• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩৮ অপরাহ্ন

দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে লিভ টুগেদার : ঢাকায় লিভ টুগেদার গ্রুপ, সদস্য হাজার ছাড়িয়েছে


প্রকাশের সময় : জুন ৯, ২০২৩, ৮:৪৬ পূর্বাহ্ন / ১৫৮
দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে লিভ টুগেদার : ঢাকায় লিভ টুগেদার গ্রুপ, সদস্য হাজার ছাড়িয়েছে

বিশেষ প্রতিবেদক, ঢাকাঃ লিভ টুগেদার। দু’টি মন এক হলেই যার শুরু। তবে গোপনে চলে কার্যক্রম। দীর্ঘদিন ধরে লিভ টুগেদার চলে এলেও বর্তমান সময়ে তাদের একটি গ্রুপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়। এক হাজারের বেশি সদস্য রয়েছে ওই গ্রুপে। সবাই একই মন-মানসিকতা ও চিন্তাধারার। এই গ্রুপে সদস্য যোগ করার ক্ষেত্রে যাচাই করে নেয়া হয়। গ্রুপের সদস্যদের বেশিরভাগই ঢাকার ধানমণ্ডি, গুলশান, নিকেতন, বনানী, বারিধারায় থাকেন। এসব এলাকায় বাসা ভাড়া সহজেই পাওয়া যায়। বাড়ির মালিক বা কেয়ার টেকার বেশি ঝক্কি-ঝামেলা করেন না। এর বাইরে মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায়ও অনেকে আছেন।

তপু। প্রগতিশীল পরিবারে জন্ম। মা-বাবা দু’জনই শিক্ষকতা করেন। ছোটবেলা থেকেই সামাজিক নিয়মনীতির বাইরে তার চলাফেরা। তপু বলেন, যেভাবে চললে নিজের কাছে ভালো লাগবে সেটাকেই প্রাধান্য দিই বেশি। লিভ টুগেদার করি অনেক দিন। এটা আমার কাছে একটা স্বাভাবিক বিষয়। যার সঙ্গে থাকি সেও এটাতে অভ্যস্ত। আমাদের মধ্যে বন্ধনটা চমৎকার। দু’জন-দু’জনের খেয়াল রাখি। আমরা ভালো বন্ধু, ভালো প্রেমিক। সুখ দুঃখ গুলো নিজেদের মতোই ভাগাভাগি করে নিই। তার মানে এই নয় যে, আমাদের লাইফ স্টাইল খুব বেপরোয়া। ৫ বছর ধরে লিভ টুগেদার করছেন তপু। তার সঙ্গী তনয়া। তপু একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করেছেন। এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। আর তনয়া একটি স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে চাকরি করছেন।

এ প্রতিবেদককে তপু বলেন, তখন আমরা দু’জনেই গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। সময়টা ২০১৩ সাল। সবেমাত্র ফেসবুক ও অনলাইন ব্যবহার শুরু করেছি। ফেসবুক এতোটা ভালো ব্যবহার না করলেও ব্লগে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতাম। আমার লেখা পড়তো তনয়া। লেখালেখির মধ্যে দিয়ে তনয়ার সঙ্গে পরিচয়। তারপর নিয়মিত কথা হতো। দু’জন-দু’জনকে বুঝতে শুরু করি। মনের মিল থাকায় সম্পর্ক গভীর হয়। আমি ঢাকায় এসে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সময় গড়াতে থাকায় আমরা আরও আপন হয়ে যাই। তনয়া একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় আসার পর কিছুদিন দু’জন আলাদা থাকতাম। তবে আমি যে বাসায় ছিলাম ওখানে প্রায়ই তনয়া আসা-যাওয়া করতো। ওই বাসায় বেশিরভাগ ভাড়াটিয়া নিম্নআয়ের ছিলেন। তারা আমাদের বিষয়গুলো জানতেন কিন্তু কোনো ঝামেলা করতেন না। এক সময় নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাসা বদল করি।

