• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৪০ পূর্বাহ্ন

নীলফামারীর ডিমলায় পুরুষশূন্য কুঠির ডাঙ্গা গ্ৰাম


প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ২৬, ২০২২, ১১:৩৬ অপরাহ্ন / ৬১
নীলফামারীর ডিমলায় পুরুষশূন্য কুঠির ডাঙ্গা গ্ৰাম

নিজস্ব প্রতিবেদক,নীলফামারীঃ নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় শনিবার বুড়িতিস্তা নদী জরিপ কাজের সংঘর্ষের ঘটনায় এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জলঢাকা শাখার উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ একরামুল হক বাদী হয়ে ডিমলা থানায় মামলা দায়ের করেন। এতে ৭৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরো পাঁচ থেকে ছয়শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। আর এই অজ্ঞাতনামা মামলায় গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছে ওই এলাকার পরিবারগুলো। পুরুষেরা ছেড়েছেন ঘরবাড়ি। পুরা এলাকা নীরব, নিস্তব্ধ, শুনশান ও ভুতুড়ে অবস্থা বিরাজ করছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মামলার কথা শুনে বাড়ি ছেড়েছে কর্তা পুরুষ। গ্রেফতার আতঙ্কের মধ্যেই সময় পার করছে বাড়ির নারী ও শিশুরা। বাড়িতে কিছুক্ষণ সময়ের জন্য আসলেও একটু পরে বাড়ি ছাড়ছেন পুরুষেরা। অজ্ঞাতনামা মামলার কথা শুনে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে সে গ্রামে।

কুঠির ডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা মনসুরা বেগম বলেন, আমরা শুনেছি যে মামলা হয়ছে। তাও আবার পাঁচশো, ছয়শো মানুষের নামে। যেহেতু নাম উল্লেখ্য করে মামলা হয় নাই, সেই কারণে ভয়ে ভয়ে সময় পার করছি আমরা গ্রামের সবাই। বাবুর বাবাকে আমি বাড়িতে থাকতে দেই না। বলা যায় না কাকে কখন তুলে নিয়ে মামলায় নাম দেয়।

আরেক বাসিন্দা সুরাইয়া আক্তার বলেন, আমার ছোট তিনটা বাচ্চা আর স্বামী নিয়ে সংসার। মামলা আর গ্রেফতারের ভয়ে স্বামী বাড়িতে থাকছেন না। আমরা বিক্ষিপ্ত ঘটনার দিন ছিলাম না। পারিবারিক কাজে সবাই রংপুরে ছিলাম। এখন মামলা হয়েছে অনেক জনের নামে। এ নিয়ে আমরা অনেক ভয়ের মধ্যে আছি। ছোট ছেলেটা খুব অসুস্থ, চিকিৎসা করানোর জন্য সামান্য টাকাও আমার আর হাতে নাই!

স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল বলেন, আমরা দিনমজুর মানুষ। দিন আনে দিনে খায়। একদিন কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হয়। এখন অনেক জনের নামে অজ্ঞাত নামা মামলা হয়েছে। আমি নিজেই অনেক ভয়ে আছি। কাকে কখন তুলে নিয়ে যায় বলা যায় না। আমরা এর সুষ্ঠু সমাধান চাই।

উল্লেখ্য, ৬৪টি জেলার অভ্যন্তরস্থ ছোট নদী, খাল, জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্পের আওতায় (ক্যাট প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত) ডিমলা উপজেলার বুড়িতিস্তা (পচারহাট) এলাকায় পাউবো নীলফামারী ও স্ট্যান্ডার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে সীমানা নির্ধারণ এবং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নেন। মাঠ জরিপ কাজ শুরুর এক পর্যায়ে স্থানীয় জনগণ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। আর সেই আকস্মিক সংঘর্ষে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি এস্কেভেটর (ভেকু), তিনটি সিক্স সিলিন্ডার মেশিন, দুইটি থ্রি সিলিন্ডার মেশিন ও একটি মোটরসাইকেলে বিক্ষুব্ধ জনগণ আগুন ধরিয়ে দেন। এছাড়া তিনটি মোটরসাইকেল ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি দুই চালা টিনের সেট ঘর ভাংচুর করে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে প্রশাসন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণ করে। সেদিনের সেই ঘটনায় জলঢাকা পওর উপ-বিভাগ-২ এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. একরামুল হক বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করে। দায়েরকৃত মামলায় ৭৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরো পাঁচ থেকে ছয়শত জনকে আসামি করা হয়েছে।

অতীতেও দেখা গেছে, যে কোন ঘটনার মামলায় যখনই অনেক অজ্ঞাত আসামি থাকে, তখনই গ্রেফতার এড়াতে গা ঢাকা দেন সংশ্লিষ্ট এলাকার পুরুষরা। এটি এখন মোটামুটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর কোনও একটি সাধারণ পরিবারের মূল উপার্জনকারী ব্যক্তিকে যখন গ্রেফতার এড়াতে এরকম দিনের পর দিন পালিয়ে বেড়াতে হয়, তখন ওই পরিবারগুলোতে নেমে আসে এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনের তরফ থেকে বারবারই আশ্বাস দেওয়া হয় যে নিরপরাধ কাউকে হয়রানি বা গ্রেপ্তার করা হবে না। কিন্তু কেউ একবার গ্রেফতার হলে তার নিরপরাধ প্রমাণিত হয়ে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়া যে কত কঠিন, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে আন্দাজ করাও কঠিন। বাস্তবতা হলো, অজ্ঞাত আসামি মানেই গ্রেফতার ও আটক বাণিজ্য। অপরাধ করে ১০ জন, তার মাশুল দেয় হাজারো মানুষ।

মামলার বিষয়ে ডিমলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. লাইছুর রহমান বলেন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী একরামুল হক বাদী হয়ে গত বুধবার (২০শে ডিসে/২২) একটি মামলা দায়ের করেছে। মামলায় ৭৯ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরো পাঁচ থেকে ছয়শতাধিক ব্যক্তি রয়েছে। আর আমি বলে দিয়েছি কোন সাধারণ মানুষ এতে হয়রানি হবে না। অতএব কেউ ভয় পাবেন না। শুধুমাত্র দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।