয় টোকেনের মাধ্যমে। আর থ্রি-হুইলার অটোরিকশা থেকে নেওয়া দৈনিক ৩৫০ টাকা। যার একটি অংশ যায় থানায়। ফলে কোনো বাধা ছাড়াই রাস্তায় চলতে পারে এসব অবৈধ যান। এ কারণে রাস্তায় রাজার মতোই চলে ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা। যখন-তখন যেখানে-সেখানে পার্কিং, বেপরোয়া চলাচল এবং খারাপ আচরণ সবই তারা প্রদর্শন করে। এতে ঘটে দুর্ঘটনাও।

রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় অলিগলিতে দিনকে দিন বেড়েই চলছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও রিকশা। এর মধ্যে রাজধানীর পুরান ঢাকা, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, মতিঝিল, মাদারটেক, নন্দীপাড়া, বাসাবো, মুগদা, মানিকনগর, কদমতলা, বৌদ্ধমন্দির, বনশ্রী এলাকায় এর হার সবচেয়ে বেশি। মূলত জনসাধারণের সহজ ও কম ভাড়ায় যাতায়াতে সুবিধা দিয়ে থাকে এ অবৈধ যানটি। এ কারণে জনসাধারণ বিরক্ত হলেও কিছু বলতে চায় না। বেআইনি যানটি পুলিশি বৈধতা নিয়ে টিকে আছে রাজধানীহ সারা দেশে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার ২০ শতাংশই ঘটে ব্যাটারিচালিত রিকশায়। সারা দেশে দিনে অন্তত এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার পেছনে।

যেভাবে চলে বাণিজ্য : রাজধানীর সবুজবাগ থানাধীন নন্দীপাড়ার ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক মালেক জানান, প্রতি মাসে এক হাজার টাকা তাকে দিতে হয় স্থানীয় নেতাদের লোকজনকে। বিনিময়ে রিকশায় লাগিয়ে দেওয়া হয় একটি স্টিকার। এ স্টিকারের মেয়াদ এক মাস। এ স্টিকার থাকলে পুলিশ তাদের কিছু বলে না। না থাকলে গাড়ি রেকারে দেয়। সেখান থেকে ছাড়ি আনতে দুই-তিন হাজার টাকা লাগে।

মালেকের দাবি, কয়েকজন নেতার সিন্ডিকেট এসব ব্যাটারি রিকশা নিয়ন্ত্রণ করে। একেক নেতার স্টিকারে সাংকেতিক চিহ্ন থাকে। যা থেকে বোঝা যায় এ রিকশা কোন ব্যক্তির অধীনে। নেতারা তাদের লোকদের মাধ্যমে টাকা তুলে প্রতি মাসে থানায় ১০ লাখ টাকা করে দেন। এত টাকা চাঁদা উঠে এমন প্রশ্নের জবাবে মালেক বলেন, ‘একেকটি গ্যারেজে সর্বনিম্ন ১০০টি ব্যাটারি রিকশা থাকলে প্রতি গ্যারেজ থেকে এক লাখ করে টাকা উঠে। ১০টা গ্যারেজ থেকে যা উঠে তা থানায় দিলেই তো হয়। সবুজবাগ থানার আন্ডারে কমপক্ষে ৫০০ গ্যারেজ আছে। এবার হিসাব করেন?’

মালেকের মতোই একই কথা বললেন আরেক চালক মজিবর। তিনি বলেন, ‘আগে স্টিকার ছিল না। তখন পুলিশ যখন-তখন গাড়ি আটকাইয়া দিত। পরে ৫০০, ১০০০ টাকা দিয়ে ছাড়া পাওয়া লাগত। এখন স্টিকার সিস্টেম হওয়ায় এসব ঝামেলা কমছে। তবে পুলিশের সঙ্গে কোনো বেয়াদবি করলে তাকে আটকিয়ে রাখে। পরে টাকা দিয়ে ছাড়া পাওয়া লাগে।’

ব্যাটারিচালিত ও গ্যাসচালিত থ্রি-হুইলার অটোতে স্টিকার থাকে না। এদের বলা হয় লাইনের গাড়ি। একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের জন্য থাকে একটি রুট। যেমন নন্দীপাড়া ব্রিজ থেকে বিশ্বরোড (অতীশ দীপংকর সড়ক) পর্যন্ত, নন্দীপাড়া ব্রিজ থেকে শেখেরগাঁও, নন্দীপাড়া ব্রিজ টু ত্রিমোহনী পর্যন্ত একটি লাইন। কেউ কারও লাইন অতিক্রম করতে পারে না। এসব একেকটি লাইনে ২০০-৩০০ গাড়ি চলাচল করে। প্রতিটি গাড়ি থেকে দৈনিক ১৭০ থেকে ৩৫০ টাকা নেওয়া হয়। যা তুলে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী নেতার লোকজন। এর একটি অংশ যায় থানায়। জানা গেছে, একেকটি লাইন থেকে থানায় প্রতিদিন দিতে হয় লাখ টাকা।

