• ঢাকা
  • রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৪৮ পূর্বাহ্ন

সাংঘাতিক ও সাংবাদিকতা


প্রকাশের সময় : জুলাই ২২, ২০২৩, ৫:০৯ অপরাহ্ন / ৩১৯
সাংঘাতিক ও সাংবাদিকতা

এম রাসেল সরকারঃ সাংবাদিক ও সাংঘাতিক দু’টি শব্দই বহুল প্রচলিত। শব্দ দু’টি প্রায় সমউচ্চারিত কিন্তু অর্থ অনেক ভিন্ন। বাংলা অভিধানে ‘সাংবাদিক’ শব্দের বর্ণনায় বলা হয়েছে, সংবাদ সর্ম্পকীয়। সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ বা পেশা করেন যিনি ; সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য সংবাদ সংগ্রাহক। সাংবাদিকের কাজ বা বৃত্তি ইত্যাদি। অপর শব্দ ‘সাংঘাতিক’ সম্পর্কে বলা হয়েছে ভয়ানক; ভীষণ: মারাত্মক। বর্তমান সময়ের পেক্ষাপটে দু’টি শব্দের অর্থ প্রায় সমপর্যায়ে চলে এসেছে।

“হঠাৎ করে এই শহরে এলো যে এক সাংবাদিক,কথায় কথায় তোলে ছবি ভাবখানা তার সাংঘাতিক।তিলকে সে বানায় তাল-তালকে আবার তিল,চড়ুইকে সে পেঁচা বানায় কাককে বানায় চিল।পুলিশ দেখে মুখ লুকিয়ে পালায় দিগ্বিদিক, লোকে বলে লোকটা নাকি ভূয়া সাংবাদিক।”

কোন এক ছড়াকার রসিকতার ছলে ছন্দ দিয়ে ভুয়া সাংবাদিকের মুখোশ উন্মোচন করলেও শেষের লাইন দু’টো এখন বেমানান। “পুলিশ দেখে মুখ লুকিয়ে পালায় দিগ্বিদিক,সবাই বলে লোকটা নাকি ভূয়া সাংবাদিক।” না এখন ভুয়া সাংবাদিকরা পুলিশ-প্রশাসন দেখে মুখ লুকিয়ে পালায় না, বরং পুলিশের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়েই তারা স্বার্থ হাসিল করছে বীরদর্পে। বিভিন্ন সংকটময় মূহুর্তে স্থানীয় প্রশাসন,রাজনৈতিক নেতা, পাতি নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যখন ত্রাণ বা কোন কিছু বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন তখন তারা ছবি তুলতে ও ভিডিও করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে,ফিরিয়ে বিভিন্ন স্টাইলে ছবি তুলেন। যেনো কোন প্রতিযোগিতার ফেটো সেশন। দু’ পাঁচ’শ টাকার বিনিময়ে কতোজনের যে বিতরণের ছবি তুলেন, ভিডিও করেন, তা নিজেও জানে না।

মহা ব্যস্ত এই সাংবাদিকরা এই মৌসুমগুলোতে ভালো টাকাও উপার্জন করেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের অনেকের পোয়া বারো। আসন্ন সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, হুইপ, এমপি বা ওমুক নেতার সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং নির্বাচনী প্রচারণা কার্যক্রমে এইসব বড় বড় সাংবাদিকদের খুঁজছেন ছবি বা ভিডিও করার জন্য।

কিন্তু, ওই ছবি কোন পত্রিকা বা অল লাইনে প্রকাশ কিংবা ভিডিও কোন টিভি চ্যানেলে প্রচার হচ্ছে বা প্রচার হয় কিনা, তা দেখারও সময় নেই, মন্ত্রী,হুইপ,এমপি বা ওমুক নেতার সৌজন্যে ওইসব ব্যাক্তিদের। ছবির নিচে কিছু চমকপ্রদ কথা লিখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়াতেই ছিলো মহা খুশি ওইসব ব্যক্তি ও তাদের চামরা। আবার যারা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তারাও মহা খুশি। তাদের দাপট আর আচরণে এখনো প্রকৃত সাংবাদিকরাই মুখ লুকিয়ে পালায়। নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিতে লজ্জা পায়।

