• ঢাকা
  • রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:০৯ পূর্বাহ্ন

খুলনার বড় বাজার চরম অগ্নিঝুঁকিতে


প্রকাশের সময় : অক্টোবর ১৬, ২০২২, ১২:২৬ অপরাহ্ন / ৯৯
খুলনার বড় বাজার চরম অগ্নিঝুঁকিতে

মোস্তাইন বীন ইদ্রিস (চঞ্চল),খুলনা : প্রায় দুইশ বছরের প্রাচীন খুলনা মহানগরীর বড় বাজার। ভৈরব নদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক কেন্দ্র এটি। নামে ‘বড় বাজার’ হলেও সংকীর্ণ জায়গার মধ্যে গড়ে উঠেছে বাজারটি।বাজারের এমন অনেক স্থান রয়েছে যেখানে দিনের আলোও পৌঁছাতে পারে না। এমন অনেক পথ রয়েছে, যেখানে একজন হাঁটলে আরেকজন যাতায়াতের জায়গা থাকে না। ফলে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বৈদ্যুতিক বাতিই এখানকার ব্যবসায়ীদের একমাত্র ভরসা। সে কারণে এখানে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন তারা। কারণ বাজারের ভেতরে নেই পানির কোনো উৎস। যাতায়াতের পথও নেই। ফলে বাজারটি এখন চরম অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনা মহকুমা প্রতিষ্ঠার পর ১৮৮০ ও ১৮৮৪ সালে স্টিমার, রেলস্টেশন ও পৌরসভা চালু হলে ভৈরব নদের পাড়ে বড় বাজার হয়ে ওঠে জমজমাট। সেই থেকে বাজারটি আজও চালু রয়েছে। খুলনার প্রায় সব এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও বড় বাজারের তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি।

খুলনার বড় বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারের ভেতরে প্রবেশ করা ভৈরব স্ট্যান্ড রোড, কেডি ঘোষ রোড, ক্লে রোড, স্টেশন রোডসহ সবগুলো সড়কই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দখলে। এর মধ্যে দিয়েই চলাচল করছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ঠেলাগাড়ি, রিকশা, ইজিবাইক। যানজট যেখানে নিত্যকার ঘটনা। এরই মধ্যে চলছে চাল, ডাল, তেল, কেমিক্যাল, পেট্রল, ডিজেল, মবিল, সার, সিমেন্ট, রড, পোশাক, ফল, গহনা, প্রসাধনী, মসলা, লৌহজাত দ্রব্য, বিভিন্ন যন্ত্রাংশসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর বেচাকেনা।

বড় বাজারের ব্যবসায়ী মাসুদ রানা, বিধান সাহা, শংকর কুমার, মনির আহমেদ ও আনোয়ার হোসেন বলেন, খুলনার বড় বাজার বেশ কয়েকটি বাজারের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। একেক ভাগে একেক ধরনের সামগ্রী বিক্রি হয় এখানে। কিন্তু অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে ওঠা বাজারের মধ্যে যাতায়াতের তেমন কোনো পথ নেই।

তারা বলেন, কিছু কিছু গলি রয়েছে যেখান দিয়েই মূল বাজারে প্রবেশ করতে হয়। এই গলিগুলো এতটাই সরু যে একজনের বেশি একসঙ্গে হাঁটা যায় না। একজন কুলি যদি মাথায় করে কোনো পণ্য আনা-নেওয়া করে তাহলে বাজারে আসা ক্রেতাদের সঙ্গে তাদের প্রতিনিয়ত ঠেলাঠেলি হয়। অনেক সময় তা মারামারিতে রূপ নেয়।

বাজারের চাল ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, মহেন্দ্র দাসের মোড় থেকে চালের দোকান ও আড়ত শুরু। সড়কটির অর্ধেকের বেশি জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে মসলার ব্যবসা। ফলে চালের গাড়ি সরাসরি এখানে আসতে পারে না। শুধু তাই নয়, ৩০-৩৫ ফুটের এই সড়কটি এখন কমতে কমতে হয়েছে ৫-৬ ফুট। বাকিটা দখলে চলে গেছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের। এই রাস্তায় এখন দুটি ভ্যান ক্রস করতে পারে না। বড় কোনো গাড়ি প্রবেশের প্রশ্নই আসে না।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দোকানগুলোতে দিনের আলো মোটেও প্রবেশ করে না। বৈদ্যুতিক বাতিই একমাত্র আলোর উৎস। কিন্তু এই বিদ্যুতই তাদের জন্য মাঝে মধ্যে কাল হয়ে দেখা দেয়।

এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের চরম আতঙ্কের কারণ ‘শর্টসার্কিট’। ব্যবসায়ী শংকর কুমার, মনির আহমেদ ও আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘শর্টসার্কিট হলেই সব শেষ হয়ে যাবে। কারণ একেকটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকার পণ্য রয়েছে। গুদাম গুলোতে শতকোটি টাকার পণ্যও রয়েছে। ফলে আামদের সবসময় অতিমাত্রায় সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে হয়। ক্ষতি করলে আগুনই আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করবে।

এ বিষয়ে খুলনা সিটি করপোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শামসুজ্জামান মিয়া স্বপন বলেন, দক্ষিণ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই বাজারে তিন হাজারের বেশি ব্যবসায়ী রয়েছেন। ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসেন এখানে। সেইসঙ্গে আসে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো অনেক ব্যবসায়ী তার প্রতিষ্ঠানের সামনের সরকারি জায়গা অথবা রাস্তা দখল করেই তাদের পণ্য বেচাকেনা করছেন।

তিনি বলেন, আমরা বহুবার বলেও তাদেরকে সচেতন করতে পারিনি। উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয় দুদিন পরপর। অভিযান শেষে আবার তারা ফুটপাত ও সড়ক দখল করে বসে পড়ে।

খুলনায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন খুলনা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি কাজী আমিনুল হক বলেন, ফুটপাতের দোকান উচ্ছেদের দাবি আমরা অনেক আগে থেকেই সিটি করপোরেশনের কাছে জানিয়ে আসছি। কিন্তু কোনো কাজ হয় না।

তিনি বলেন, যেহেতু বড় বাজার হলো সবকিছুর জন্য, তাই এখানে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান প্রবেশ করে মালামাল আনা-নেওয়ার জন্য। কিন্তু যদি কোনো আইন হয় যে, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান সময়মতো প্রবেশ করবে, তাহলে ব্যবসায়ীরা তা মেনে নেবেন।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স খুলনার উপ-পরিচালক সালেহ উদ্দিন বলেন, গত ৫ অক্টোবর বড় বাজারে যে আগুন লাগে তা নেভাতে দেরি হওয়ায় আমাদের দোষ নেই। ক্লে রোডে ফায়ারের গাড়ি ঢুকতে খুব বেগ পেতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাস্তা এত সরু যে আমাদের ছোট গাড়িও আগুনের স্থানে যেতে পারেনি।

তিনি বলেন, অনেক আগে এই বাজার গড়ে উঠেছে। প্রতিটি দোকানে লাখ লাখ টাকার মালামাল রয়েছে। দোকানগুলোতে নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। ভূমিকম্প হলেও এখানে অনেক ক্ষতি হবে। বিদ্যুতের লাইনেও এখানে ঝামেলা আছে। বেশিরভাগ দোকানে নিরাপদভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয় না।

ফায়ার সার্ভিসের এ উপ-পরিচালক আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা নদীর ওপর নির্ভর করেন। কিন্তু নদীতে এখন পানি অনেক কম। মটর দিয়ে পানি তোলা খুবই কঠিন কাজ। সে কারণে আমরা পরামর্শ দিয়েছি বাজারের মধ্যে দুই লাখ গ্যালনের একটা রিজার্ভার করে সেখানে আপতকালীন সময়ের জন্য পানি রাখা হোক। তাছাড়া এখানে একাধিক হাইড্রেন্টও দরকার।

জানতে চাইলে খুলনার ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আব্দুল্লাহ পিইঞ্জ বলেন, বড় বাজার এলাকায় হাইড্রেন্ট স্থাপনের জন্য আমাদের পরিকল্পনায় রয়েছে। কিন্তু হাইড্রেন্টের মূল পাম্পটি বাইরে থেকে কিনতে হবে। যদি কেউ এই বিষয়ে সহযোগিতা করেন তাহলে আমরা আমাদের পাইপ ও পানির ব্যবস্থা করে দেবো।