আজকের বাংলাদেশ ডেস্কঃ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের কারাগারে এখন থেকে কয়েদিরা তাঁদের স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক (শারীরিক সংসর্গ) করতে পারবেন। সম্প্রতি পাঞ্জাব রাজ্য সরকার ভারতের প্রথম কারাগার হিসেবে রাজ্যের টার্ন টারান জেলার গোইন্দাল কারাগারে কয়েদিদের এ সুবিধা দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে।
বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাঞ্জাবের গোইন্দাল কারাগারে প্রথম এ সুবিধা পেয়েছেন হত্যা মামলার আসামি ৬০ বছর বয়সী গুরজিৎ সিং। তিনি ওই কারাগারে বেশ কয়েক মাস ধরে বন্দী। কারাগারে স্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সময় কাটানোর সুযোগ পেয়ে গুরজিৎ সিং বলেন, ‘কারাগারে একা ও বিষণ্ন হয়ে পড়েছিলাম। স্ত্রীর সঙ্গে কারাগারেই ব্যক্তিগত মুহূর্ত কাটানোর সুযোগ পাওয়ায় বেশ স্বস্তি বোধ করেছি।’
গত মাসে নতুন কর্মসূচি চালু হওয়ায় কারাগারের ভেতর কয়েদিদের এ ধরনের সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে পাঞ্জাব প্রথম ভারতীয় রাজ্য। গত ২০ সেপ্টেম্বর রাজ্যের ২৫টি কারাগারের মধ্যে তিনটি কারাগারে এ সুবিধা চালু হয়েছে। কর্মসূচি অনুযায়ী ৩ অক্টোবরের মধ্যে ১৭টি কারাগারে এই সুবিধা চালুর কথা বলা হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, অন্য কারাগারগুলো আয়তনে অনেক ছোট এবং একটি শিশুদের জন্য। এ কারণে এসব কারাগারে এ সুবিধা চালু করা যায়নি।
পাঞ্জাব কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, যেসব কয়েদি আচার-আচরণে ভালো, প্রতি দুই মাসে দুই ঘণ্টার জন্য তাঁদের স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সময় কাটানোর সুযোগ দেওয়া হবে। রাজ্য সরকার কারা কর্তৃপক্ষকে অনুমতি দেওয়ার পর এক হাজারের বেশি কয়েদি এ সুযোগ চেয়ে আবেদন করেছেন। ইতিমধ্যে প্রায় ৫০০ কয়েদি এ সুযোগ পেয়েছেন।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুনীল সিং বলেন, ভারতের কিছু রাজ্য, যেমন রাজস্থান ও মহারাষ্ট্রের কারাগারে যেসব কয়েদি ভালো আচরণ করেন, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে কারাগারের উন্মুক্ত জায়গায় সময় কাটানোর অনুমতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া ‘সন্তান জন্ম’ বা ‘বৈবাহিক সম্পর্ক’ বজায় রাখার জন্য কয়েদিদের ছুটির অনুমতিও দেন আদালত। তবে সারা দেশের পাঁচ লাখের বেশি কয়েদি বছরের পর বছর এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সরকারি আদেশে বলা হয়েছে, কারাগারে কয়েদিদের স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সময় কাটানোর সুবিধা দিতে সংযুক্ত বাথরুমসহ একটি কক্ষ নির্ধারণ করতে হবে। ওই কক্ষে কয়েদি তাঁর স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সংসর্গ করতে পারবেন। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে ওই কক্ষের ভেতর জন্মনিরোধকও সরবরাহ করতে হবে। গত মাসে নতুন কর্মসূচি চালু হওয়ায় কারাগারের ভেতর কয়েদিদের এ ধরনের সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে পাঞ্জাব প্রথম ভারতীয় রাজ্য। গত ২০ সেপ্টেম্বর রাজ্যের ২৫টি কারাগারের মধ্যে তিনটি কারাগারে এ সুবিধা চালু হয়েছে। কর্মসূচি অনুযায়ী ৩ অক্টোবরের মধ্যে ১৭টি কারাগারে এই সুবিধা চালুর কথা বলা হয়েছে।