পেশাদার সম্মানিত সাংবাদিকদের জন্য বিষয়টি লজ্জাকর হলেও ছড়া ছন্দের মতই ভূয়া সাংবাদিকরা দেশ জুড়ে বেহাল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে ফেলেছে। সাংবাদিক সেজেগুজে একশ্রেণির প্রতারক অফিস-আদালত,অলি-গলি চষে বেড়াচ্ছেন। পান থেকে চুন খসলেই রীতিমত বাহিনী নিয়ে হামলে পড়ছেন সেখানে। প্রকৃত ঘটনা কি-সে ঘটনার আদৌ কোনো নিউজ ভ্যাল্যু আছে কি না, সেসব ভেবে দেখার ফুসরৎ নেই তাদের। তাদের দরকার নিজেদের প্রতাপ দেখিয়ে, আতংক ছড়িয়ে টুপাইস কামিয়ে নেয়া। উপজেলা পর্যায়ের অনেক সাংবাদিক এখন চার চাকার গাড়ি হাঁকাচ্ছেন। শহরে জায়গা কিনছেন। বহুতল ভবন, দালান করছেন।

অথচ যারা বাড়ি, গাড়ি আর দালানের মালিক হয়েছেন, তাদের সারাদিন-সারা বছর দেখেছি, পুলিশ আর প্রশাসনের তোয়াজগিরি করতে। জনগণের বিপদাপদ ও মামলা-মোকদ্দমায় পক্ষপাতিত্ব বা পুলিশের সাথে খাতিরের সুযোগে দু’এক পয়সা হাতিয়ে নিতে। সরকারি টিআর-কাবিখা, কাবিটার প্রকল্প নিয়ে উদরপূর্তি করতে। সংবাদের নামে অর্থ হাতিয়ে নিতে। জনগুরুত্ব ও নির্যাতিত-নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের সংবাদ অর্থের বিনিময়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে। অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, নদী-পুকুর-খাল খননে পুকুর চুরি, দখলদারিত্ব আর টেন্ডারবাজির সংবাদ না করার বিনিময়ে পারিতোষিক নিতে। তারা পুলিশ আর প্রশাসনের সংবাদ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ঘুর ঘুর করেন নেতা-পাতি নেতাদের পেছন পেছন প্রেসরিলিজ নিয়ে।

নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে মনে হয়, সৎ, নিষ্ঠা, সুসাংবাদিকতা ও অপসাংবাদিকতা-এ নিয়ে শুরু মূল দ্বন্দ্ব। আর এ কারণে বাড়ছে, সাংবাদিক হয়রানী, নির্যাতন,গুম, হত্যার ঘটনা। আমাদের বিবেক দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। সাংবাদিকরাই এখন সাংবাদিকের শক্র। চলছে ল্যাং মারার অসুস্থ-হীন মানসিক প্রতিযোগিতা।

সৎ ও সত্য সংবাদ লিখলে যেন সুবিধাবাদী সাংবাদিকদের আঁতে ঘা লাগে। সত্য লিখলে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনপ্রেমি সাংবাদিকদের সম্মানে আঘাত হানে। রাজনৈতিক নেতা বা প্রশাসনের চেয়ে ওই সাংবাদিকদের যেন বেশি গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়াল। তাদের স্যারেরা যেন গোস্বা হয়ে গেল। তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, ইজারার অর্থ যেন বেহাত হয়ে গেলো। এ জন্যই ভয়ে তটস্থ। সৎ ও সততার সাথে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অসৎ সাংবাদিকদের ল্যাং খাওয়ার ভয়ও তাড়া করে। কারণ সংবাদের চেয়ে অর্থের মোহে নিমজ্জিত থাকেন অসৎ সাংবাদিকরা। কথায় বলে, কাক কখনো ময়ূর হয় না। যতই লিখি না কেন অভ্যেস বদলানো কঠিন তাদের।

নিধিরাম সর্দার (ব্যস্ত সাংবাদিক) সাংবাদিকদের ই-বা দোষ কী। সংবাদ সংগ্রহ ও পাঠানোর যে খরচ পড়ে, তা তো পত্রিকা বা টেলিভিশনওয়ালারা দেন না। কিছু কিছু পত্রিকা ও টেলিভিশন সম্মানীর নামে অসম্মানী ভাতা দিলেও তা একেবারে যৎসামান্য। তা দিয়ে সংসার চলার ভাবনা কল্পনাতীত। সম্মানী ভাতা পাওয়া সাংবাদিকদেরও অপসাংবাদিকতা করতে দেখে লজ্জায় মুখ ঢেকে যায়। পত্রিকা হলে বিজ্ঞান সংগ্রহদাতা হতে হয়। বিজ্ঞাপন না দিলে চাকুরি শেষ। যে বেশি বিজ্ঞাপন দিবে, সেই পত্রিকা মালিকের কাছে প্রকৃত ও ভালো সাংবাদিক।