তনয়া বলেন, আমরা লিভ টুগেদারের পক্ষে ছিলাম। তাই দেরি না করে নতুন বাসা নিয়েছি। বাসা পেতে বেগ পেতে হয়নি। খুব সহজেই পেয়ে যাই। একসঙ্গে আছি। মতের খুব একটা অমিল হয় না। একজন আরেকজনের পাশে থেকেছি। অসুস্থ হলে সেবা করা, রান্না করা, খাবার খাওয়া একসঙ্গে। দু’জন চাকরি করি। যা বেতন পাই সেটা খরচ করি। কখনো কার কত খরচ হলো হিসাব করিনি। তিনি বলেন, আসলে লিভ টুগেদার মানে যে ভিন্ন কিছু এমনটা নয়। লিভ টুগেদারে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। যেমনটি পৃথিবীর অনেক দেশে স্বাভাবিক। আমরা এভাবেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আশা করছি আজীবন এভাবেই থাকবো।

তপু বলেন, আমরা মনের মিলকে গুরুত্ব দিচ্ছি। কোনটাতে সুখ- সেটাকে খুঁজছি। বিয়ে ছাড়াই এতো বছর ধরে একসঙ্গে থাকছি- তাই বলে কি আমরা অসুখী? কম দায়িত্ববান? আমাদের এই সম্পর্কের কথা আমার পরিবারের সবাই জানে। ঢাকায় এলে আমার পরিবারের সদস্যরা আমার সঙ্গেই থাকে। তনয়ার মা-বাবা না জানলেও তার বোন ও ভাইয়েরা বিষয়টি জানে। তবুও আমাদের দু’জনের পরিবার থেকে বিয়ের চাপ আছে। দু’জনের পরিবার থেকেই বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। এসব প্রস্তাব আমরা ফিরিয়ে দিয়েছি। বিয়ের সিদ্ধান্ত এখনো নেইনি। নিতে পারবো কি না সেটাও জানি না। যদি কখনো মনমানসিকতা বদলায় তাহলে হয়তো!

লিভ টুগেদার করেন তিথি। তিনি জানিয়েছেন, আমাদের প্রায় এক হাজার সদস্যদের একটি গ্রুপ আছে। সবাই একই মন-মানসিকতা ও চিন্তাধারার। এই গ্রুপে সদস্য যোগ করার ক্ষেত্রে আগে যাচাই করে নেয়া হয়। এখানে যারা আছে তাদের প্রায় সবার বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের ভেতর।

একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ঢাকার অফিসে চাকরি করেন নিথিতা। তিনি বলেন, অহরহ মানুষ তার প্রয়োজনে লিভ টুগেদার করছে। আমি অন্তত শতাধিক জুটিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। কারণ যেকোনো সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসাই মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। বিবাহ বিচ্ছেদের পরে আইনি জটিলতা ও টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়। সামাজিকভাবেও নানা ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়। এখানে স্বামী-স্ত্রীর আলাদা দায়িত্ব থাকে। পারিবারিক-সামাজিক নানা বিষয় মেনে চলতে হয়।

সমাজ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বেশির ভাগ মানুষ শুধুমাত্র তাদের জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য লিভ টুগেদার করেন। এই সংখ্যাটা অনেক বেশি। আবার কেউ কেউ বিয়ের আগে নিজেদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়ার জন্য করেন।

লিভ টুগেদারের ক্ষেত্রে অনেক সময় সামাজিক ও আইনি বাধা সামনে এসে দাঁড়ায়। কারণ যারা লিভ টুগেদার করেন তাদের মধ্যে সব সময় ধরা পড়ার একটা ভয় কাজ করে। বাড়ির মালিক থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন এমনকি থানা পুলিশের ভয় কাজ করে। বাসা ভাড়া পেতে বেগ পেতে হয়। বাসা পেলেও চড়া দামে ভাড়া দিতে হয়। ভাড়া নিলেও ভাড়াটিয়ার তথ্য পুলিশের কাছে জমা নিয়েও অনেক সমস্যা তৈরি হয়। সঠিক তথ্য পুলিশকে দিতে অনেকে গড়িমসি করেন। বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে সময়ক্ষেপণ করেন। অনেকে আবার ভুয়া বিয়ের কাবিননামা তৈরি করে রাখেন। এ ছাড়া বাড়ির মালিক অভিভাবকের মোবাইল নম্বর চাইলে ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবের নম্বর দিয়ে বুঝ দিতে হয়।