কারা বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হারপ্রীত সিধু বলেন, কয়েদিদের মানসিক চাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং সমাজে তাঁদের পুনঃপ্রবেশ নিশ্চিত করতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সংসর্গের সুবিধা তাঁদের জৈবিক চাহিদাও পূরণ করবে। রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, স্পেন, ফিলিপাইন, কানাডা, সৌদি আরব, ডেনমার্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু অঙ্গরাজ্যের কারাগারে কয়েদিদের দাম্পত্য সাক্ষাতের ব্যবস্থা আছে। ব্রাজিল ও ইসরায়েলে সমলিঙ্গের সঙ্গীদের সঙ্গে থাকারও অনুমতি দেওয়া হয়।
ভারতের কারাগারগুলোর ভেতরে আগে বন্দীদের সঙ্গে দর্শনার্থীদের শারীরিক সাহচর্যেরই অনুমতি ছিল না। কয়েদিদের দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপন তাঁদের মৌলিক মানবাধিকার। এ কারণে আইনজীবী অমিত সাহনি ২০১৯ সালে জনস্বার্থে দিল্লি হাইকোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করেন।
কয়েদিদের মানসিক চাপের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং সমাজে তাঁদের পুনঃপ্রবেশ নিশ্চিত করতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সংসর্গের সুবিধা তাঁদের জৈবিক চাহিদাও পূরণ করবে।
হারপ্রীত সিধু, কারা বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা
আইনজীবী অমিত সাহনি বলেন, কয়েদিদের সঙ্গে যখন তাঁদের পরিবারের সদস্যরা কারাগারে দেখা করতে আসেন, তখন তাঁদের হাত ধরতে চাওয়া ও আলিঙ্গন করতে চাওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কারা কর্মকর্তারা সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ কারণে ইচ্ছা থাকলেও কয়েদিরা লজ্জা ও ভয়ে সেসব করতে পারেন না। তিনি আরও বলেন, যিনি অপরাধ করেছেন তাঁকে শাস্তি দেওয়া যৌক্তিক। কিন্তু যে স্বামী-স্ত্রী নির্দোষ, তাঁর কী হবে? তাঁর অধিকার কেন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে? দিল্লি হাইকোর্টে অমিত সাহনির এই পিটিশনের শুনানি এখনো চলছে। তবে ‘সন্তান জন্মদান’ বা ‘বৈবাহিক সম্পর্ক’ বজায় রাখার জন্য কয়েদিরা প্যারোলে মুক্তির আবেদন জানালে আদালত প্রায় সময় তা মঞ্জুর করেন।
২০১৮ সালে মাদ্রাজ হাইকোর্ট তামিলনাড়ুর তিরুনেলভেলি জেলায় ৪০ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন। সে সময় ‘সন্তান জন্মদান’-এর জন্য ছুটি চাইলে দণ্ডপ্রাপ্ত ওই ব্যক্তিকে দুই সপ্তাহের জন্য মুক্তি দিয়েছিলেন আদালত। বিচারকেরা সে সময় বলেছিলেন, দাম্পত্য সম্পর্ক মৌলিক অধিকার, এটা কোনো সুযোগ নয়। তবে ‘কারাগারে কয়েদিরা সমলিঙ্গের সঙ্গীদের সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ করার কারণে এইচআইভি-এইডস রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে’—এমন প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে সে সময় হাইকোর্ট বেঞ্চ কারা সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
পাঞ্জাব রাজ্যের আদেশে বলা হয়েছে, কারাগারে যেসব কর্মী দীর্ঘদিন বন্দী, তাঁদের প্যারোল ছাড়াই কারাগারে দাম্পত্য সাক্ষাতের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তবে কাউকে কাউকে এই সুযোগ দেওয়া হবে না। যেসব কর্মী এ সুযোগ পাবেন না, তাঁরা হলেন সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্ত চক্রের সদস্য ও সন্ত্রাসী; যৌন অপরাধ, পারিবারিক সহিংসতা ও শিশু নিপীড়নের দায়ে যাঁরা বন্দী; যক্ষ্মা, এইচআইভি বা যৌনবাহিত রোগসহ যাঁরা সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত; যাঁরা কারাগারে গত তিন মাসে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি এবং যাঁদের আচরণ ভালো নয়।
পাঞ্জাবের টার্ন টারান জেলার গোইন্দাল কারাগারের সুপারিনটেনডেন্ট ললিত কোহলি বিবিসিকে বলেন, যখন কোনো কয়েদি দাম্পত্য সাক্ষাতের জন্য কক্ষের ভেতর ঢোকেন, তখন ওই কক্ষে বাইরে থেকে তালা মেরে দেওয়া হয়। সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী, ওই কক্ষের জানালাসহ সব ধরনের ফোকর বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ললিত কোহলি আরও বলেন, দম্পতিদের একান্তে সময় কাটানোর জন্য দুই ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়। কিন্তু অধিকাংশই সাধারণত এক ঘণ্টা সময় কাটান। কক্ষের ভেতর যদি তাঁদের কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়, তাহলে সেখানে রাখা ঘণ্টি বাজিয়ে তাঁরা প্রহরীকে ডেকে নিতে পারবেন।
তবে সরকারি এই আদেশের সমালোচনাও করছেন অনেকে। সমালোচকেরা বলছেন, কারাগার মূলত অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। সেখানে অপরাধীদের দাম্পত্য সাক্ষাতের সুযোগ দিলে ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবার কারাগারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে।
প্রতারণার একটি মামলায় অভিযুক্ত ৩৭ বছর বয়সী যোগ সিং গোইন্দাল কারাগারে বন্দী। তিনি বলেন, কয়েক মাস থেকে পরিবারের সদস্যদের দেখতে না পেয়ে তিনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবে স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাওয়ার পরও তিনি কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলেন। কারণ, কারাগারের কর্মীরা বিষয়টি কীভাবে দেখবেন—এই নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল তাঁর। তিনি আরও বলেন, ‘তবে শেষমেশ সাক্ষাৎ পর্বটি ভালো হয়েছে। আমি আনন্দিত।’
তবে সরকারি এই আদেশের সমালোচনাও করছেন অনেকে। সমালোচকেরা বলছেন, কারাগার মূলত অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। সেখানে অপরাধীদের দাম্পত্য সাক্ষাতের সুযোগ দিলে ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবার কারাগারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে। পাঞ্জাবে খুন হওয়া সংগীতশিল্পী সিধু মুসেওয়ালার মা চরণ কৌর সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, তাঁর ছেলে হত্যায় অভিযুক্ত ১৮ জনের মধ্যে একজন পুলিশ হেফাজতে থেকেই পালিয়ে গেছেন। এরপর ওই কারাগারেই অপরাধীদের জন্য বিশেষ কক্ষ তৈরি করা হলো।
বিচারের উদ্দেশ্য কেবল বন্দীদের শাস্তি দেওয়া নয়, তাঁদের সংশোধন করাও। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁরা যেন আবার সমাজে একত্র হতে পারেন, সেটাও বিচারের উদ্দেশ্য।
অমিত সাহনি, ভারতীয় আইনজীবী
তবে কারা কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, সিধু মুসেওয়ালার হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তরা দাম্পত্য সাক্ষাতের সুযোগ পাবেন না। যেহেতু তাঁরা সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্ত চক্রের সদস্য ও সন্ত্রাসী, তাই তাঁরা এই অনুমতি পাবেন না।
আইনজীবী অমিত সাহনি বলেছেন, ভারতের সব কারাগারেই কয়েদিদের দাম্পত্য সাক্ষাতের সুবিধা দেওয়া উচিত। আর এটা বন্দীদের সংশোধনে একটি দুর্দান্ত পদক্ষেপ হবে। তিনি বলেন, বিচারের উদ্দেশ্য কেবল বন্দীদের শাস্তি দেওয়া নয়, তাঁদের সংশোধন করাও। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁরা যেন আবার সমাজে সহজে ফিরে যেতে পারেন, সেটাও বিচারের উদ্দেশ্য।
আপনার মতামত লিখুন :