
বিশেষ প্রতিবেদক, ঢাকাঃ গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে বহুল পরিচিত জাতীয় প্রেসক্লাব। ৭০ বছর আগে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এটি কখনো নির্বাচনের বাইরে ছিল না। দুই বছর পর দ্বি-বার্ষিক সাধারণ সভা ও নির্বাচন হয়ে আসছে নিয়মিত। এমনকি মার্শাল ল’ ও জরুরি অবস্থায়ও যথারীতি এখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। অথচ এবার হয়নি। হচ্ছে না। একটি মৌলবাদী দলের আখড়ায় পরিণত হওয়ায় এটি এ অবস্থায় গিয়ে পৌঁছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বিগত স্বৈরাচারের আমলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের নির্বাচিত কমিটিকে হটিয়ে একটি দখলদার কমিটি নেতৃত্ব নেয়। তারা দায়িত্ব নিয়ে বেছে বেছে আওয়ামী ঘরানার ছয় শতাধিক জনকে সদস্য পদ দেয়। আর জাতীয়তাবাদী ঘরানার ৪৩ জনের সদস্য পদ কেড়ে নেয়।
এর মূল ভুমিকায় ছিলেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে দখলদার কমিটিতে ঠাঁই পাওয়া আমিরুল ইসলাম কাগজী ও সরদার ফরিদ আহমদ। দখলদার কমিটির সহযোগি হিসেবে এদেরকে ওই সময় জাতীয়তাবাদী সাংবাদিক ফোরাম থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল। শুধু কি তাই, তৎকালীন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ের পক্ষ থেকে বহু আবেদন নিবেদন করার পরও তারা দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ইফতার করতে দেয়নি। অথচ এ প্রেসক্লাবের পরতে পরতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার কতই না অবদান।
স্বৈরাচারের ১৫ বছর আওয়ামী বিষ্ঠা খেকো কাগজী এখন জিয়া ফাউন্ডেশন আর বিএফইউজের কোনো ধরনের পদের অধিকারী না হয়েও হেজবুত তাহরীরের প্রশিক্ষক নারী কেলেঙ্কারির হোতা ১৫ বছর আওয়ামী সুবিধাভোগী সরদার ফরিদ মিথ্যা তথ্য দিয়ে পিআইবিসহ বিটিভিতে জাতিকে জ্ঞান দিচ্ছে। এতে দীর্ঘ ১৬ বছর রাজপথে আন্দোলনকারী জাতীয়তাবাদী ঘরানার পরীক্ষিত সাংবাদিকরা যারপরনাই বিস্মিত ও অবাক।
জাতীয় প্রেসক্লাবে এবার নির্বাচন দেওয়া হচ্ছে না। যারা এখন দায়িত্বে আছে তারা নির্বাচন না করে আরো এক বছর থাকতে চায়। আর এ জন্য ১৬ নভেম্বর ২০২৪ একটি ইজিএম ডাকে। যেখানে গায়ের জোরে সন্ত্রাসী কায়দায় অসদস্যদের ভোটে সেটিকে পাস দেখানো হয়! হামলা করা হয় এ নিয়ে গঠনতান্ত্রিক প্রশ্ন তোলা সিনিয়র সদস্যদের উপর। সদস্যপদ কেড়ে নেওয়া হয় গঠনতন্ত্র নিয়ে যৌক্তিক দাবিতে কথা বলতে চাওয়াদের। এসব অবাধ হামলার সঙ্গে জড়িত ‘২৭৭ ব্যাচ’ হিসেবে পরিচিত সদস্য পদ স্থায়ী না হওয়া মৌলবাদীরা। যাদের সদস্য পদ দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে।
এদের বেশির ভাগই ক্লাবের গাছতলায় নানা ফন্দি-ফিকিরে ব্যস্ত থাকত। এদের একজন ছিনতাই মামলার আসামী। যাকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বেঁধে রাখা হয়। একজনকে অনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে অতীতে জাতীয় প্রেসক্লাবে নিষিদ্ধ করা হয়। অথচ তাকে সদস্য পদই কেবল দেওয়া হয়নি, বছর না পেরোতেই তাকেসহ আরো অনেককে ক্লাবের বিভিন্ন কমিটির সদস্য করা হয়। আর যার নেতৃত্বে ক্লাবের ইজিএমে হামলা হয়। অরাজকতা কাকে বলে। অনেকের সদস্য পদ দেওয়া হয় টাকার বিনিময়ে। এদের মধ্যে একজন তো ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আবেদন না করেও সদস্য পদ পাওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
নিয়ম অনুযায়ী এদের বাছাই কমিটির সুপারিশ করা তালিকা নোটিশ বোর্ডে টানানো হয়নি। এভাবে নোটিশ টানিয়ে সদস্যদের অবহিত করার নজির রয়েছে। অথচ সেটা মানা হয়নি। এতে প্রকৃত পক্ষে প্রেসক্লাব সদস্যদের অধিকার হরণ করা হয়েছে। সন্ত্রাসী এবং গায়ের জোরে প্রেসক্লাব কুক্ষিগত করে রাখার কারণে সদস্যরা ক্ষুব্ধ এজন্য প্রবীণ সদস্যরা এখন আর প্রেসক্লাবে যায় না।
মজার ব্যাপার হলো, এ ঘটনার আগে প্রেসক্লাবে রাতের অন্ধকারে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান একাধিকবার আসেন। সাধারণ সম্পাদকের কক্ষে দীর্ঘ সভা করেন ফেনী কলেজের ছাত্র শিবিরের সাবেক সাথী আইয়ুব ভুইয়াদের সঙ্গে।
আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, ক্লাবের দোতলায় রেড ব্লক এখন জামায়াত-শিবিরের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। ফলে সদস্যরা এখন এটির নাম দিয়েছে ‘জামাত চত্বর’। এই কক্ষ প্রায় সারাক্ষণ জামায়াতিদের দখলে থাকে। যেখানে তাদের অবাধ খোশগল্প, সভা ও ভোজন পর্ব চলে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, জাতীয় প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহসভাপতি ভারপ্রাপ্ত হবার পর হঠাৎ সভাপতি লেখা শুরু করেন। সবাইকে অবাক করে এ পদবীকে ব্যবহার করে জুলাই-আগস্টের শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানী করে নির্লজ্জের মতো স্বৈরাচারের পরীক্ষিত দোসর বসুন্ধরার পত্রিকায় সম্পাদক বনে যান।