পুরাণ ঢাকার এক তরুণ ও চাঁদপুরের এক তরুণী লেখাপড়া করতেন ধানমণ্ডির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সূত্রেই তাদের মধ্যে পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে সম্পর্ক গড়ায় প্রেমে। ওই তরুণী থাকতেন একটি মহিলা হোস্টেলে। আর তরুণ তার বাসা থেকে ক্যাম্পাসে আসতেন। কিছুদিন পর ওই তরুণ সিদ্ধান্ত নেন তিনি আর পুরাণ ঢাকার বাসা থেকে ক্যাম্পাসে আসবেন পরে। উদ্দেশ্য ছিল প্রেমিকার সঙ্গে একসঙ্গে থাকার। পরে তারা দু’জন ক্যাম্পাসের কাছাকাছি একটি সাবলেট বাসা নেন। ওই বাসায় শুরু করেন লিভ টুগেদার। আড়াই মাসের মাথায় তাদের বাসায় ডিশ সংযোগ দিতে আসেন এলাকার এক যুবক। ওই যুবকের মনে সন্দেহ জাগে তারা বিবাহিত কিনা! পাড়ার অন্যান্য যুবকের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করে ওই তরুণ ও তরুণীকে রাস্তায় আটকে দেন ডিশ সংযোগ দেয়া ওই যুবক। ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের আইফোন ও নগদ টাকা-পয়সা নিয়ে যান। এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি ওই যুবক। বিষয়টি জানিয়ে দেন বাড়ির মালিককে। ডাক পড়ে ওই তরুণ-তরুণীর। কিন্তু তারা তাদের বিবাহিত সম্পর্কের কোনো তথ্য-প্রমাণ দেখাতে পারেননি। এমনকি অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলাতে পারেননি। পরে বাড়ির মালিকসহ পাড়াপ্রতিবেশীরা তরুণ-তরুণীকে স্থানীয় একটি কাজী অফিসে নিয়ে বিয়ে দেন। বিয়ের পরে তারা চার মাস সংসারও করেন। এ সময়ে ওই তরুণী ছিলেন আট সপ্তাহের গর্ভবতী। এরই মধ্যে তরুণী তার স্বামীর অস্বাভাবিক কিছু আচরণ লক্ষ্য করেন। তাদের মধ্যে বোঝাপড়ার অমিল ছিল। তাই ওই তরুণী স্বামীকে ডিভোর্স দেন।

আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও একটি মিডিয়া হাউজের কর্মী বলেন, সহকর্মী এক বন্ধুকে নিয়ে আমি পান্থপথ এলাকার একটি মেসে থাকতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম থেকেই আমরা একসঙ্গে থাকলেও আমার যার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তার লিভ টুগেদারের ইচ্ছা ছিল। আমিও সিদ্ধান্ত নেই একসঙ্গে থাকবো। এক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয় বাসা ভাড়া নিয়ে। পান্থপথ, কলাবাগান, কাঁঠাল বাগান, গ্রিনরোড এলাকার অন্তত শতাধিক বাসা দেখে সুবিধামতো বাসা পাইনি। অনেক সময় বাসার মালিকের নানা প্রশ্ন শুনে চলে আসি। আবার অনেক বাসায় লিভ টুগেদার করাটাকে ঝুঁকি মনে হয়। যেসব বাসায় থাকার মতো অবস্থা ছিল সেখানে আবার ভাড়া বেশি চাওয়া হয়। আমরা দু’জনেই শেষবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলাম। পাশাপাশি ছোট চাকরি করি। একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই কোনোরকম দরকষাকষি না করেই ভাড়া নিই। কারণ, মনে ভয় ছিল বেশি দরদাম করলে হয়তো আর বাসা পাবো না।

