• ঢাকা
  • সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৫ অপরাহ্ন

হাসান মেহেদী হত্যার দুই মাস : শূন্যতা আর অনিশ্চয়তার হাহাকারে পরিবার


প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৪, ২:২৩ অপরাহ্ন / ১০
হাসান মেহেদী হত্যার দুই মাস : শূন্যতা আর অনিশ্চয়তার হাহাকারে পরিবার

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ ঢাকা টাইমসের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হাসান মেহেদী হত্যার দুই মাস হয়ে গেল। তরুণ সাংবাদিকের এই অনুপস্থিতি সহকর্মী আর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শূন্যতা এনে দিয়েছে দিনের বেশির ভাগ সময় তো এই মানুষগুলোর সঙ্গেই কাটত মেহেদীর। কিন্তু হারানোর বেদনা, সে তো পরিবারের মানুষগুলোর চেয়ে বেশি নয় আর কারও। তার ছোট্ট দুই সোনামণি বাবার স্নেহছোঁয়া পায় না কত দিন! বাবা নেই, আর আসবে না কোনোদিন, সেটা বোঝার বয়স হয়নি তাদের। তাই বাবার অপেক্ষা তাদের প্রতিদিন।

হাসান মেহেদীর স্ত্রী ফারহানা ইসলামের কষ্ট কী ভাবে ব্যাখ্যাত হবে? কদিনই বা হলো তার সংসারের যাত্রা। ২০১৮ সালে শুরু মেহেদীর সঙ্গে তার যুগল জীবন। এই ছয় বছরে সংসার আলো করেছে দুই কন্যা সন্তান। একজনের বয়স সাড়ে তিন বছর, অন্য জনের সাত মাস। মেয়েদের মুখে বাবা ডাক শুনতে ব্যাকুল থাকতেন হাসান মেহেদী। সাত মাস বয়সী মেহেরাশ আধো বুলিতে আবু (আব্বু) বলে ডাকত তাকে। ছোট্ট এক চিলতে ঘরে বাবা-মেয়ের আদর-আহ্লাদ মুগ্ধ চোখে দেখতেন মা। সুখের এই সময়ে বৈধব্য হানা দিল তরুণী কপালে। সঙ্গে সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা। গত দুই মাসে শঙ্কা শুধু নয়, বাস্তবতা এসে হাজির হয়েছে সামনে।

চোখে অন্ধকার দেখছেন হাসান মেহেদীর বাবা-মা। বড় সন্তানের আয়েই যে চলত তাদের ভরণ-পোষণ। হার্টের রোগী বাবার চিকিৎসা-ওষুধ খরচ আসবে কোথা থেকে! ১৩ বছরের ছোট ছেলের লেখাপড়া কী ভাবে চলবে ভেবে পান না তিনি। আর সন্তানের লাশ কাঁধে নেওয়ার চিরস্থায়ী বেদনা বুকের ভেতর সারাক্ষণই ঘাই দিয়ে যায়। বাবার মন কিছুতেই সন্তান হত্যা মেনে নিতে পারছে না। ন্যায়বিচার পেতে দ্বারস্থ হয়েছেন আদালতের।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের কাজলা ঢালে পুলিশের গুলিতে নিহত হন হাসান মেহেদী। দিনটি ছিল ১৮ জুলাই। এই আন্দোলনে প্রথম শহীদ সাংবাদিক। দেশের ইতিহাসে কোনো আন্দোলনে সংবাদ সংগ্রহে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশের গুলিতে সাংবাদিক হত্যার ঘটনাও প্রথম।

ঢাকা টাইমসের দুদক বিটের সাংবাদিক হাসান মেহেদী সেদিন সকাল থেকে দুদকে দায়িত্ব পালন করেন। সেখান থেকেই বিকালের দিকে ছুটে যান যাত্রাবাড়ী। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের তুমুল সংঘর্ষ চলছে সেখানে। একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, হাসান মেহেদী তখন পুলিশের কাছাকাছি থেকে ভিডিও ধারণ করছিলেন।

একজন সাংবাদিক জানান, হাসান মেহেদী ফ্লাইওভারের ওপর থেকে নিচে কাউকে বলছিলেন, ওপরে লাশ পড়ে আছে। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে বাক্য বিনিময় হয়। তার মিনিট দশেকের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হন হাসান মেহেদী।

হাসান মেহেদীকে প্রথম উদ্ধার করেন মো. ইয়াছিন আহমেদ নামের একজন শিক্ষার্থী। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ছাত্র আর পুলিশ দফায় দফায় জায়গাটির দখল নেওয়ার চেষ্টা করছিল। পুলিশ এসে গুলি করে আবার দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছিল। এর মধ্যে সেখানে একজনের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখি আমরা। সেই মরদেহ দেখতে গিয়ে দেখি পাশেই আরেকজন মানুষ। তার গলায় সাংবাদিক পরিচয়পত্র ঝোলানো।

হাসান মেহেদী হয়তো এই লাশের কথাই বলছিলেন। মানবিক এই কর্তব্যবোধের দায় তাকে দিতে হয়েছে জীবন দিয়ে। পুলিশের গুলিতে ঝাজরা হয়ে যায় বুক, গলায় গভীর ক্ষত, বাহু আর মুখে কয়েক ডজন ছররা গুলি, মাথায়ও অগণন। হাসান মেহেদীর মৃত্যু সনদে ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসক লিখেন গান শট ইনজুরি।

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পুলিশ মেহেদী হত্যার দায় বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপিয়ে দিয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করে। আর হাসিনা সরকারের পতনের পর হাসান মেহেদীর খালা পরিচয় দিয়ে গত ২৫ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ ৩৪ জনের নামে মামলা করেন রিজিয়া বেগম নামের একজন নারী। কিন্তু তাকে চেনেন না হাসান মেহেদীর পরিবার। তার বাবা মোশাররফ হোসেন ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩৬ জনকে আসামি করে আদালতে মামলার আবেদন করেন। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহিন রেজা তার জবানবন্দি গ্রহণ করে যাত্রাবাড়ী থানাকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের আদেশ দেন।

মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন– ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, হাবিবুর রহমান, হারুন অর রশিদ, বিপ্লব কুমার।

যাত্রাবাড়ী থানার তখনকার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসানকে গত সোমবার (১৬ সেপ্টেম্বর) কক্সবাজারের টেকনাফ থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

হাসান মেহেদি হত্যার ১৭ দিন পর তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, পুলিশের গুলিতে কোনো সাংবাদিক মারা যায়নি। এমনকি তিনি এও বলেন, আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে কেউ মারা যায়নি।

তাহলে কার গুলিতে সাংবাদিক নিহত হলেন? প্রশ্ন উঠেছিল তখন। পুলিশ গুলি না করলে কে গুলি করল হাসান মেহেদীকে। সাংবাদিক হাসান মেহেদীর বুকে-পিঠে অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন। আন্দোলন-সংগ্রামে এই গুলি ব্যবহার করে পুলিশ। ছররা গুলি পুলিশ ছাড়া আর কেই-বা ব্যবহার করে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান (বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা) আসিফ নজরুল বলেছিলেন, সরকার এভাবে সব সময় নিজেদের দায়মুক্ত রেখে দেশকে আজ এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে। সাংবাদিক হত্যা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্য সম্পূর্ণ অমূলক।

তরুণ সাংবাদিক হাসান মেহেদী হত্যায় অপরাধীদের বিচার এবং তার পরিবারের আর্থিক অনিশ্চয়তা দূর করতে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত সময়ে ব্যাবস্থা নিবেন এমনটাই আশা করছে তার পরিবারসহ সবাই।