অবশ্য অসৎ সাংবাদিকদের ওপর দোষ চাপানো যায় না। সমাজের নানা অবস্থান থেকে তারা এ মহান পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। জড়িয়ে পড়েছে টাউটশ্রেণির লোকজনও। দেশে কত পত্রিকা রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কালভাদ্র বের হয়। তথাতথিত অনলাই পত্রিকা ও টেলিভিশনতো আছেই। মফস্বল এলাকায় এরকম পত্রিকা ও টেলিভিশন প্রতিনিধিদের বেশ দাপট। ব্যস্ত সাংবাদিক। পরিচয়পত্র আর টেলিভিশন হলে বুম ( লেগো) ঝুলিযে ছুঁটে চলেন রানার ! তাদের কত নামডাক। কোন ঘটন-অঘটন, এমপি, মিনিষ্টারের সভা-জনসভা এমনকি ইসলামি জলসা ও ঈদ জামাতের ছবি তুলায় তাদের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। আর নির্বাচন হলে তো কথাই নেই। তাদের ধারেকাছে যায় কে।

সাংবাদিক না হয়েও সাংবাদিকতার বেশভূষা তাদের মূল পুঁজি। খ্যাত-অখ্যাত একাধিক গণমাধ্যমের ৪/৫টি আইডি কার্ড বুকে পিঠে ঝুলিয়ে দাপিয়ে বেড়ায় সর্বত্র। যারা পেশাদার সাংবাদিক (সৃযোগ সন্ধানী) তাদের কারো না কারো সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে সাইনবোর্ড হিসেবেও ব্যবহার করেন তারা। সম্ভব হলে সাংবাদিকদের কোনো সংগঠনে নিজের নামটা লিখিয়ে নেয়, তা না হলে নিজেরাই ‘সাংবাদিক’ ‘রিপোর্টার’ ‘প্রেসক্লাব’ শব্দ যোগ করে ভূইফোঁড় কোনো সংগঠন খুলে বসেন। তখন তাদের বুলি থাকে অন্যরকম-“আমি সাংবাদিক কি না সেটা আপনার জানার দরকার নাই, আমি সাংবাদিকদের সেক্রেটারি বা প্রেসিডেন্ট। আমি সাংবাদিক বানাই, আমার স্বাক্ষরে আইডি কার্ড দেই- আমার পরিচয় আলাদাভাবে দেয়ার কি আছে?” ভূয়াদের এতোসব সাংগঠনিক প্রক্রিয়া ও কথিত ক্লাব-ইউনিটি, ফোরাম, সোসাইটি, সংস্থা, সমিতি দাপ্তরিক প্রতারণার ধকলে নানাভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে মহান সাংবাদিকতার পবিত্র পেশাটি।

এরা মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসে ‘প্রেস’ কিংবা ‘সংবাদপত্র’ লিখে পুলিশের সামনে দিয়েই নির্বিঘ্নে দাবড়ে বেড়ায়। এদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও বিভিন্ন যানবাহনও থাকে চোরাই এবং সম্পূর্ণ কাগজপত্রবিহীন। নামের আগে সাংবাদিক, জার্নালিষ্ট লিখা থাকে। এসব ভূয়া সাংবাদিকের নানা অপকর্মের কারণে প্রকৃৃত পেশাদার সাংবাদিকদের ভাবমূর্তি এখন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সাংবাদিকতা সম্বন্ধে যাদের নূন্যতম জ্ঞানও নেই তাদের হাতে মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে আইডি কার্ড। যেনো অনুমতি দিয়ে অপসাংবাদিকতার লাইসেন্স দিয়েছে তাদের। কোনো কাজ নেই, লেখালেখি নেই, অন্যের লেখা ধার করে চলে। নিধিরাম সর্দার (ব্যন্ত সাংবাদিক) সাংবাদিকদের ই-বা দোষ কী। সংবাদ সংগ্রহ ও পাঠানোর যে খরচ পড়ে, তা তো পত্রিকাওয়ালারা দেন না। কিছু কিছু পত্রিকা সম্মানীর নামে অসম্মানী ভাতা দিলেও তা একেবারে যৎসামান্য। তা দিয়ে সংসার চলার ভাবনা কল্পনাতীত। সম্মানী ভাতা পাওয়া সাংবাদিকদেরও অপসাংবাদিকতা করতে দেখে লজ্জায় মুখ ঢেকে যায়।