সমাজবিজ্ঞানী নেহাল করিম বলেন, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক অনেকেরই আছে। তবে সেটা কেউ প্রকাশ করে না। ভারতের এক গবেষণায় বলা হয়েছে প্রতি ১০ জনের ৮ জনেরই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক আছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশেও এরকম অনেক আছে। কিন্তু অনেকেই এক সঙ্গে বাসা ভাড়া নিয়ে স্থায়ী ভাবে থাকে না। সময়-সুযোগ করে ভালোলাগার মানুষের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে।

তিনি বলেন, লিভ টুগেদার করাটা অনেকের শখ। এটা রুচিগত ব্যাপার। বাংলাদেশের আইনে আছে কোনো নারী-পুরুষ যদি একত্রে থাকতে চায় তবে তাকে ধর্মীয় নিয়মনীতি মেনে বিয়ে করতে হবে। বিবাহিত ব্যক্তি যদি কোনো বিবাহিত বা অবিবাহিত ব্যক্তির সঙ্গে লিভ টুগেদার করে তবে আইন অনুযায়ী শাস্তির বিধানও রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, দুনিয়ার সব দেশেই কমবেশি এমন ঘটনা আছে। তবে একেক দেশের ধরন ও চর্চা একেক রকম। কারণ, ধর্মীয় ও সংস্কৃতির মূল্যবোধ প্রতিটি দেশে ভিন্ন ভিন্নভাবে পরিচালিত হয়। অনেকেই পরিবার গঠন করে তার শারীরিক চাহিদা মেটাতে চায় না। এর মূল কারণ হলো- পরিবার মানে দায়িত্ব, আত্মত্যাগ, শেয়ার করা। এখানে একে অন্যের দায়িত্ব নিতে হয়। পছন্দ না হলেও অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। সেক্রিফাইস করতে হয়। একটা সময় মানুষ পতিতালয় বা সেক্সহাউজে গিয়ে তার শারীরিক চাহিদা মেটাতো। কিন্তু এখন এই বিষয় গুলোকে আরও আধুনিক ও সহজ করে লিভ টুগেদার পন্থা বলা হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায়, মানুষ তার পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে শারীরিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি একাকিত্ব সময়টাও ভালোভাবে কাটাচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের সমাজে বেশি উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বিয়ে করার প্রবণতা কমে গেছে। সবাই যে লিভ টুগেদার করছে- এমনটাও না। বিয়ে না করে থাকা বা লিভ টুগেদার কোনোটাকেই আমরা ইতিবাচক ভাবি না।

লিভ টুগেদারঃ কটু কথা ভেবে কেউ এড়িয়ে যাবেন না। যেমন এইডস সম্পর্কে কারো অজানা থাকা উচিত নয়। বর্তমান সমাজে, বিশেষ করে নিয়ন আলোর শহরে ভয়াবহ ব্যাধির নাম ‘লিভ টুগেদার’। বাংলা অর্থ করলে বিবাহ বহির্ভৃত নর-নারীর একসাথে বসবাস। লিভ-টুগেদার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরকীয়ার ফল। যখন কেউ পরকীয়ায় মত্ত হয়ে যায়। তখনই লিভ টুগেদার শুরু হয়। এছাড়াও রয়েছে আরো অনেক কারণ। এটাকে অনেকে বলে থাকেন ‘পার্সোনাল কিলিং’। নতুন কোনো সম্পর্ক সৃষ্টি না। এর ফলে একটা পরিবার খুন হয়। সামাজিক অবক্ষয় আর মূল্যবোধ খুন হয়। সামাজিক স্বীকৃতি না থাকলেও সাম্প্রতিক কালে ঢাকায় আশঙ্কাজনক হারে লিভ টুগেদার বাড়ছে। ঢাকার প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ গুলোর ছাত্র-শিক্ষক, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এমনকি সাধারণ কর্মচারীরা পর্যন্ত লিভ টুগেদার করছে। শোবিজে লিভ টুগেদার এখন সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। জাতীয় ভাবে পরিচিত শোবিজের অনেক স্টার এখন লিভ টুগেদার করছেন।

কয়েকটি ঘটনার উদাহরণ টানা যায়। নারী নিপীড়ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন আবু জাফর মোহাম্মদ কার্লোস নামের এক আন্তর্জাতিক ইয়াবা ব্যবসায়ী। তার সঙ্গে জড়িয়ে মিডিয়ায় আলোচিত হচ্ছে বেশ কজন মডেল অভিনেত্রীর নাম। অনন্য মামুন পরিচালিত ‘অস্তিত্ব’ চলচ্চিত্রের প্রযোজক কার্লোস। অস্তিত্ব সিনেমা বানানোর পর কার্লোস ঢাকার সিনেমা পাড়ার নামী-দামি নায়িকাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এ সব নায়িকার অনেককে নিয়ে তিনি থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় যাতায়াত শুরু করেন। এদের কয়েক জনের সঙ্গে তিনি লিভ টুগেদারও করছিলেন। রাজধানীর পরীবাগের ফ্ল্যাটে চিত্রনায়িকা সাবিনা রিমাকে নিয়ে তিনি লিভ টুগেদারে মেতেছিলেন বছর খানেক ধরে। এছাড়া ফ্যাশন হাউস এক্সটেসির মডেল তানভিয়া জামান মিথিলার সঙ্গে তার লিভ টুগেদার চলছিল বলেও জানা গেছে। কার্লোসের সঙ্গে জড়িয়ে মডেল ও অভিনেত্রী পিয়া বিপাশা, তানভিয়া জামান মিথিলা, পিয়াসাসহ অনেকের নাম এখন আলেচিত হচ্ছে। এ সময়ের অন্য একটি আলোচিত ঘটনা হাবিব ওয়াহিদ ও তানজীন তিশা। হাবিবের সাবেক স্ত্রী অভিযোগ তুলেছে হাবিব তিশার সাথে লিভ টুগেদার করে।শোবিজের লিভ টুগেদার নতুন কিছু নয়। অনেকদিন থেকেই অনেকজন লিভ টুগেদার করছে। নিজেদের ক্যারিয়ারের কথা ভেবে অনেকেই তাদের সম্পর্কটাকে সামাজিক রূপ দিচ্ছে না। বিয়েকে একটি বড় বাধা মনে করেন তাঁরা।

একটু খোঁজ নিয়ে লিভ টুগেদারের অনেকগুলো কারণ পাওয়া যায়। অভিজাত এলাকায় এর শুরু। পাশ্চত্য সংস্কৃতির ভূত বহুকাল ধরেই এদেশেও চেপে আছে। নারী-পুরুষ কেউই দায়িত্ব নিতে চায় না। কিন্তু জৈবিক চাহিদা তো এড়ানো সম্ভব নয়। ফলশ্রুতিতে লিভ টুগেদার একমাত্র উপায়। অজস্র টাকা হাতে এলে যা হয়। নিয়ম ভাঙার খেলায় মাতে। আজকাল এমন অনেকের সন্ধান মেলে যাদের সামাজিক স্বীকৃত বিবাহিত বউ থাকা অবস্থায় লিভ টুগেদার করছে। ওই যে টাকার খেলা। টাকা দিয়ে কোন নারীকে বাসা ভাড়া করে দিচ্ছে। সেই বাসায় মাঝে মাঝে যাচ্ছে-আসছে। আশেপাশের মানুষ জানছে তার স্বামী। কিন্তু তার যে অন্য কোথাও সংসার রয়েছে। এখানে সাময়িক সময় কাটানো। এমনটা হচ্ছে কম বয়সীদেরও। তারা বিয়ে করছে বলে অনেক সময় অনেক বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। কিন্তু বাড়িওয়ালারা কিছু না জেনেই ভাড়া দেয়। লিভ টুগেদারের ঘটনা অহরহ। আমরা কানাঘুষা করে অনেকের সম্পর্ককেই জানি। কিন্তু এটা প্রকাশ্যে আসে যখন এর দ্বারা সমাজে কোনো অপরাধ সংগঠিত হয়। অপরাধের কথা শুনে নিশ্চয়ই আপনার চোখে গেল কয়েক বছরের কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ভেসে উঠবে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গেল কয়েক বছরে রাজধানীতে যদি গড়ে দশটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। এর মধ্যে নারী হত্যাকাণ্ড হলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেরিয়ে এসেছে পেছনে লিভ টুগেদারের বিড়ম্বনা। পুরুষের সংখ্যাও কম নয়। দেখা গেছে, স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এরা বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন। এক পর্যায়ে মনোমালিন্য বা মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়লে তাঁকে খুন করে পালিয়েছেন ছেলেটি। শিকদার মেডিকেল কলেজের সেই শিক্ষার্থীর কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? সাউদিয়া আক্তার ওরফে মিথির (২৩) লাশ রায়েরবাজারের একটি বাড়ি থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এক যুবকের সঙ্গে লিভ টুগেদার করতেন। পরে মেয়েটি গর্ভবতী অবস্থায় খুন হন।

