মো: রাসেল সরকারঃ রাজধানীসহ দেশজুড়ে সাংবাদিকদের ওপর অব্যাহত ও বর্বরোচিত হামলা ও নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। সংবাদপত্র রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হলে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকদেরকে নানা হামলা, নির্যাতন ও হয়রানীর স্বীকার হতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলো গনমাধ্যমের জন্য চরম অশনিসংকেত বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।
প্রসঙ্গে: সাভারে কর্মরত প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে তাঁর বাসা থেকে আজ বুধবার ভোর চারটার দিকে সিআইডির পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে। সিআইডির পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিরা সাধারণ পোশাকে ছিলেন। সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বাসা সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে আমবাগান এলাকায়। তবে স্থানীয় পুলিশ ও সিআইডির ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা এ বিষয়ে কিছু জানেন না।
স্থানীয় এক সাংবাদিকসহ দুজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বুধবার ভোর ৪টার দিকে ৩টি গাড়িতে প্রায় ১৪–১৫ জন শামসুজ্জামানের বাসার সামনে যান। তাঁদের সাত থেকে আটজন বাসায় ঢোকেন। একজন শামসুজ্জামানের থাকার কক্ষ তল্লাশি করে তাঁর ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ, দুটি মুঠোফোন ও একটি পোর্টেবল হার্ডডিস্ক নিয়ে যান। ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর ওই ব্যক্তিরা শামসুজ্জামানকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় যান।
প্রত্যক্ষদর্শী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, বটতলার নুরজাহান হোটেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন, একজন নিরাপত্তাপ্রহরী,শামসুজ্জামানসহ তাঁকে আটককারীরা সাহ্রি খান।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় ওই সাংবাদিক বলেন, ভোর পৌনে ৫টার দিকে শামসুজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে আবার তাঁর বাসায় যান সিআইডি পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিরা। দ্বিতীয়বার বাসায় যাওয়ার সময় আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাজু মণ্ডলকে দেখা গেছে। দ্বিতীয়বার বাসায় এসে তাঁরা জব্দ করা মালামালের তালিকা করেন।
শামসুজ্জামানকে জামাকাপড় নিতে বলেন। কক্ষের মধ্যে দাঁড় করিয়ে তাঁর ছবি তোলা হয়। পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে আবার তাঁরা বের হয়ে যান। বাসা তল্লাশির সময় দুবারই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন উপস্থিত ছিলেন।
তুলে নেওয়ার সময় ওই বাড়ির মালিককে ডাকেন সিআইডি পরিচয়ধারী ব্যক্তিরা। তাঁরা বাড়ির মালিককে বলেন, শামসুজ্জামানের করা একটি প্রতিবেদনের বিষয়ে রাষ্ট্রের আপত্তি আছে। তাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে নেওয়া হচ্ছে। এ ঘটনাগুলির তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের পাশাপাশি পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা।
পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী যখন যার অপকর্ম, দুর্নীতির খবর প্রকাশ পায় তখন তারাই সাংবাদিকদের ওপর এসব ন্যাককার জনক হামলা চালায়। এসব হামলায় কখনও কখনও সাংবাদিকদের প্রাণ দিতে হয়। সাংবাদিকদের ওপর অযাচিত আক্রমণ, সহিংস ঘটনার বিচারিক তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে নির্যাতনের ঘটনা কমছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নে সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা—এ কথা আজ নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। উদ্ভব ও বিকাশের পটভূমিতে সাংবাদিকতা আজ সত্য, ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার অবিরাম প্রয়াস। এই প্রয়াসের মূল চালিকাশক্তি একজন সাংবাদিকের নিজ পেশার প্রতি আপসহীন নীতি, দায়িত্ববোধ ও সাহস। সাংবাদিকদের এই সাহসিকতা রোধে সুবিধাবাদী গোষ্ঠী বরাবরই সাংবাদিক সমাজে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করতে চায়। তা করা হয় হুমকি, হত্যা, জেলে পুরে, মামলা দিয়ে কিংবা সাংবাদিকদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে।
আমরা যারা এই পেশার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে যুক্ত, কেবল তারাই ভালো জানি, সাংবাদিক নির্যাতনের এই বহুমাত্রিক পথ আমাদের এই ঘুণে ধরা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় দিনকে দিন কতটা প্রসারিত হচ্ছে। এর পেছনে মূলত দায়ী জাতীয় কিংবা স্থানীয় রাজনীতির ক্ষমতার নষ্ট বলয়ে বেড়ে ওঠা কায়েমি স্বার্থবাদী মহল, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন, রাজনৈতিক দলের সমর্থক ও বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী। যাদের মূল কাজ অন্যের বা সরকারি সম্পদ জবরদখল বা দখল করতে সহায়তা করা এবং অবৈধ ব্যবসা, ঘুষ, তদবির ও অন্যায় পথে বাধা সৃষ্টিকারীদের ওপর নির্যাতন, গুম ও খুন।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা। সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের অনিয়মের বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করতে গেলে পড়তে হচ্ছে প্রতিবন্ধকতার মুখে। শিকার হতে হচ্ছে নির্যাতনের। সাংবাদিকদের ওপর এমন নির্যাতনের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলছে!
