• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৭:০৯ পূর্বাহ্ন

সাংবাদিকরা আজ দলীয় পরিচয়ে পরিচিত!!


প্রকাশের সময় : মার্চ ১১, ২০২৩, ৯:৪৭ পূর্বাহ্ন / ১২২
সাংবাদিকরা আজ দলীয় পরিচয়ে পরিচিত!!

এম রাসেল সরকারঃ সাংবাদিকতা একটি ঝুঁকিপূর্ণ ও মহান পেশা! প্রকৃত অর্থে সাংবাদিকতা আর দশটি পেশার মতো নয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র মতে, সাংবাদিকতা একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশাও। প্রকৃত সাংবাদিকের দায়িত্ব বস্তুনিষ্ঠ ও সততাপূর্ণ সংবাদ পরিবেশন করা। সাংবাদিকতা যেমন এক বিধ্বস্ত জাতিকে পুনর্গঠনে অবদান রাখতে পারে, ঠিক তেমনি সাংবাদিকতার নামে মিথ্যাচারিতা, পক্ষপাতিত্ব, স্বার্থপরতা এক সুসংহত জাতিকে হিংসাত্মক যুদ্ধের দাবানলে অগ্রসর ভূমিকা রাখতে পারে।

গণতান্ত্রিক ও সভ্য সমাজ ব্যবস্থায় সাংবাদিকতা অতটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়; কিন্তু আমাদের দেশের গোটা সমাজ ব্যবস্থাই বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই বিভক্তি কোনো নীতিনৈতিকতা বা আদর্শের ভিত্তিতে নয়, এটা মূলত অন্ধ রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বন। পেশাজীবীরাও আজ বিভক্ত। সাংবাদিকতাও এই বিভক্তির হাত থেকে বাঁচতে পারেনি, যা দুর্ভাগ্যজনক। পেশায় অনৈক্য, সাংবাদিকতা আর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ তথা রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেলা, মিডিয়া মালিকানার আপন ব্যবসায়ীকে স্বার্থের মতো কারণগুলোও সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িছে।

আজ আমাদের সাংবাদিকরা দলীয় পরিচয়ে পরিচিত বহন করেন! কেউ আওয়ামীপন্থী, কেউ বিএনপিপন্থী, কেউ জামায়াতপন্থী, কেউ জাতীয় পার্টিপন্থী আবার কেউ-বা কমিউনিস্টপন্থী সাংবাদিক। এই দলীয় সাংবাদিকতাও সাংবাদিকদের পেশা ও জীবনের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই বলে আমি এটা বলছি না যে, সবাই দলীয় সাংবাদিকতা করছেন, ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিন্তু ব্যতিক্রম উদাহরণ নয়।

সত্য কখনও বিপজ্জনক হতে পারে না। আমি এই দর্শনেই বিশ্বাস করি। আমি আরও মনে করি, যে সত্যান্বেষণই সাংবাদিকতার মহান ব্রত। প্রত্যেক সাংবাদিকই মানবাধিকার কর্মী এটাও আমি বিশ্বাস করি। একজন মানবাধিকার কর্মী মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার তথ্যানুসন্ধান করে রিপোর্ট প্রণয়ন করেন। ঠিক একইভাবে একজন সাংবাদিককেও ঘটনার পেছনে ঘটা সত্যটাকে খুঁজে অনুসন্ধান করে জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তথা মানবাধিকার লঙ্ঘন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু-আদিবাসী নির্যাতন, নারী ও শিশু নির্যাতন, দুর্নীতি-জঙ্গিবাদ ও রাজনৈতিক সন্ত্রাস নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে হবে একজন প্রকৃত সাংবাদিককে।

পৃথিবী বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে তার রাজনীতি, অর্থনীতি আর মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের ধারা। বদলে যাচ্ছে মানুষের চিন্তা-চেতনা, রুচি, বিবেকবোধের দৃষ্টিকোণ আর দীর্ঘদিনের চলমান অভ্যাস। এই পরিবর্তনের সাথে বদলে যাচ্ছে সাংবাদিকতার সনাতনি ধারাও। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার স্থান এখন দখল করেছে করপোরেট সাংবাদিকতা। একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক এই রূপান্তরগুলোকে শুধু দেখেই শেষ করতে পারেন না, সেগুলোকে তার নিবিড় পর্যবেক্ষণেও রাখতে হবে এবং তার নিজস্ব এথিক্সের আলোকে চলার পথ বা সংবাদ লেখার পথ ঠিক করতে হবে।