এর আগে মিরপুর এলাকায় খুন হয় সুরাইয়া নামের এক যুবতী। তিনি চাকরি করতেন একটি বেসরকারি সংস্থায়। তাকে খুন করে বাসায় লাশ রেখে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে চলে যায় যুবক সুমন রহমান। পরে জানা যায়, প্রায় বছর খানেক ধরে লিভ টুগেদার করতেন সুমন ও সুরাইয়া। এক অজ্ঞাত তরুণীর লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরের শালবন এলাকায়।

পুলিশি অনুসন্ধানে জানা যায়, উত্তরা এলাকায় একটি বাড়িতে দুই-তিন বছর ধরে এক যুবকের সঙ্গে তিনি স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে ভাড়া থাকতেন। রাজধানীর গুলশান এলাকায় বাসার ভেতরে এক তরুণীকে খুন করে পালিয়ে যায় ঘাতক। তারাও ভাড়া থাকতো স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে।

শাহাবুদ্দীন নাগরী। বয়স ৬২ বছর। অনেক পরিচয় তার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক এই কর্মকর্তা একজন কবি ও গীতিকার। একই সঙ্গে তিনি ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, সুরকার, গায়ক এবং নাট্যকার হিসেবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত। একজন আধুনিক রোম্যান্টিক কবি হিসেবেও পরিচিত শাহাবুদ্দীন নাগরী, বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে ফেঁসে যান। বন্ধুকে খুনের অভিযোগ ওঠে। নিহত ব্যবসায়ী নুরুল ইসলামের বাসায় অবাধ যাতায়াত ছিল তাঁর। অভিযোগ রয়েছে, শাহাবুদ্দীন নাগরীর সঙ্গে ওই ব্যবসায়ীর স্ত্রীর ‘ঘনিষ্ঠ’ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই নারীকে তিনি নিয়মিত উপহারও দিতেন।

মডেল সাবিরা হোসেনের সঙ্গে ফেসবুকে ফটোগ্রাফার নির্ঝর সিনহার পরিচয় হয়েছিল। নির্ঝরের ফটো তোলার প্রস্তাবে সাড়া দিতে গিয়েই গড়ে ওঠে দুজনের বন্ধুত্ব। সেটা প্রেমের সম্পর্কে রূপ নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি। এতোটাই গভীর হয়ে ওঠে তাদের সম্পর্ক, কিছুদিন তার সাবলেটে বাসা নিয়ে লিভ টুগেদারও করেছেন। দুজনের ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে জানা গেছে নির্ঝর-সাবিরার প্রেম এবং বিবাহ বহিভূর্ত বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলার কাহিনী। বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ায় সাবিরাকে কিছুদিন ধরে এড়িয়ে চলতে শুরু করে নির্ঝর। শেষে উপায় না পেয়ে সাবিরা প্রেমিকের বাসায় গিয়ে হাজির হন বিয়ের দাবি নিয়ে। ওই সময় নির্ঝরের ভাই প্রত্যয় তার সঙ্গে প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করে বাসা থেকে বের করে দেয়। এই ঘটনা মেনে নিতে না পেরে সাবিরা আত্মহত্যা করে। ফেসবুকের মাধ্যমে যেহেতু নির্ঝরের সঙ্গে তার সম্পর্ক, তাই আত্মহত্যার আগে ফেসবুকের স্ট্যাটাসে সাবিরা সুইসাইড নোট দিয়ে যান।