বস্তুনিষ্ঠ সত্য কোন সংবাদ প্রকাশ হলেই তাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। যেটা কোনো সভ্য দেশের মানুষ আশা করে না। বিগত দিনে আমাদের দেশে যে সমস্ত সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের বিচার না হওয়ায় সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানি ও আক্রমণের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। অপরাধীরা একজোট হয়ে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হচ্ছে। অপরাধী চক্রের মতো যেন পিছিয়ে নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। নির্যাতনকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্ব যাদের হাতে সেই পুলিশই এখন একের পর এক সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপ্রতি দেশের পুলিশকে জনবান্ধব হওয়ার জন্য বললেও সেখানে হচ্ছে তার উল্টো। যে দেশে জাতির বিবেক সাংবাদিক সমাজ পুলিশের নির্যাতনের শিকার হতে হয় সে দেশে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী!
সাংবাদিক হত্যার বিচার এবং হয়রানি-নির্যাতনের ঘটনার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ না হওয়ায় এ সব ঘটনা বেড়ে গেছে। দ্বিধাবিভক্তি দূর করে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে না পারলে এ সব ঘটনা প্রতিরোধ করা যাবে না। সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের পাশাপাশি একটি কার্যকর সুরক্ষা কৌশল ও নীতিমালাও জরুরি। বিচারহীনতার কারণে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশ, সন্ত্রাসী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা নির্যাতন এবং হয়রানি করছে। হত্যাকাণ্ডসহ সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতনের ঘটনার সঠিক বিচার হলে এসব ঘটনা মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছাতো না।
দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের নির্যাতনে পুলিশের ভেতরে পেশাদারিত্বের অভাব দেখা দিয়েছে। সেইসঙ্গে পুলিশের শৃঙ্খলাও ভেঙে গেছে। তারা সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অপরাধের কথা তুলে ধরায় এখন সাংবাদিকদের নির্যাতন করছে। মিথ্যা মামলায় হয়রানি করছে। রাজনৈতিক নেতা ও অপরাধীদের পাশাপাশি পুলিশের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের নির্যাতন ও হয়রানি করা হচ্ছে। সাংবাদিক সংগঠনগুলো ও সাংবাদিক নেতাদের পক্ষ থেকে এ সব ঘটনার জোরালো কোনো প্রতিবাদ ও পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় দিন দিন নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা বাড়ছে।
অনেক সময় সাংবাদিক নেতারাও এ সব ঘটনার বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিবাদ করছেন না। প্রতিবাদ করলে ভিন্নমতের সাংবাদিক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবেন এ আশঙ্কায় অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিক নেতারাও গণমাধ্যমে মন্তব্য করতেও বিব্রতবোধ করছেন। সাংবাদিকদের হত্যা নির্যাতন প্রতিরোধসহ সব অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের সকল সাংবাদিক সমাজকে একত্রে আন্দোলন করতে হবে।
কোন দলীয় অবস্থানে থেকে কখনো সকল সাংবাদিকের স্বার্থ রক্ষা করা যাবে না। সাংবাদিকদের রাজনীতি করতে বাধা নেই। দায়িত্ব পালনকালে মহান পেশার কথা মনে রেখে দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করতে হবে। দেশের সকল মানুষের মধ্যে দলীয় আদর্শ থাকতে পারে কিন্তু সেটা যদি দলীয় আনুগত্যে পরিণত হয় তাহলে অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব হবে না। ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের মাত্রাও কমবে না।
নিজেদের কথা চিন্তা করে দেশের সকল সাংবাদিক একত্র হয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে একদিকে যেমন নির্যাতনের ঘটনা কমবে, তেমনি সাংবাদিকদের কর্মপরিবেশও ফিরে আসবে।
পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ীসহ যখন যার অপকর্ম ও দুর্নীতির খবর পত্রিকায় ও টিভি চ্যানেলে প্রকাশ পায় তারাই তখন সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়। মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করে। বিগত দিনে আমাদের দেশে অনেক সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, কিন্তু অধিকাংশেরই বিচার হয়নি।
এ বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা কমছে না। সাংবাদিকের কাজ অপরাধ ও দুর্নীতির খবর প্রকাশ করা। সাংবাদিক পেটানো পুলিশের কাজ নয়। সাংবাদিকরা যদি অন্যায় করে দেশীয় আইনে তাদের বিচার হবে। বিচার করার দায়িত্ব আদালতের, পুলিশের না।
(লেখক: মো: রাসেল সরকার,সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী।)
আপনার মতামত লিখুন :