ভূয়া সাংবাদিকদের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে খোদ পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনের অনেকটা ভুমিকা রয়েছে। কারণ, পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গেই ওইসব ভূয়া ও নামধারী সাংবাদিকদের বেশি সখ্যতা। এরা প্রায়ই স্থানীয় প্রশাসন ও থানার ভিতরে পুলিশ অফিসার ও কেনষ্টবলদের সাথে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডাবাজিতে মত্ত থাকে। কেউ ধরা পড়লে ‘দালাল’ হিসেবে ঘুষ বাণিজ্যে সরাসরি সহায়তা করে, পুলিশের ‘সোর্স’ হিসেবেও তারা বিশ্বস্থ! এদের কি ব্যস্ততা, দম ফেলার ফুসরত নেই। পুলিশ প্রশাসনও তাদের তোয়াজ করে। সাথে নিয়ে চলে ম্যারাথন আড্ডা।

যদিও এর আগে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল এবং পরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার প্রক্রিয়া চলেছে। অযোগ্য অদক্ষ ব্যক্তিরা যাতে সাংবাদিকতা পেশায় আসতে না পারে এ জন্য রেজিষ্ট্রিকৃত সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের তালিকাভুক্ত বা সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে একদিকে সাংবাদিকদের সম্পর্কে একটি পরিসংখ্যন পাওয়া যাবে। অন্যদিকে প্রতিহত করা যাবে ভূঁয়া সাংবাদিকদের। পাশাপাশি রেজিষ্ট্রিবিহীন সংবাদপত্রের মালিকরা সহজেই ধরা পরবে। রেজিষ্ট্রিকৃত সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের নাম তালিকাভূক্ত করার কাজও হয়েছে। স্থানীয় সংগঠনের মাধ্যমে বা ব্যক্তিগতভাবে এর আগে উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এ জন্য তালিকাভুক্ত করা হয় সাংবাদিকদেও নাম। এটি দপ্তরে সংরক্ষণ ও ওয়েব সাইটে প্রকাশ করার কথাও ছিলো সে সময়ে। পরে নিদিষ্ট ফরম বা ছকের মাধ্যমে তথ্য মন্ত্রণালয় সাংবাদিকের তালিকা নিয়েছে। স্থানীয় তথ্য অফিস তা তদারকি করেছেন।

কিন্তু, এতেও চরম অনিয়ম ও শুভংকরের ফাকি যোগ হয়েছে। যে উপজেলার ৫ জন সাংবাদিকও নেই সেই উপজেলা থেকে ২০ থেকে ৩০ জনকে সাংবাদিকদের নাম তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। স্থানীয় সংগঠনের নেতারা নিজের ভাই,স্ত্রী,ভাগিনা,ভাতিজা এমন কি অর্থের বিনিময়ে চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী,দেহব্যবসায়ী,টাউট-বাটপারদের সাংবাদিকের নামের তালিকাভুক্ত করে আগে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়েছেন। পরের দফায় জেলা তথ্য অফিসের মাধ্যমে তথ্য মন্ত্রণালয়েও পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন। এজন্য নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে প্রমান করতে অন্যজনের সাংবাদিকতার পরিচয়পত্র এবং নিয়োগপত্র কম্পিউটার সাইজ এর মাধ্যমে নিজের নামে তৈরী করে ভুয়া পরিচয়পত্র এবং নিয়োগপত্রের ফটোকপি জমাও দিয়েছেন। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল এবং পরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে অনেক ভুয়া সাংবাদিক বৈধ সাংবাদিকের তালিকাভুক্ত হবেন বা সনদ পাবেন। তাদের নামও দপ্তরে সংরক্ষণ ও ওয়েব সাইটে প্রকাশ হবে। এতে কি ভুয়া সাংবাদিক কমবে,না তাদের দৌরাত্ম্য আরো বৃদ্ধি পাবে ?

সাংবাদিকতা এখন ‘হাস্যকর’ পেশা ‘বদনাম’। সাংবাদিকদের অনেকেই ব্যাঙ্গ করে বলেন ‘সাংঘাতিক’। মফস্বল শহরের সাংবাদিকদের শীরিরে তা তকমা হিসেবেই সেঁটে আছে! হেয় করে ‘সাংঘাতিক’ বলে আখ্যা দেয় । ‘সাংঘাতিক’ বলে ডাকে। একজন প্রকৃত সাংবাদিকের ‘সাংঘাতিক’ কথাটি শুনতে নিশ্চয়ই অনেক অপমান বোধ হয়। শুনতে অনেক কষ্ট লাগে। কিন্তু, প্রকৃত কোনো সাংবাদিকই এ কথাটির জোরালো প্রতিবাদ করেন না। কারণ, তারা মনে করেন, এ কথার যুক্তিকতা আছে। তাই তারা হাসি মুখে কষ্ট করে হলেও কথাটি শুনে হজম করে ফেলেন।

