• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৮:২৬ পূর্বাহ্ন

বর্ষা এলেই জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় রাজধানীবাসীর


প্রকাশের সময় : অগাস্ট ২০, ২০২৩, ৯:৪৩ অপরাহ্ন / ৮৩
বর্ষা এলেই জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় রাজধানীবাসীর

এম রাসেল সরকারঃ ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা দীর্ঘদিনের,বর্ষা মৌসুম এলেই প্রতি বছর জলাবদ্ধতায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় রাজধানীবাসীকে। টানা ২/১ ঘণ্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় শহরের বিভিন্ন রাস্তাঘাট। রাজধানীর নিচু এলাকায় পানি জমে যায়। এতে বেশ বিপাকে পড়তে হয় কর্মজীবী নগরবাসীকে। অন্যদিকে, সেসময় পরিবহন সংকট তীব্র হয়ে যায়।

কোনোমতে রিকশা বা সিনজি পাওয়া গেলেও দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করে চালকেরা। এভাবে প্রতি বছর জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় রাজধানীবাসীকে। বৃষ্টি হলেই নগরীর অলিগলি ও ছোট পরিসরের রাস্তাগুলোতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের পথগুলো আবর্জনায় ভরাট থাকায় দ্রুত পানি নামতে পারে না। ফলে প্রতিবারই এমন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। সামান্য বৃষ্টিতে বিশেষ করে মতিঝিল, মুগদা, মানিকনগর, বাড্ডা, মালিবাগ, রামপুরা, শান্তিনগর, মৌচাক, বেইলি রোড, কাকরাইল, গুলিস্তান, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মিরপুর, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ভাটারা- বসুন্ধরা, খিলক্ষেতসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন সড়কে পানি জমে যায়।

এ বিষয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বলছে, অন্যান্যবারের তুলনায় এ বছর জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কম হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। এবার রাজধানীতে আর আগের মতো জলাবদ্ধতা থাকবে না। কিন্তু গত ৯ আগস্টে টানা প্রায় এক ঘণ্টা ভারী বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছিল। ওইদিন প্রবল বর্ষণে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।

বৃষ্টির ফলে তলিয়ে গিয়েছিল শাহবাগ, বাংলামোটর, ধানমন্ডি, মগবাজার, মতিঝিল, মুগদা, মানিকনগর, কাকরাইল, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, বেইলি রোড, কাকরাইল, রামপুরা, শাহবাগ, ধানমন্ডি, পল্টন, প্রেস ক্লাব, মিরপুর, বসুন্ধরা ও ভাটারাসহ বিভিন্ন এলাকা। তবে জলাবদ্ধতায় সবচেয়ে বেশি নাকাল হতে হচ্ছে পুরান ঢাকাবাসীকে।

রামপুরার বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছর বৃষ্টি হলেই রামপুরাসহ আমাদের এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। সিটি করপোরেশনের দুই মেয়রের বক্তব্যে আমরা প্রায় শুনি রাজধানীতে আগের মতো আর জলাবদ্ধতা হবে না। গত কিছুদিন আগে এক ঘণ্টার বৃষ্টির পর আমাদের এখানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তিনি আরও বলেন, বারবার শুনি এবার আর জলাবদ্ধতা হবে না, কিন্তু বর্ষা শুরুর আগেই অল্প বৃষ্টিতে তলিয়ে যাচ্ছে সড়ক।

রাজধানীর জুরাইন, শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, বনশ্রী ও ভূঁইয়া পাড়া এলাকায় জলাবদ্ধতা দীর্ঘদিনের সমস্যা।

ভূঁইয়া পাড়া এলাকার বাসিন্দা রুহুল আমিন জানান, প্রতি বছর জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় আমাদের। অনেক বছর ধরে রাস্তা-ঘাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থার কোনো সংস্কার হয়নি। ফলে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। আর বেশি বৃষ্টি হলে পানি নেমে যেতে সময় লাগে আরও বেশি। বৃষ্টির ফলে প্রগতি সরণির কুড়িল-রামপুরা সড়কের বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা দেখা যায়।

এই এলাকার বাসিন্দা ওয়াহিদ বলেন, বর্ষা মৌসুম এলেই প্রতি বছর জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ফলে কর্মজীবী মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এ ছাড়া অতিবৃষ্টি হলে এই সড়কে যানবাহনও ধীরগতিতে চলাচল করে। জলাবদ্ধতার কারণে সড়কে পানি জমে থাকায় যানবাহনও কম পাওয়া যায়। জলাবদ্ধতার মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- খালগুলো অবৈধ দখলে থাকা, পানিপ্রবাহ ঠিক না থাকা এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কার্যকর পরিকল্পনা না থাকা। তবে, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কী করছে জানতে চাইলে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের ১ হাজার ২৫০ কিলোমিটার ড্রেন আছে। এগুলো নিয়মিত পরিষ্কারের পাশাপাশি সেখানে পানিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে কাজ চলছে। খালগুলো থেকে বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। আশা করা যায় এবার জলাবদ্ধতা কিছুটা হলেও কমবে।

তিনি বলেন, এ ছাড়া আমাদের কুইক রেসপন্স টিম গঠন করা আছে। জলাবদ্ধতার কারণে সবচেয়ে বেশি জনদুর্ভোগে পড়েন কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়ার বাসিন্দারা। ওয়াসা থেকে প্রাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থায় এসব জটিলতার অবসান হয়েছে। এছাড়া ২৯টি খাল নিয়ে কাজ করছি। উদ্ধারের পর কিছু খনন, পরিষ্কার, খালপাড় সবুজায়ন, ওয়াক ওয়ে নির্মাণকাজ করা হচ্ছে। পাশাপাশি জিআইএস পদ্ধতিতে খালের সীমানা নির্ধারণ কার্যক্রম চালু রেখেছে তার। সেখানে তারা এখন পর্যন্ত ৫২৪টি পিলার স্থাপনের কাজ শেষ করেছে। খালগুলোর নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চলমান আছে। খাল দখলমুক্তের কাজ করছে।

তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে ইব্রাহিমপুর, লাউতলা, কল্যাণপুর, রূপনগর, আব্দুল্লাহপুর, সিভিল এভিয়েশন, বাইশটেক ও বাউনিয়া খাল দখলমুক্তের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, উত্তরের মোট ১০৩টি স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টির পরিবেশ আছে। সেখানে অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। স্থানগুলো চিহ্নিত করে সংস্থাটি কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়া তাৎক্ষণিক কোথাও জলাবদ্ধতা হলে ডিএনসিসির কুইক রেসপন্স টিম এবার কাজ করবে। এ ছাড়াও গত এক বছরে প্রায় ২ লাখ টন বর্জ্য অপসরণ করেছে।

অন্যদিকে, কল্যাণপুর রিটেনশন পন্ড-কে একটি অত্যাধুনিক হাইড্রো ইকোপার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেখানে বেদখল হওয়া ৫৩ একর জায়গা উদ্ধারের পর এখন খনন কাজ চলছে। কল্যাণপুর রিটেনশন পন্ড থেকে অপসারণ করা হয়েছে ৩০ লাখ ঘনফুট স্ল্যাজ। জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে মগবাজার, মধুবাগ, কারওয়ান বাজার, উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরসহ এয়ারপোর্ট রোড ও বনানী রেলগেট থেকে কাকলী মোড় পর্যন্ত ড্রেন নির্মাণ ও পাইপলাইন স্থাপন করা হচ্ছে।

জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কী করছে জানতে চাইলে প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা খালসহ করপোরেশনের আওতাভুক্ত নালা-নর্দমা নিয়মিত পরিষ্কার করছি। আপনারা জানেন ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা একটা নিয়মিত বিষয়। এ ছাড়া কিছু জায়গাতে রাস্তার নির্মাণকাজ চলমান থাকায় সেখানে কিছু জলাবদ্ধতা হচ্ছে, যা কয়েক দিনে ঠিক হয়ে যাবে।

জলাবদ্ধতা নিরসনের পদক্ষেপের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু করেছি। ইতোমধ্যে এর সুফল নগরবাসী পাওয়া শুরু করেছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন, খাল, নর্দমা ও বক্স-কালভার্ট হতে বর্জ্য ও পলি অপসারণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম আধুনিকায়ন, আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল পুনরুদ্ধার এবং খাল সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টির মতো কার্যক্রমের সুফল নগরবাসী ইতোমধ্যে পাওয়া আরম্ভ করেছে। আশা করা যায় জলাবদ্ধতাবিষয়ক সমস্যা অনেকাংশে কমে আসবে।

তিনি আরও বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। গত তিন বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে নিজস্ব অর্থায়নে ২২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩৬টি স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নে কাজ হয়েছে। যার সুফল গত বছর থেকেই নগরবাসী পেতে শুরু করেছে। আগে বৃষ্টির সময় নগরীর ৭০ শতাংশ ডুবে যেত। কিন্তু এখন জলাবদ্ধতা আগের মতো হচ্ছে না।

মেয়র তাপস বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে নিজস্ব অর্থায়নে ২২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে গত তিন বছরে ১৩৬টি স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন করেছে। ধানমন্ডি- ২৭, পলাশী মোড়, আজিমপুর মোড়, শান্তিনগর, রাজারবাগ, বাংলাদেশ সচিবালয়, মতিঝিল এলাকার নটরডেম কলেজের সামনের অংশ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের সামনের রাস্তা, সূত্রাপুর শিল্পাঞ্চল এখন আগে থেকে কম পানি জমে বলে ডিএসসিসি দাবি করেছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন শ্যামপুর, মান্ডা, জিরানী ও কালুনগর- এ চার খালের বর্জ্য ও পলি অপসারণ এবং খাল সংস্কার করে নান্দনিক পরিবেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে ডিএসসিসি। ৮৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হতে যাওয়া এ চার খালের নকশা, অঙ্কন ও জরিপ কাজ চলছে। একই সঙ্গে এসব খাল থেকে বর্জ্য অপসারণ ও ভূমি উন্নয়নের লক্ষ্যে দরপত্র কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। অন্যদিকে, কামরাঙ্গীরচরের মুসলিমবাগ থেকে রায়েরবাজার পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের সীমানা পুনর্নির্ধারণের কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নিজস্ব অর্থায়নে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চ্যানেলের বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম চলমান বলে জানায় ডিএসসিসি।

উল্লেখ্য, ঢাকা ওয়াসা দীর্ঘ ৩৪ বছর পর ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শাখা-প্রশাখাসহ ১১টি অচল খাল, বর্জ্যে জমাটবদ্ধ পাঁচটি বক্স কালভার্ট ও প্রায় ২০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নর্দমার মালিকানা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করেছে। দায়িত্বভার গ্রহণের পর এসব খাল, বক্স-কালভার্ট ও নর্দমা থেকে বর্জ্য অপসারণ, সীমানা নির্ধারণ ও দখলমুক্ত কার্যক্রম শুরু করে তারা।

এসব খাল, বক্স-কালভার্ট ও নর্দমা থেকে ২০২১ সালে ৮ লাখ ২২ হাজার টন, ২০২২ সালে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টন এবং ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১ লাখ ৩৫ হাজার টন বর্জ্য ও পলি অপসারণ করা হয়েছে বলে দাবি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের।