• ঢাকা
  • রবিবার, ২৩ Jun ২০২৪, ০৯:০২ পূর্বাহ্ন

রাজধানীতে ভাড়াটিয়াদের কোরবানির পশু রাখার জায়গা খুঁজতে গিয়ে হয়রানি!


প্রকাশের সময় : জুন ১৫, ২০২৪, ১২:৪৯ অপরাহ্ন / ১১
রাজধানীতে ভাড়াটিয়াদের কোরবানির পশু রাখার জায়গা খুঁজতে গিয়ে হয়রানি!

এম রাসেল সরকারঃ কোরবানির ঈদ এলেই কেনা পশু রাখা নিয়ে স্থানের সংকটে পড়েন ভাড়াটিয়ারা, খলিল মাহমুদ নিজের বাসা নেই, থাকেন ভাড়া বাসায়। ভবনের বেশিরভাগ ফ্ল্যাটে থাকেন মালিকরা। তাদের কেনা পশু রাখা হয় পার্কিংয়ের জায়গায়। ভাড়াটিয়াদের গরু বা ছাগল রাখার সুযোগ হয় না সেখানে।

বাসাটি একেবারেই রাস্তা ঘেঁষা, তাই ফুটপাতে রাখারও সুযোগ নেই। গত বছরে অনেক ঝামেলার পরে এক আত্মীয়র বাড়িতে গরু রেখেছিলেন খলিল। তাই ভোগান্তি এড়াতে এবার ঢাকায় কোরবানি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

খলিল মাহমুদ বলেন, ভোগান্তি ভালো লাগে না, তাই এবার দেশের বাড়িতেই কোরবানি দেব।

ধানমন্ডির মধুবাজারের বাসিন্দা আবুল হাসনাতের সমস্যাও একই রকম। তিনি বলেন, গরু কেনার পর তা রাখা ও কোরবানি দেওয়া নিয়ে খুব সমস্যায় পড়ি। বাসার নিচে জায়গা নেই আর সামনেই রাস্তা। বাড়ির বাইরে গরু রাখলে আবার একজন দেখভালের লোক রাখতে হয়। গরু চুরি হয় কি না সে ভয়েও থাকি। গত বছরে রাস্তার পাশে রাখায় রিকশার ধাক্কায় গরুটা ব্যথা পেয়েছিল।

অনেক বাড়িওয়ালাও পশু কেনার পর তা রাখার স্থানের সংকটে পড়েন। ফলে অনেকেই বাড়ির বারান্দা ও ছাদে রাখেন পশু। “বাড়ির নিচে পার্কিংয়ের জায়গা থাকলেও সেখানে গাড়ি রাখতে হয়। তাই কয়েকটি পশু একসঙ্গে রাখার জায়গা হয় না”, বললেন ধানমন্ডি এলাকার বাড়ি মালিক ফৌওজিয়া আক্তার।

বৃহস্পতিবার হাট শুরু হলেও এদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে বেশিরভাগ বাসা বাড়িতেই কেনা হয়নি কোরবানির গরু। কারণ হিসেবে পশু রাখার স্থানের সংকট ও দেখভাল করার মানুষের অভাবের কথাই উঠে এসেছে।

রাজধানীর এক ফ্ল্যাট মালিক দেড় লাখ টাকায় গরু কিনেছেন কোরবানির ৪ দিন আগে। গরুটি বাড়ির ভেতরে রাখার মত স্থান খালি নেই। তাই গেটের মুখেই বাঁধা হয়েছে। এমডি ফাহিম নামে এক তরুণ বলেন, “পার্কিংয়ে জায়গা নেই। দুই ফ্ল্যাটের মালিক আরো দুটো গরু কিনবেন। তাদের দুটো গরু ভেতরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গাড়ি বের হওয়া ও মানুষের চলাচলের পথে রাখার কারণে সমস্যা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আর জায়গা কোথায়? ঢাকা শহরের বাসা বাড়ি তো সব এমনই, চারপাশে কোনো জায়গা নেই। তাই গরুর দেখভাল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর কোরবানি সবই এখানে হবে।”

বাঁশবাড়ি এলাকায় ফুটপাতের উপরেই স্থান হয়েছে দুটি গরুর। ওই বাড়ির দারোয়ান দেলোয়ার বললেন, আরো ৪ দিন আগে মালিকে গরু কেনছে। কিন্তু ভিতরে জায়গা নাই, হেইয়ার লাইগ্যা রাস্তার মধ্যে রাখছে। পাশের বাড়ির গরুটাও আমি দেইখ্যা রাহি। হেগো জায়গাও নাই, লোকও নাই। রাইতের বেলায় চুরি হওইন্নার ডরে গেইটের মধ্যে রাহি।

শেখেরটেক ১০ নম্বর রোডে এক বাড়ির মালিক তিনটি গরু কিনে বাসার সামনের রাস্তাতেই রেখেছেন। বাড়ির মালিক মাসুম মালেক বলেন, এই রাস্তায় গাড়ি তেমন চলে না তাই খুব সমস্যা হয় না। তবে একজন লোক রাখা হয়েছে সে ২৪ ঘণ্টাই গরুগুলোকে খাবার দেয় আর জায়গাটা পরিষ্কার করে।

