• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ০৫:০৫ অপরাহ্ন

বিশ্ব অর্থনীতি মন্দা ও বাংলাদেশ সমাচার


প্রকাশের সময় : মার্চ ২১, ২০২৩, ২:২৬ পূর্বাহ্ন / ৮৬
বিশ্ব অর্থনীতি মন্দা ও বাংলাদেশ সমাচার

আজম পাটোয়ারীঃ সারা বিশ্বে করোনাকালীন সময় উত্তোরনের পর বেশিরভাগ মানুষ ভেবে নিয়েছে পৃথিবী হয়ত আবার তার নিজ অবস্থানে ফিরে যাবে আগের মতো। তবে তারা একবারও ভাবেনি এর পরবর্তি অবস্থা কতটা শোচনীয় হতে পারে। সারা বিশ্বে ঘটতে পারে অন্য কোন মহামারি কিংবা দূর্বিক্ষের মত মানব সভ্যতা ধ্বংসের অতিমারি।

এদিকে আন্তর্জাতিক বহু সংস্থা ভবিষ্যদ্বাণী করছে যে, বিশ্ব অর্থনীতি ভয়াবহ মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ইতিমধ্যেই মন্দাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটি এখনো মন্দা ঘোষণা করেনি।

মার্কিন অর্থনীতি পরপর দুই প্রান্তিকে সংকুচিত হলেই মন্দা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ বছর মার্কিন অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে দুই প্রান্তিকে সংকুচিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির দুই-তৃতীয় অংশ আসে ভোক্তা ব্যয় থেকে। মার্কিন জনগণ তাদের ভোগ্য ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। এরপরও দেশটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মূল্যস্ফীতির প্রতিকারহীন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা কমানোর জন্য অধিকাংশ দেশই নীতি সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্তত ৭৭টি দেশ তাদের নীতি সুদহার বাড়িয়েছে।

প্রচলিত অর্থনৈতিক ধারণা বা সূত্রমতে, নীতি সুদহার বাড়িয়ে দিলে বাজারে মানি সার্কুলেশন কমে যায়। ফলে একসময় মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে। কিন্তু এবার কোনো দেশেই নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী এবং বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশেও এখন ভয়াবহ মূল্যস্ফীতির ছোঁয়া অনুভব করছে। সর্বশেষ তথ্য মোতাবেক, দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ১ শতাংশ অতিক্রম করে গেছে। এটা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি।

অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর গড় মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৮ শতাংশের ওপরে উঠে গেছে। আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে অধিকাংশ দেশই তাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ আশঙ্কাজনভাবে কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে।

আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থাও খুবই খারাপ। ভারতে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমেছে ৭৫০ কোটি মার্কিন ডলার। বর্তমানে ভারতের যে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ আছে তা ২০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রিজার্ভ। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে রুপির তীব্র অবমূল্যায়ন ঠেকানোর জন্য রিজার্ভ থেকে মার্কিন ডলার বাজারে ছেড়ে দেয়।
আরবিআই সম্প্রতি রিজার্ভ থেকে ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বাজারে ছেড়ে দিয়েছে। গত ৮ জুলাই ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৫৮ হাজার ৩০ কোটি মার্কিন ডলার। আর তাই ভারত এ বছর রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পতিত হয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড আবারও নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। ১ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে নীতি সুদহার ১ দশমিক ৭৫ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। যা গত ২৭ বছরের মধ্যে নীতি সুদহার বৃদ্ধির এটাই সর্বোচ্চ রেকর্ড।

এদিকে দেশটির অর্থনীতিবিদগণ মনে করছেন, নীতি সুদহার বৃদ্ধি করেও মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে না। বর্তমানে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের নিচে থাকলেও এ বছর শেষের দিকে তা ১৩ শতাংশ অতিক্রম করে যেতে পারে।

অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ তুরস্কের মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৭৯ দশমিক ৯ শতাংশ, যা গত ২৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছেছে। আগামী দিনে বিশ্ব অর্থনীতিতে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি অনেক দেশের পক্ষেই সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।

বর্তমানে করোনার প্রকোপ ছাড়াও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের সরবারাহ চেইন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলে বিভিন্ন দেশ তাদের উৎপাদিত খাদ্যপণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে পারছে না।

বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে, যারা সামান্যতম খাদ্যপণ্য নিজেরা উৎপাদন করতে পারে না। বিশ্ববাজারে মোট খাদ্যপণ্যের ৩০ শতাংশই রাশিয়া এবং ইউক্রেন জোগান দিয়ে থাকে। কিন্তু এ বছর যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া যে খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে তাও তুলতে পারছে না। এ বছর ইউক্রেনে মোট ৮ কোটি ৬০ লাখ টন খাদ্যপণ্য উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে ৩০ শতাংশ খাদ্যপণ্য মাঠেই থেকে যাবে, যা কোন ভাবেই উত্তোলন করা সম্ভব হবে না।

