আজকের বাংলাদেশ ডেস্কঃ দুই বছর আগে, ভারতের সংবিধান সংশোধন করে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রশাসনিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের সময় অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন, সেখানকার পরিস্থিতি লাগামের বাইরে চলে যাবে। অনেকেই তখন বলেছিলেন, কাশ্মীরে নাকি বাড়বে পাকিস্তানি প্রভাব। নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত সাবেক পাকিস্তানি হাইকমিশনার তো কাশ্মীরে গণহত্যা, রক্ত নদী, পারমাণবিক যুদ্ধ থেকে শুরু করে অনেক আশঙ্কার কথা শুনিয়েছিলেন তখন।
২০১৯ সালের ৫ আগস্টের পর, গত দুবছরে বোঝা গেল সব আশঙ্কাই ভুল। জম্মু ও কাশ্মীর এখন গত কয়েক দশকের তুলনায় অনেক বেশি শান্ত। উন্নয়নের স্রোতে ভাসছে উপত্যকা। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই কাশ্মীরের মানুষও ভোগ করছেন নাগরিক অধিকার।
গত দুবছরে কেন্দ্রশাসিত জম্মু ও কাশ্মীরে আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বিক্ষিপ্ত জঙ্গিবাদী কার্যকলাপেও ফুটে উঠেছে পাকিস্তান মদদপুষ্ট জঙ্গিদের হতাশার ছবি। পুলিশ কর্মীদের পরিবারকে তাদের আক্রমণের দুর্বল লক্ষ্য বানিয়ে বা মসজিদে প্রার্থনার সময় রক্তক্ষয়ী কাপুরুষোচিত হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা নিজেদের হতাশাই ব্যক্ত করছে।
পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযান আরও বেগবান হয়ে হতাশ করে তুলছে সন্ত্রাসীদের। এক সময়ে পাঞ্জাবে পাকিস্তান মদদপুষ্ট জঙ্গিরা যেমন হতাশা থেকে নিরীহ মানুষদের ওপর আক্রমণ করে বিশ্বাসযোগ্যতা খুইয়েছিল, পুলিশ পরিবারের ওপর হামলা চালিয়ে ঠিক তেমনি কাশ্মীরেও তারা জনসমর্থন খুইয়েছে। নিরীহ মানুষ বিরক্ত সন্ত্রাসী কার্যকলাপে। জঙ্গি হামলা বন্ধের পাশাপাশি সন্ত্রাস দমনে বেশ সফল নিরাপত্তা বাহিনী। জঙ্গি দলের সদস্য সংখ্যা ব্যাপক কমেছে।
নতুন করে জঙ্গি নিয়োগও প্রায় বন্ধ। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলেই দেখা যায়-আইইডি, গ্রেনেড বা পাথর হামলার ঘটনাও এখন অনেক কম। ২০১৯ সালের পর থেকে হিজবুল মুজাহিদিন, জয়শ-ই-মোহাম্মদ, আনসারগাওয়াত-উল-হিন্দের মতো সংগঠনের কট্টর জঙ্গিদের অনেককেই নিরাপত্তারক্ষীরা ঘায়েল করেছে। স্থানীয় কাশ্মীরিদের সহযোগিতাই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর সাফল্যের মূল কারণ।
কাশ্মীরিরাই এখন নিরাপত্তা বাহিনীর চোখ-কান হিসাবে কাজ করায় ২০১৯ সালের পর থেকে সন্ত্রাস অনেকটাই কমেছে।
গত দুবছরে কাশ্মীরের মানুষ পেয়েছেন নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা। তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পর্যটন ও হটিকালচার (বাগান পরিচর্যা) নির্ভর উন্নয়নে মিলছে সহযোগিতা। কর্মসংস্থান ও আয় বাড়াতে এ দুটি ক্ষেত্রকেই গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
আপেল, আখরোট, চেরি, নাশপাতি ও ফুল চাষে সরকারি সহায়তায় স্থানীয়রা তাদের রোজগার তিন-চার গুণ বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি হিমঘর নির্মাণ, প্রক্রিয়াকরণ, উড়োজাহাজে ফসল দেশের অন্যত্র পরিবহণের সুবিধাও পাচ্ছে চাষীরা। ফলে উৎপাদিত পণ্যের বাজার পেতেও সুবিধা হচ্ছে তাদের।
তৃণমূল স্তরে মানুষের চাহিদা মেটাতে জেলা ও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে তহবিল সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে।
ফলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মানুষের কল্যাণে প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারছেন। কাশ্মীর উপত্যকার সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের দ্রুত রেল যোগাযোগ স্থাপনে সরকার ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করেছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে। কোভিড মোকাবিলায় জম্মু ও শ্রীনগরে গড়ে উঠেছে দুটি ৫০০ শয্যার হাসপাতাল।
কেন্দ্রশাসিত জম্মু ও কাশ্মীরে দুটি অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স বা এইমস-এর মতো হাসপাতাল, সাতটি মেডিকেল কলেজ, একটি ক্যানসার হাসপাতাল, একটি হাড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এবং একটি শিশু হাসপাতাল হচ্ছে। স্মার্ট সিটি প্রকল্পে নতুন নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ ছাড়াও মেট্রোরেল চালানোরও পরিকল্পনা রয়েছে। তথ্য ও প্রযুক্তির উন্নয়নে গড়ে উঠছে আইটি হাব। গত সাত দশকের তুলনায় মাত্র দুবছরেই ব্যাপক উন্নয়নের স্বাদ পাচ্ছে কাশ্মীর।