শেখেরটেক ১২ নম্বরের গোলচত্বরের পাশেই রাস্তায় একটি গরু বেঁধে রাখা দেখা গেল। সেটার দেখভাল করার কাউকে দেখা যায়নি। পাশের এক দোকানি শঙ্কা প্রকাশ করলেন, যে কোনো সময় রিকশা বা গাড়ির ধাক্কায় পশুটি আঘাত পেতে পারে। এভাবে অনেকেই রাস্তায় গরু রাখে, তাতে যানজটও হয়।

খামার থেকে কিনলে মিলবে সুবিধাঃ হাটে গিয়ে গরু দেখে, দামদর করে কেনা পুরনো রেওয়াজ। তবে গত কয়েক বছরে হাটের পাশাপাশি কোরবানির ঈদে পশুর চাহিদা পূরণ করতে রাজধানীতে গড়ে উঠেছে অনেক খামার। কোরবানির কয়েক মাস আগে থেকেই খামারিরা তাদের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। তাই যারা হাটে যাওয়া সময় সুযোগ করে উঠতে পারেন না, তা খামার ঘুরে কোরবানির পশু কেনাকাটা করেন। ঈদের দিন বা আগের দিন গরু পাঠানো হয় ক্রেতার বাসায়। তবে বাইরের গরু রাখার ব্যবস্থা নেই।

শাহাদাত অ্যাগ্রো ম্যাক্স রেঞ্জ ফার্মের মালিক শাহাদাত হোসেন বলেন, আমাদের ফার্মে তিন মাস আগ থেকেই বুকিং চালু হয়েছে। ঈদের আগের দিন রাত পর্যন্ত আমরা ক্রেতার বাড়ি পর্যন্ত গরু পৌঁছে দিই। কিন্তু গরু ইজারা রাখার কোনো ব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু হয়নি। এছাড়া এমন ব্যবস্থার জন্য অনেক বড় জায়গা দরকার, সেটাতো খামার মালিকদের নেই।

হাতিরঝিল এলাকার বাসিন্দা মোস্তাফিজ মামুন মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকার একটি খামার থেকে ৯২ হাজার টাকায় গরু কিনেছেন ঈদের অন্তত ১০ দিন আগেই। চুক্তি অনুযায়ী এই কয়দিন গরুর খাওয়া, যত্নআত্তি এবং ঈদের আগের দিন গরু পৌঁছে দেওয়ার খরচও সেই খামারি বহন করবেন।

মামুন বলেন, হাট থেকে গরু কিনলে হয়ত দাম কিছুটা কম হত। তবে এই সুবিধা পাওয়া যেত না। আবার খামার থেকে কেনার কারণে হাসিল লাগেনি। গরু নিয়ে আসার জন্য গাড়িও ভাড়া করতে হয়নি।” যারা গরু কেনেন, তাদের একাংশ নিজেদের কাছেই গরু রাখতে বেশি আগ্রহী। কারণ, এর সঙ্গে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও পুরনো রেওয়াজ জড়িত। পশুগুলোকে খাইয়ে দাইয়ে যত্নআত্তি করেন তারা। বাড়ির ছোট ছেলে মেয়েরা পশু দেখে আনন্দও পায়।

সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনাই কি সমাধান?

বছরে একবার কোরবানি আসে বলে অনেকেই পশু রাখার স্থানের সংকট নিয়ে তেমন ভাবেন না। তবে একটি পরিকল্পিত শহরে সব কিছুরই নিয়ম নীতি থাকা জরুরি বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান। পশু রাখার সংকটের ভালো সমাধান হিসেবে তিনি বহুমূখী সমাজভিত্তিক ব্যবস্থাপনার কথা বলেছেন। তার মতে, এলাকায় এমন কয়েকটি স্থান থাকলে সংকট অনেকটাই কমত, যা দুর্যোগ বা অন্য প্রয়োজনে ব্যবহার করা যেত।

আদিল বলেন, এমন পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ কখনোই গ্রহণ করেনি। সে কারণে মানুষ এই সংকটের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে বা খাপ খাইয়ে নিয়েছে।” অবশ্য এই ধরনের ব্যবস্থাপনা মানুষ গ্রহণ করবে কি না, সেই প্রশ্নও আছে। বেশ কয়েক বছর আগে নির্দিষ্ট স্থানে পশু কোরবানি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। বেশ কিছু এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে জবাই, মাংস কাটাকাটি এমনকি সেই মাংস নিজেরাই পরিবহন করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই উদ্যোগ জনপ্রিয় হয়নি। এরপর পিছু হটে সিটি করপোরেশন।

আদিল মুহাম্মদ বলছেন, যেহেতু পূর্বপরিকল্পনা নেই, তাই কোরবানির পশু রাখার সমস্যার তৎক্ষণাৎ সমাধানও কঠিন। তার মতে, “রাস্তায় গরু রাখলেও ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সিটি করপোরেশনকে নির্দেশনা তৈরি ও মনিটরিং করতে হবে।” এলাকাভেদে সরকারি উদ্যোগে অস্থায়ী খাটাল তৈরি করার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। তবে প্রচার-প্রচারণা ছাড়া এই উদ্যোগ নিলে নির্ধারিত স্থানে কোরবানি দেওয়ার উদ্যোগের মতই বিফলে যাবে কি না, সেই ভয়ও আছে তার।