এসব অবৈধ যান কীভাবে সড়কে চলাচল করছে জানতে চাইলে সবুজবাগ থানার ওসি বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা ও থ্রি-হুইলার অটোরিকশা নিষিদ্ধ। ফাঁক-ফোকর দিয়ে চলাচল করে। এসব নিয়ন্ত্রণে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট থাকতে পারে, আমার জানা নেই। তবে আমাদের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই।’

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ভেতরে মোটরচালিত, মেশিনচালিত, ইঞ্জিনচালিত কিংবা ব্যাটারিচালিত সব ধরনের যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়। সম্প্রতি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম।

এ নির্দেশ কতটা কার্যকর হয়েছে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, আঞ্চলিক নির্বাহী কার্যালয় ও কাউন্সিলরদের চিঠি দিয়ে এসব অবৈধ যান বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বোর্ডসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এসব বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। রাজস্ব বিভাগ, সম্পত্তি বিভাগ ও প্রকৌশল বিভাগ সমন্বিতভাবে কাজ করবে। আমরা এ কার্যক্রম আরও জোরদার করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করব।’

ব্যবসায়ীরাসহ যোগাযোগ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা দেশে কমপক্ষে ২০ লাখ এমন পরিবহন চলছে। যা ২০১৬ সালের ছিল ১০ লাখ। ব্যাটারিচালিত যানবাহনে দিনে বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি।

যে কারণে জমজমাট ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা : একটি ব্যাটাচিালিত অটোরিকশা কেনা যায় ৬০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকায়। আর নতুনটির দাম পড়ে প্রায় আড়াই লাখ। ব্যাটারিচালিত রিকশা অর্থাৎ প্যাডেলচালিত রিকশায় ব্যাটারি সংযোজন করা হয়। এ ধরনের রিকশার দাম ৬০ হাজার টাকা। একটি অটোরিকশা দৈনিক ভাড়া খাটে ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকা। একটি অটো থেকে মালিকের মাসে আয় হয় ১৫ হাজার থেকে ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। একজন মালিকের ২০০-৩০০ রিকশা থাকে। আর একজন অটোচালকের দৈনিক আয় এক থেকে দেড় হাজার টাকা। তবে অটোর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চালকদের আয় কিছু কমেছে। মালিকের লাভ বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে সিন্ডিকেট চক্রের আয়।

অন্যদিকে অটোরিকশা থেকে চালক প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা আয় করতে পারেন। আর সিন্ডিকেটের আয় এক লাখের বেশি।

চালক কারা : কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব অটোর চালক সাধারণ কমবয়সী, উগ্র মেজাজি ও অশিক্ষিত। সাধারণত নিম্নবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া ছেলেরা অধিকাংশ অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক। তবে অনেকে আয়ের উৎস হিসেবেও বেছে নেয় অটো চালানো। কারণ অটো চালাতে খুব বেশি প্রশিক্ষণ লাগে না। লাগে না ড্রাইভিং লাইসেন্স। দু-এক দিন কিছুটা প্রশিক্ষণ নিলেই তারা চালক বনে যায়।

পরিবহন সংকটের সুযোগ : মতিঝিল এলাকায় অফিস করেন আবুল বাশার। বাসা নন্দীপাড়া এলাকায়। তিনি বলেন, ‘রিকশায় আমি মতিঝিল যেতে পারি। কিন্তু ভাড়া লাগবে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। কিন্তু আমি যদি অটোতে চড়ি তবে মতিঝিল পৌঁছতে পারি মাত্র ২৫ টাকায়।’ কারওয়ান বাজারে অফিস করেন এনামুল হক। কারওয়ান বাজার যেতে কদমতলা থেকে সরাসরি কোনো যানবাহন নেই। রিকশায় যেতে চাইলে খরচ পড়বে ১৫০-১৮০ টাকা। পাঠাও মোটরসাইকেলেও তাই। কিন্তু অটোতে করে বিশ্বরোড এসে পরে সেখান থেকে বাসে কারওয়ান বাজার যেতে লাগে মাত্র ২৫ টাকা।’

যাত্রীদের ভাষ্যমতে, সবাই জানে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা অবৈধ। কিন্তু এ পরিবহনটি আমাদের যাতায়াত খরচ কমায়। চালকদের সুশৃঙ্খল ও চলাচলে শৃঙ্খলায় আনতে পারলে নগরীর অলিগলিতে ব্যাটারিচালিত অটোগুলো চলতেই পারে।

নাম প্রকাশ না করে এক মালিক বলেন, ‘আপনি রিপোর্ট করবেন, কাল পুলিশ চাঁদাবাজির দায় নেবে না। তারা অটো চলাচল বন্ধ করে দেবে। এতে কয়েক হাজার চালকের রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। আবার রুট চালু করতে পুলিশকে বাড়তি টাকা দিতে হবে। কিন্তু সিন্ডিকেট কি বন্ধ হবে? এখানে কাঁচা টাকা। কোনো বিনিয়োগ নেই, অথচ মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করা যায়।