সমাজের সব স্তরেই লিভ টুগেদার নামের চর্চা ছড়িয়ে পড়ছে। সদ্য গ্রাম থেকে এসে ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া ছেলেমেয়েরা লিভ টুগেদার করছে। কেবলমাত্র পড়াশোনা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন; কিন্তু কাঙিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি- এমন অনেক মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা ঢাকায় লিভ টুগেদার করছেন।

ঢাকার একটি নামকরা মেডিকেল কলেজের একজন শিক্ষার্থী বলেন, তাঁর জানা মতে, তাঁদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কম করে হলেও ১০০ জোড়া ছেলেমেয়ে লিভ টুগেদার করছে। বিষয়টি তাদের কাছে ওপেন সিক্রেট হলেও কেউ কাউকে নিয়ে ঘাঁটা ঘাঁটি করেন না। ওই শিক্ষার্থী লিভ টুগেদারকে খারাপ কিছু মনে করেন না। তাঁর ভাষায় দু’জনের মতের মিলেই তাঁরা লিভ টুগেদার করেন। এখানে অপরাধ কিছু নেই।

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ ক’জন শিক্ষক-শিক্ষিকা লিভ টুগেদার করছেন। তাদের লিভ টুগেদারের কথা জানে তাদের অনেক ছাত্রও। ওই শিক্ষকদের একজন তাঁর এক নিকটজনের কাছে বলেছেন, লিভ টুগেদারকে তিনি বরং গর্বের বিষয় মনে করেন। অনেকের মতে, লিভ টুগেদারের ধারণা খারাপ নয়, আমরা কেউ কারও বোঝা নই, আইনি বন্ধনও নেই। কারো ভালো না লাগলে তিনি এক সঙ্গে নাও থাকতে পারেন। এতে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা নেই।

ঢাকায় লিভ টুগেদার করছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে এ প্রবণতার কিছু কারণ জানা গেছে। তাদের মতে, যে সব মেয়ে নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করে, নিজেদেরকে ইউরোপ-আমেরিকা বা দেশের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। তাঁরা এখনই বিয়ে করে ছেলেমেয়ের ভার নিতে চান না। টানতে চান না সংসারের ঘানি। ওইসব মেয়ে নিজেদেরকে বিবাহিত বলে পরিচয় দিলে তাদের ক্যারিয়ার গড়তে সমস্যা হতে পারে বলে মনে করেন। আবার এমন অনেক ছেলেও আছেন, যারা ওই সব মেয়ের মতো ধারণা পোষণ করেন না; তারা কেবলমাত্র জৈবিক কারণে লিভ টুগেদার করছেন। অর্থবিত্তে বা চাকরিতে প্রতিষ্ঠিত এমন অনেকে লিভ টুগেদার করছে কেবলমাত্র সমাজে তাঁর একজন সঙ্গীকে দেখানোর জন্য, নিজের একাকিত্ব ও জৈবিক তাড়নায়। অনেকে বিয়ের প্রতি প্রচণ্ড রকম অনাগ্রহ থেকেও লিভ টুগেদার করছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় ব্যাপক হারে বেড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছেলেমেয়েদের লিভ টুগদোর। ওয়েস্টার্ন সোসাইটির প্রতি এক ধরনের অন্ধ আবেগ ও অনুকরণের পাশাপাশি জৈবিক চাহিদা মেটাতে তারা লিভ টুগেদার করছেন। আবার ঘন ঘন তাদের লিভ টুগেদারে বিচ্ছেদও ঘটছে। সহসা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ঘটছে খুনের মতো অপরাধ।