সাংবাদিক ও সাংঘাতিক দু’টি শব্দই বহুল প্রচলিত। শব্দ দু’টি প্রায় সমউচ্চারিত কিন্তু অর্থ অনেক ভিন্ন। বাংলা অভিধানে ‘সাংবাদিক’ শব্দের বর্ণনায় বলা হয়েছে, সংবাদ সর্ম্পকীয়। সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ বা পেশা করেন যিনি ; সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য সংবাদ সংগ্রাহক। সাংবাদিকের কাজ বা বৃত্তি ইত্যাদি। অপর শব্দ ‘সাংঘাতিক’ সম্পর্কে বলা হয়েছে ভয়ানক; ভীষণ: মারাত্মক। বর্তমান সময়ের পেক্ষাপটে দু’টি শব্দের অর্থ প্রায় সমপর্যায়ে চলে এসেছে।

একটি শব্দ এমনটি নিজের নামটি সঠিকভাবে লিখতে বা বানান উচ্চারণ করতে না পারলেও অনেকেই এখন সাংবাদিক পারিচয় নেয়। নিজেকে বলেন ডিজিটাল সাংবাদিক। পড়া বা লিখার প্রয়োজন নেই। দেখতে ও বলতে পারলেই সাংবাদিক। তবে, তারা কেউ আবার সাংবাদিক শব্দটিও উচ্চারণ করতে পানের না। বলেন, সম্বাদিক। কেউ বলেন, সাম্বাদিক।

যদিও সাংবাদিকতা পেশা না নেশা এ নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে আনেক আগে থেকেই। যদিও সাংবাদিকতা একটি কাজ বা বৃত্তি। কিন্তু পারিশ্রমিক ছাড়া কোন না করলেও সাংবাদিকতার কাজটি আমরা পারিশ্রমিক ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে করে আসছি। কিছু পত্রিকা ও টেলিভিশন অবশ্য কিছু জেলায় প্রতিনিধিদের এখন পারিশ্রমিক দিচ্ছে। আবার কেউ দিলেও তাও অনিয়মিত। এ কারণে মফস্বলে বৈধ উপায়ে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেয়ার সুজোগ এখনো অনেকটাই হয়ে উঠেনি। তার পরও সাংবাদিকতা আজ অধিকাংশের পেশা। কিছু পেশা আছে একবার ধরলে আর ছাড়া যায় না , তারমধ্যে এই পেশাটি অন্যতম। অলাভজনক কোনকাজ সাধারণত দিনদিন কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু ব্যতিক্রম এ পেশাটি বিস্তার লাভ করছে।

একটি জেলায় বা উপজেলায় কত প্রকার কত জন সাংবাদিক আছে তার হিসাব কেউ রাখে না। পকেটে একটি পরিচয় পত্র থাকলেই তিনি সাংবাদিক বনে যান। কারো পকেটে তিন তেকে পাঁচটি গণমাধ্যমের পরিচয়পত্র রয়েছে। অসংখ্য সাংবাদিকের ভিড়ে এখন আর জনসমক্ষে অনেকেই বলতে চাননা আমি সাংবাদিক। সাংবাদিকের কথা শুনলে সাধারণের মনে দ্বিতীয় শব্দটির কথা মনে পড়ে যায়। আর এই মনে পড়ে যাওয়া যে খুব বেশি অমূলক তা কিন্তু নয়। সাংবাদিক মানেই এখন আতঙ্ক। কিন্তু একটা সময় ছিল, মফস্বলের সাংবাদিকরা সমাজে অত্যন্ত সম্মান পেতেন। এ পেশায় আসতেন শিক্ষিত ও স্বচ্ছল ব্যক্তিরা। এখন শ্রমিক, নৈশ্য প্রহরী, হকার, দালাল, ভুমিদষ্য, চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী, দেহব্যবসায়ী,টাউট,বাটপার কেউ বাকি নেই এ পেশায় পর্দাপনে।

তাছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কিছু কিছু সাংবাদিক নেতার নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে । তারা ক্ষমতাসীন দলের নেতা, স্থানীয় এমপি, মন্ত্রী ও প্রশাসনের দালালি করেন। শুধু তোষামতি নয়, অপরাধীদের পুষ্ট-পোষকতাও করেন তারা। একারণে প্রকৃত সাংবাদিকরা কোনঠাসা। সাংবাদিক পরিচয় না দিয়ে বলেন, আমি খবরের ফেরিওয়ালা।

লেখক :
মো: রাসেল সরকার
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।
Sheikhmdraselbd@gmail.com