• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০৯:০৮ অপরাহ্ন

ঢাকা জেলার দোহার থানা পুলিশের সীমাহীন বর্বরতা : ওসি মোস্তফা কামালের খুঁটির জোর কোথায়?


প্রকাশের সময় : জুলাই ২১, ২০২৩, ৯:৩৭ অপরাহ্ন / ১৭২
ঢাকা জেলার দোহার থানা পুলিশের সীমাহীন বর্বরতা : ওসি মোস্তফা কামালের খুঁটির জোর কোথায়?

বিশেষ প্রতিবেদক, ঢাকাঃ একের পর এক অভিযোগের যেনো শেষ নেই দোহার থানার বিতর্কিত ওসি মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে। ফ্রান্স প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতাদের হাত-পা ভেঙ্গে পঙ্গু বানিয়ে দেয়ার অভিযোগ। মোস্তফা কামালের তাণ্ডবে ভালো নেই দোহারের কোনো প্রবাসী পরিবারই লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি তদন্ত শুরু করেছেন ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি। টাকার কুমির হিসেবে পরিচিত, বহুল আলোচিত বিতর্কিত ওসি মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে দোহারে। তার নির্যাতনে দোহার থানা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফজলুর রহমান গাজীর মৃত্যুসহ ফ্রান্স প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজ গাজী ও মিরাজ গাজীর হাত পা ভেঙ্গে পঙ্গু বানিয়ে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়াও ওই পরিবারের পাঁচ মাসের গর্ভবতী স্ত্রীকে লাথি মেরে ফেলে দেয়াসহ সকল সদস্যকে বেধড়ক পিটিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী সিরাজ গাজী। তিনি দোহারের বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফজলুর রহমান গাজীর সন্তান। তাদের বাড়ি দোহার উপজেলা সদরের খালপাড় এলাকায়। তিনি ফ্রান্স আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে এরইমধ্যে ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি বিষয়টি তদন্ত শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।

সিরাজ গাজী জানান, দোহার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে থাকা ধনকুবের মোস্তফা কামাল প্রবাসীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নানা উছিলায় হানা দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন এমন খবর প্রবাসে বসে শুনলেও তা বিশ্বাস করিনি। তিনি নানা কায়দা কৌশলে প্রবাসী স্বজনদের বিরুদ্ধে নামে বেনামে দরখাস্ত করানোর মাধ্যমে তাদের থানায় ধরে আনেন, অমানষিক নির্যাতন চালান এবং চাহিদা মাফিক টাকা আদায় করে তবেই ছাড়েন।

ভুক্তভোগী সিরাজ গাজী ঈদুল ফিতরের ছুটিতে দেশে আসেন এবং তার অপর ভাই মিরাজ গাজীও তখন বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। বিগত ২০ এপ্রিল সকালে হঠাৎই একদল পুলিশ তাদের বাড়িতে চড়াও হয়, তারা শাবল, খুন্তি দিয়ে রীতিমত ডাকাত স্টাইলে ঘরের দরজা, জানালা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে পরিবারের সকলকে বেধড়ক মারধোর করতে থাকে। এসআই জাহিদ, এসআই সুলতান, এসআই নান্টুসহ আরো ৪/৫ জন সিভিল ড্রেসে সিরাজ গাজীর উপর এমনই বর্বরতা চালায় যার ধকল এখনও পোহাচ্ছেন তিনি। হাটতে পারেন না, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়াও করতে পারেন না।