অনেক ধরনের ঘটনাই ঘটে প্রতিদিন। তবে গুরুত্বের বিচারে সব ঘটনা একই মানের না হওয়ায় সবই সংবাদ হিসেবে প্রকাশিত হয় না। সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ, কিন্তু এদিক থেকে চিন্তা করলে সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ নয়। কারণ সমাজে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাবলীই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় না। একজন সাংবাদিকের নিজস্ব মতামত প্রকাশের জায়গা সংবাদপত্র নয়, ঘটনা যতটুকু ঘটে, ততটুকুই বলবেন একজন সাংবাদিক; এর বেশি নয়। আজকের সাংবাদিকতার জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জও এটাই। জনমত সৃষ্টিতে তাই আজকের সাংবাদিকরা রাখতে পারেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। একটি সাধারণ খবরকে একজন সাংবাদিক এমনভাবে উপস্থাপন করতে পারেন, যাতে তা পাঠক পড়তে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তা পাঠকের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

জনমতের সাথে অনেক বিষয় নির্ভরশীল; যেমন দেশের উন্নয়নগত সিদ্ধান্ত সমাজের মানুষের ভবিষ্যৎ। তাই জনমত গঠনের সময় একজন সাংবাদিককে খুবই সচেতন থাকতে হয়। কারণ একজন সাংবাদিকই পারেন সঠিক এবং উন্নয়নমূলক সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে দেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে। যিনি সাংবাদিক তাকে সংবাদ তৈরি করতে হবে দেশপ্রেমের জায়গা থেকে, জনকল্যাণের জায়গা থেকে এবং তা অবশ্যই সততার সাথে।

একজন সাংবাদিককে চিন্তা করতে হবে জনমতের জায়গা থেকে জনকল্যাণের জায়গা থেকে। আর যথার্থ জনকল্যাণ জনমত গঠনের ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু এমন জনমত গঠনকে কখনই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না, যা দেশকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেবে। তাই এ ব্যাপারে সংবাদপত্রের রিপোর্টার ও সম্পাদকদের সচেতন থাকা দরকার। একটি সৎ সংবাদ প্রকাশ করতে প্রয়োজন জনগণের সাহসী খোলামত ও অভিযোগ।

আগেই বলেছি গণতান্ত্রিক ও সভ্য সমাজ ব্যবস্থায় সাংবাদিকতা অতটা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। কিন্তু যেখানে গণতন্ত্রের অবস্থাই ভঙ্গুর, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার সোনার হরিণ এবং দুর্নীতি ও দলীয়করণ তৎপর, সেখানে সাংবাদিকতার পথ মসৃণ হতে পারে কি? না, কখনও নয়। তবে আশার দিক হলো, গণতন্ত্র যদি সত্যিকারার্থে চর্চা হয়, দেশে আইনের শাসন আপনা-আপনি কার্যকর হবে। আর একটা গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যমও তার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে গণমাধ্যমের ভেতরের যে সঙ্কটগুলো আছে, তা-ও দূরীভূত হবে। কাজেই কী করলে দেশের রাজনীতি সুস্থ ধারায় ফিরবে, দুর্নীতি-দরিদ্রতা হ্রাস পাবে, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার তথা গণতন্ত্র কার্যকর হবে; সেদিকটাতেই আমাদের সবার একযোগে দেশাত্মবোধ বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। না হলে কোনো মানুষেরই জীবন ও পেশা নিরাপদ হবে না। সর্বোপরি বিভাজন আর অসত্য থেকে আমাদের সবাইকে সরে আসতে হবে। এ কাজটি খুবই কঠিন; তবু পরিবর্তনের পথে আমাদের হাঁটতেই হবে।

উল্লেখ্য: স্বাধীনতা আদায় করে নিয়ে আমরা স্বাধীন সাংবাদিকতা করেছি। সাংবাদিকতার ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সাংবাদিকেরা যে স্বাধীনতা ভোগ করেছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন সাংবাদিকতা করেছি। বিভিন্ন সময়েই সাংবাদিকদের ওপর বাধা এসেছে। ১৪ বছর কারাদণ্ড, সামরিক শাসন, স্বৈরাচারী আচরণসহ বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হয়েছে। ঐক্যবদ্ধভাবে তা প্রতিহত করে সাংবাদিকতা করেছি। সাংবাদিকতার পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। আন্দোলনের মাধ্যমে সাংবাদিকেরা অধিকার আদায় করে স্বাধীন সাংবাদিকতা করেছেন। আমরা স্বাধীন সাংবাদিকতা করেছি, করে যাব। ইনশাআল্লাহ্

(লেখকঃ মো: রাসেল সরকার- সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।)