ইউক্রেনের গম এবং অন্যান্য খাদ্যপণ্যের ওপর মিশর, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ বিশেষভাবে নির্ভরশীল। রাশিয়া জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের জোগান বন্ধ অথবা কমিয়ে দেওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য পরিবহন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্য মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতিও অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বিভিন্ন দেশের খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এতে বলা হয়, মার্চ-জুন সময়ে লেবাননের খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৩৩২ শতাংশ। জিম্বাবুয়েতে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ২২৫ শতাংশ, ভেনেজুয়েলায় ১৫৫ শতাংশ, তুরস্কে ৯৪ শতাংশ, ইরানে ৮৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৮০ শতাংশ এবং আর্জেন্টিনায় ৬৬ শতাংশ। অতিমাত্রায় মূল্যস্ফীতি দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর প্রভাব ফেলছে। খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপণ্য আমদানির জন্য তাদের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে যাচ্ছে দ্রুত। এসব বিপন্নপ্রায় দেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাত উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের অন্তত ৯টি দেশ শ্রীলঙ্কার মতো ঋণখেলাপিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। এর মধ্যে জাম্বিয়ায় ঋণ-জিডিপি অনুপাত হচ্ছে ১০৪ শতাংশ। অন্যান্য দেশের মধ্যে মিশরের ঋণ-জিডিপি অনুপাত হচ্ছে ৯৫ শতাংশ, কঙ্গোর ৮৩ শতাংশ, ঘানার ৮১ শতাংশ, মরক্কোর ৭৬ শতাংশ, রুয়ান্ডার ৭৯ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার ৭৬ শতাংশ এবং কেনিয়ার ৭১ শতাংশ।
এসব দেশ যে কোনো সময় ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়ে দেউলিয়াত্ব বরণ করতে পারে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিই সবচেয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৮৫৭ সাল থেকে ২০০৭-২০০৮ সাল পর্যন্ত অন্তত ৩৪ বার অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পতিত হয়েছে। কিন্তু অতীতের মন্দাগুলো এবারের মতো এতটা উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারেনি। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে যে, ভোক্তারা প্রচুর অর্থ নিয়ে বাজারে গিয়ে তাদের চাহিদাকৃত খাদ্যপণ্য ক্রয় করতে পারবে না। খাদ্য নিয়ে সংঘাতের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সংকটকালীন অবস্থায় ব্যাংকের নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে সূত্র এত দিন ধরে চলে আসছিল, এবার তা ভ্রান্ত বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এই অবস্থায় প্রতিটি দেশকেই আমদানি ব্যয় কমানোর পাশাপাশি রপ্তানি আয় বাড়ানো এবং সম্ভব হলে স্থানীয়ভাবে খাদ্যপণ্য উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটকালীন অবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থা কেমন হতে পারে? বাংলাদেশ কি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে, নাকি বিপর্যস্ত হবে? বাংলাদেশ যদি সম্ভাব্য বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চায় তাহলে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

প্রথমেই আমাদের আমদানি ব্যয় কমানোর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ক্রম হ্রাসমান ধারা প্রতিহত করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় এবং বিলাসজাত পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

দেশে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় ১২টির পরিবর্তে ২৬টি পণ্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্তত ১২৩টি পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে এলসি মার্জিন শতভাগ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। কিন্তু আইএমএফের হিসাব মোতাবেক রিজার্ভের পরিমাণ ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে অর্থনীতিবিদগণ মনে করছেন, বাংলাদেশের ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশের পণ্য চাহিদার ২৩ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক মন্দার সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। আর্থিক মন্দার সময় উন্নত বিশ্বের ভোক্তারা তুলনামূলক কম মূল্যের তৈরি পোশাক ক্রয়ের দিকে ঝুঁকে পড়বে। এই সুযোগে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। জনশক্তি খাতের রেমিট্যান্স প্রবাহ সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে অনেকটাই কমে গেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে মার্কিন ডলারের ব্যাংক রেট ও কার্ব মার্কেট রেটের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য।

অর্থনীতিবিদগণ মনে করছেন, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার মার্কেটের ওপর ছেড়ে দিলেই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। ব্যাংক রেট এবং কার্ব মার্কেট রেটের মধ্যে মূল্যের পার্থক্য খুব একটা বেশি না হলেই প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণ করবে। এ ছাড়া ব্যাংক ঋণের আপরি ক্যাপ তুলে দিতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মৌল বেশ শক্তিশালী। কাজেই মন্দা বা কোনো দৈবদুর্বিপাকে অর্থনীতি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। তবে সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই।

তাই দেশের সরকার ও জনগনের উচিত সকল ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকা এবং প্রয়োজন ছাড়া সকল ব্যয় বন্ধ করে দেয়া, যাতে করে অর্থনৈতিক চাপ সামাল দেয়া কিছুটা হলেও সহজবোধ্য হয়।
অন্যদিকে প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাপক প্রচারনা চালানো যাতে করে তারা বৈধভাবে দেশে টাকা প্রেরন করে।
এছাড়া অন্যান্য দিকগুলো সরকারকে দায়িত্বশীল ও যত্ন সহকারে খেয়াল রাখতে হবে।

(লেখকঃ আজম পাটোয়ারী।)