• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৩:০৮ পূর্বাহ্ন

রাজধানীর বাতাসে বিষাক্ত প্লাস্টিক কণা, নিয়ন্ত্রণে জোর দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা


প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ৫, ২০২৩, ৯:২৩ পূর্বাহ্ন / ৯১
রাজধানীর বাতাসে বিষাক্ত প্লাস্টিক কণা, নিয়ন্ত্রণে জোর দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা

মোঃ রাসেল সরকারঃ রাজধানী ঢাকার বাতাসে বিষাক্ত অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা বা মাইক্রো প্লাস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। রাজধানীবাসীর নিশ্বাসের সঙ্গে ওই কণা শরীরে প্রবেশ করছে। এতে ক্যান্সার, শ্বাসপ্রশ্বাসের রোগ তৈরি হচ্ছে, যা ওষুধেও দূর হবে না বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকেরা। ফলে এর উৎস নিয়ন্ত্রণে জোর দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকার বাতাসে এক নতুন বিপদ দানা বাঁধছে। এত দিন বাতাসে নানা দূষিত বস্তুকণা নিয়ে উদ্বেগ ছিল। শঙ্কা বাড়িয়েছিল অতিভারী ধাতুর উপস্থিতি। মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ওই বস্তুকণা পরিমাপ করে গবেষকেরা ঢাকার বাতাসকে বিপজ্জনক বলছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয় এবং টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় ঢাকার মোট ১৩টি এলাকার বাতাসের নমুনা নেওয়া হয়। এলাকাগুলো হলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, মোহাম্মদপুর, মিরপুর-১৩, পশ্চিম কাজীপাড়া, শান্তিনগর, আরামবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল ও ফজলুল হক হল, খিলক্ষেত, ফার্মগেট, মহাখালী, মুগদা, বাসাবো। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার বাতাসের নমুনাও সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম। তিনি বলেন, আপনি চান বা না চান, নিশ্বাসের সঙ্গে ওই ক্ষতিকর উপাদান প্রবেশ করছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো এবং যাতে তা প্রকৃতিতে ফিরে না যায়, সে লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা করা হলেও তার কোনো প্রয়োগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। যে কারণে এই দূষণ বেড়েই চলেছে।

বিশ্বের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালসহ বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর হিসাবে, গত দুই বছর ঢাকা সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর হয়ে উঠেছে। গত জানুয়ারি মাসের বেশির ভাগ সময় জুড়ে ঢাকার বাতাস বিপজ্জনক ও দুর্যোগপূর্ণ ছিল।

বাংলাদেশে হওয়া একাধিক গবেষণায় নদী ও সমুদ্রের মাছ, পানি, মাটি ও চায়ের মধ্যে অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা পান গবেষকেরা। ২০২২ সালে নেদারল্যান্ডসে এক গবেষণায় মানুষের রক্তেও উপাদানটি পাওয়া যায়। সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের রক্তের নমুনা নিয়ে গবেষকেরা পরীক্ষা করেন।

একই বছর চীনের চারটি শহরের বাতাসে এই বস্তুকণার ভেসে বেড়ানো নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়। প্লাস্টিক কণা নিশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করলে প্রথমে ফুসফুস, পরে রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে ক্যানসার থেকে শুরু করে স্নায়ুজনিত নানা রোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং শ্বাসজনিত অনেক সমস্যা তৈরি করতে পারে।

তার আগে ২০২১ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের নগরগুলোতে গত দেড় যুগে প্লাস্টিকের ব্যবহার তিন গুণ বেড়েছে। রাজধানীতে বছরে মাথাপিছু প্রায় ২৩ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়। এই প্লাস্টিকের প্রায় অর্ধেক মাটি ও পানিতে রয়ে যায়। তৈরি করে মারাত্মক দূষণ। জনস্বাস্থ্যকে ফেলে হুমকিতে।

অধ্যাপক আবদুস সালামের নেতৃত্বাধীন ওই গবেষণায় বাতাসের নমুনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে গবেষণা এলাকাগুলোতে একটি বিশেষ যন্ত্র স্থাপন করা হয়। পরে গবেষকেরা সেখানে বাতাস প্রবাহিত হওয়ার পর যে ধুলা জমে থাকে, তা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করেন। এ ছাড়া একটি বিশেষ ধরনের ক্যামেরা দিয়ে ধুলা উড়ে যাওয়ার সময় ছবি তোলেন। মূলত ওই দুই পদ্ধতিতে বাতাসে অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা চিহ্নিত করা হয়।

গবেষণায় আরও বলা হয়, বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া মোট প্লাস্টিক বর্জ্যের ২৫ শতাংশ ছড়িয়ে পড়ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ গুলোতে। যার ৯১ শতাংশ ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে। এই অঞ্চলে মোট তৈরি হওয়া ৩ কোটি ২২ লাখ টন বর্জ্যের ১২ শতাংশ হচ্ছে প্লাস্টিক। যার ৭৫ শতাংশ মূলত অপরিকল্পিত ভাবে মাটি ও পানিতে ফেলা হয়। এভাবে চলতে থাকলে দক্ষিণ এশিয়ায় ২০৫০ সালের মধ্যে বছরে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়াবে ছয় কোটি টনে। এখন থেকে যদি প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাতেও বিশ্বের প্রতিবেশ ব্যবস্থায় ৫০০ কোটি টন প্লাস্টিক রয়ে যাবে। একটি প্লাস্টিক কণা প্রকৃতি অন্তত ৪০০ বছর টিকে থাকে। রাস্তার পাশে মেশিনে পাথর ভাঙার কাজ চলছে। ধুলা ছড়িয়ে গেছে চারপাশে। এ ছাড়া মাস্ক ব্যবহার না করে এভাবেই কাজ করেন শ্রমিকেরা। ধুলা-দূষণের ফলে দিন দিন বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

গবেষণায় বলা হয়, বিশ্বে বায়ুদূষণে মৃত্যু হওয়া মানুষের ৪৭ শতাংশ হয় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে। সম্প্রতি চীনের ৫টি শহরের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, সেখানে ১০ থেকে ২০ লাখ টন প্লাস্টিক কণা ছড়িয়ে পড়েছে, যা নিশ্বাসের সঙ্গে সেখানকার অধিবাসীদের শরীরে প্রবেশ করছে। এতে ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ থেকে শুরু করে নানা ধরনের রোগবালাই হচ্ছে। কিন্তু চীনের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনা করলে দেখা যাবে, চীনে ব্যবহৃত হওয়া প্লাস্টিকের ৭৪ শতাংশ প্রকৃতিতে ফেলে দেওয়া হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এই হার ৮৭ শতাংশ।