জম্মু ও কাশ্মীরে উন্নয়নের পাশাপাশি দীর্ঘ বঞ্চনারও অবসান ঘটেছে। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ৩৭০ ধারা বিলোপ করায় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের নাগরিকদের মতো সমান অধিকার ভোগ করছে সেখানকার মানুষ। নয় শতাধিক আইনি সুবিধা দেশের বাকি অংশের মতোই কাশ্মীরের মানুষও এখন ভোগ করছেন।
তফসিলিভুক্ত জাতি ও উপজাতি, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মানুষ, শিশু, সংখ্যালঘু, বনবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন পাচ্ছেন সাংবিধানিক সুযোগ-সুবিধা। শিক্ষার অধিকার জম্মু ও কাশ্মীরেও প্রতিষ্ঠিত।
কাশ্মীরি নারীরা ভিন রাজ্যের বাসিন্দাদের বিয়ে করলে তাদের স্বামী বা সন্তানরাও উপত্যকার বাসিন্দার মর্যাদা পাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শরণার্থী হয়ে আসা মানুষগুলোর ৩৭০ ধারা লোপের পর মিলেছে নাগরিকত্ব।
২০১৮ সালে সাবেক জম্মু ও কাশ্মীরে বিজেপি ও আঞ্চলিক দল পিডিপির সরকার পতনের পর রাষ্ট্রপতি শাসন জারিতে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়। কিন্তু কেন্দ্রের শাসনকালে সুষ্ঠুভাবে গ্রাম ও শহরের স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সর্বদলীয় বৈঠক করে সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছেন। সর্বদলীয় বৈঠকে নির্বাচিত বিধানসভা গঠনেরও ইঙ্গিত মিলেছে।
বিধানসভার আসনগুলোর সীমানা নির্ধারণের পর আগামী বছরেই সেখানে ভোটের সম্ভাবনা প্রবল। আসলে জম্মু ও কাশ্মীরে সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের সুফল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বিধানসভা ভোটের পর কাশ্মীর ভারতের মানচিত্রে আরও উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠবে।
পাকিস্তান অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের কোনো তুলনাই চলে না। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে স্বাধীন মতপ্রকাশের কোনো অধিকার নেই। কিন্তু ভারতের ছবিটা পুরো উল্টো।
জম্মু ও কাশ্মীরের প্রতিটি বাসিন্দাই ভারতের নাগরিক। তাই তারা স্বাধীনভাবেই ভোটে দাঁড়ানোর অধিকারী। শুধু ভোটে দাঁড়ানোই নয়, ভারতের অন্য অঞ্চলের নাগরিকদের মতোই কাশ্মীরিদেরও রয়েছে চাকরি থেকে শুরু করে সব নাগরিক অধিকার। পাকিস্তানের মতো নাগরিক অধিকার খর্ব করা হয় না ভারতে। নাগরিকদের ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতিচর্চায়ও রয়েছে সমান অধিকার।
কাশ্মীরিরাও ভারতীয়, ভারতীয় পরিচয় নিয়েই তারা গর্বের সঙ্গে বাস করেন। এ নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। তাই জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ ভারতের জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমি একজন মুসলিম। একজন ভারতীয়ও। এ দুইয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ আমার চোখে ধরা পড়েনি।’
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট, ৩৭০ ধারা বিলোপের পর ভারতের বাকি অংশের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের মানসিক দূরত্ব আরও কমেছে। কাশ্মীরি বা মুসলিমদের কাছেও বড় হয়ে উঠেছে ভারতীয় পরিচিতি। এটাই বোধহয় ৩৭০ ধারা বিলোপের বড় সাফল্য।
কাশ্মীরি মুসলমানরা মূল ভূখণ্ডের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অনেক বেশি আগ্রহ নিয়ে এই নতুন জাত জাগরণকে আরও উন্নত করেছে। ২০১৯ সাল থেকে, কাশ্মীরি মুসলমানরা, যারা পূর্বে মূল ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ঘটনাবলীতে বিচ্ছিন্ন এবং আগ্রহী থাকবে না, তারা এখন মূল ভূখণ্ডের সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে সক্রিয় আগ্রহ নিয়েছে এবং এমনকি তাদের মধ্যে অংশ নিচ্ছে, তা হোক দিল্লিতে সিএএ বিরোধী প্রতিবাদ অথবা ভারতের সমস্ত অঞ্চলে কোভিড রোগীদের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং ওষুধের জন্য অনুরোধ বাড়ানো। মূল ভূখণ্ডের রাজনীতিতে এই নতুন পাওয়া আগ্রহ কাশ্মীর উপত্যকায় তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে কাশ্মীরি জনগণের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক অবদান রেখেছে। কাশ্মীরের মানুষ এখন প্রশ্ন করতে শুরু করেছে যে কেন ব্রাহ্মণ থেকে ধর্মান্তরিত উচ্চবর্ণের কাশ্মীরি মুসলিম পরিবার এবং সৈয়দ মল্লা এই কয়েক দশক ধরে কাশ্মীর উপত্যকায় কেবলমাত্র শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক পদই অর্জন করেননি, এমনকি তারা প্রশাসনেও আধিপত্য বিস্তার করেছে কাশ্মীর উপত্যকায় ব্যবসা। ২০১৯ সাল থেকে, কাশ্মীরের লোকেরা এখন রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ভালোর জন্য গ্রহণ করতে শুরু করেছে এবং এটি তাদের দীর্ঘ বিলম্বিত মনস্তাত্ত্বিক সংহতির ব্যাখ্যা দেয়
আপনার মতামত লিখুন :