যেখানে রংপুরের শহীদ আবু সাঈদের ভাইয়েরা বীরের মতো বসুন্ধরার চাকরি প্রত্যাখ্যান করে, সেখানে গোলামির জিঞ্জির গলায় কী ন্যক্কারজনক নজিরই না সৃষ্টি করলেন কাঙ্গাল (হাতপাতা/ভিক্ষা) কবি হিসেবে পরিচিত হাসান হাফিজ গং। পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না তার প্রমাণ স্বরূপ বৈষম্যবিরোদী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উসকানি দেওয়ায় সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভুইয়ার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে।
প্রেসক্লাবের এতদিনের রেওয়াজ ভেঙ্গে নির্বাচন না করা নিয়ে মিডিয়ায় কোনো টুঁ-শব্দ নেই! গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় যেখানের সদস্যদের পদ কেড়ে নেওয়া হয়, সেখানে অগণতান্ত্রিক উপায়ে যেনতেন ভাবে ক্ষমতায় আকড়ে থাকার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হচ্ছে বর্তমানে মিডিয়া কতটা চাপে ও আতঙ্কের মধ্যে আছে। অথচ এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। এছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের তালিকার কথা বলে সিনিয়র অনেক সদস্যকে বাদ দেয়। যেখানে তালিকা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে।
রহস্যজনক কারণে একুশে টিভি দখল করা মনজুরুল আহসান বুলবুল, বিএফইউজের সভাপতি ওমর ফারুক, মহাসচিব (বিএল কলেজের ছাত্র শিবিরের ক্যাডার ও সাবেক কোষাধ্যক্ষ) বিএফইউজের মহাসচিব দীপ আজাদ, সাবেক মহাসচিব আবদুল জলিল ভুইয়াসহ অনেকের নাম নেই। অথচ সে তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও অনেকের সদস্য পদ বাদ দেওয়া হয়নি। শোনা যায় এটা নিয়ে বড় অঙ্কের বাণিজ্য হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা বলায় জাতীয় প্রেসক্লাবে অসংখ্যবারের নির্বাচিত সম্পাদক ও সভাপতি শওকত মাহমুদের সদস্য পদ স্থগিত করা হয়। স্থগিত করা হয় সালমা ইসলামের অথচ এ ক্ষেত্রেও বৈষম্য করা হয়। একই কারণে স্থগিত করা হয়নি স্বৈরাচারের সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও এ কে আজাদ সাহেবের সদস্য পদ। এতে অকাট্য প্রমাণ হচ্ছে যে নিয়ম-প্রথা অনুযায়ী প্রেসক্লাবে নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় শওকত মাহমুদ গংয়ের সদস্য পদ স্থগিত এবং অন্যদের বহিষ্কার করা হয়।
কয়েকজনের ব্যাপারে বিএনপির মহাসচিব বরাবর লিখিত দেওয়ার পরও টনক নড়েনি বসুন্ধরার মলমূত্র খাদক ও বিএনপির পরিচয় বহনকারী জামাতি চক্রের।
জাতীয় প্রেসক্লাবে চলমান অরাজকতা প্রমাণ করছে এটি কিছু লোকের পৈতৃক সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। যখন তখন যাকে পছন্দ হয় না তাকে বাদ দিচ্ছে, আর যাকে প্রয়োজন বোধ করছে তাকে আপন করে নিচ্ছে।
শহিদুল ইসলাম ওরফে জঙ্গি শহিদ নামে জামাতপন্থি সাংবাদিক ইউনিয়নের এই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে নারী কেলেংকারীর। প্রেসক্লাবে এখন তিনিই জামায়াতের নেতা। নীতি নৈতিকতা বিরোধী লেডি কিলার নামে পরিচিত এই জঙ্গি শহিদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে সাংবাদিক সমাজ। প্রতি শনিবার হাউজি খেলার নামে জুয়ার আসর থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে লুটেরা চক্র। এ সব ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্রকে তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। যে কারণে এখন আওয়াজ উঠছে সাংবাদিকদের জাতীয় এ প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে এটিকে দীর্ঘদিনের বৈষম্য দূর করতে গঠনতন্ত্রের চর্চা চালু করার।
এর মধ্য দিয়ে মূলতঃ মুক্ত মত, বাক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কবর রচনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত জাতীয় প্রেসক্লাবের বর্তমান জামায়াত নিয়ন্ত্রিত বিতর্কিত নেতৃত্ব। ফলে এখানে প্রশাসক বসিয়ে বৈষম্য দূর করা সময়ের দাবি বলে মনে করছে অভিজ্ঞ মহল।
প্রশাসক বসানো হলে ক্লাবে চলমান বৈষম্য দূর হবে এবং সদস্যরা ভোটের মাধ্যমে তাদের সঠিক ও যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচিত করে জামায়াতের অরাজক পরিস্থিতি থেকে ক্লাবকে রক্ষা করতে সক্ষম হবেন।
আপনার মতামত লিখুন :