বড় ভাইয়ের উপর এমন ভয়াল নির্যাতন দেখে ছোট ভাই মিরাজ দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছিল ভয়ে। কয়েকজন পুলিশ সদস্য ঢেকি ও শাবলের সাহায্যে তার ঘরের দরজা ভেঙ্গে তাকে মারতে মারতে উঠানে শুইয়ে ফেলে এবং মিরাজের গলায় পাড়া দেয় একজন এসআই। বাকিরা লাঠিসোটা ও শাবল দিয়ে পিটিয়ে মিরাজের পা ভেঙ্গে চিরতরে পঙ্গু বানিয়ে ফেলে। এ সময় মিরাজের স্ত্রী থামাতে গেলে পাঁচ মাসের গর্ভবতী স্ত্রীকে লাথি মেরে ফেলে দেয়া হয়। তার ছোট মেয়েকে লাঠি দ্বারা বেধড়ক পেটায় এমনকি মিরাজের বৃদ্ধা মাকেও রেহাই দেয়া হয়নি।

বয়োবৃদ্ধ পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ফজলুর রহমান গাজী ছেলের মারধোর দেখে সহ্য করতে পারেননি, তাই এগিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে তার প্রাণ ভিক্ষা চাইতেই কয়েকজন তার উপর হামলে পড়ে। কিল, ঘুষি, লাথি, চর সমানে চলতে থাকে এই বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার উপর। তার পা ও পিঠে বেশ কয়েকটি লাঠির আঘাত দিতেই তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সেই অসুস্থতার জের ধরে কয়েকদিনের মধ্যেই তার করুণ মৃত্যু ঘটে।

পুলিশি নির্যাতন চালানোর ঘটনা সিরাজ গাজীর স্ত্রী তার মোবাইলে ভিডিও করতে থাকলে এক দারোগা নান্টু এগিয়ে তার চুলের মুঠি ধরে বেশ কয়েকটি চর থাপ্পর মারে এবং তার দুটি মোবাইল ফোনই কেড়ে নেয়। এ সময় পুলিশ সদস্যরা বাড়ি ঘর খুঁজে আরো চারটি দামি মোবাইলও হাতিয়ে নেয় এবং আলমিরা, ড্রয়ার খুঁজে খুঁজে এক লাখ ২৭ হাজার টাকা লুটে নেয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

দুই ঘণ্টা ধরে গাজী বাড়িতে অসংখ্য মানুষের উপস্থিতিতে পুলিশের ভয়ঙ্কর তাণ্ডবলীলা শেষে সিরাজ গাজী, মিরাজ গাজীসহ তিন ভাইকে পুলিশ মারতে মারতে থানায় নিয়ে যায়। এ সময় থানার অদূরে রাস্তায় মুখোমুখি হয়ে ওসি মোস্তফা কামাল তার দারোগাদের সঙ্গে বকাবকি করে বলেন, প্রত্যেকের পায়ে গুলি না চালিয়ে থানায় নিচ্ছো কেন?

সিরাজ গাজী জানান, তখন পর্যন্ত আমরা জানি না কি অপরাধে আমাদের উপর এ নির্যাতন চালানো হচ্ছে। থানা হাজতে ঢুকিয়ে জানানো হয়, পুলিশের কর্তব্য কাজে নাকি বাধা দেয়াসহ পুলিশ সদস্যদের মারধোর করার ঘটনায় আমাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। জেল হাজতে রাখা অবস্থায় সিরাজ গাজী, মিরাজ গাজী ও সজিব গাজী এ তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে আরো তিনটি মামলা রুজু করে পুলিশ। তারপরও ভয়ভীতি দেখিয়ে আরো দেড় লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় পুলিশ।

এখানেই শেষ নয়, ভয়ঙ্কর ওসি মোস্তফা কামাল নিজে সিরাজ গাজীদের বাড়িতে পৌঁছে লোকজনকে জড়ো করে বলেছেন, কেউ যদি এই গাজী বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন তারাও মামলা হামলার শিকার হবেন। ওই বাড়িতে কোনো লোকের আসা যাওয়া দেখলে তাদেরকেও থানায় ধরে নেয়া হবে। এমন ঘোষণার পর আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী কোনো মানুষ গাজী বাড়ির আশপাশেও যাতায়াত করেন না, ফলে পুরোপুরি এক ঘরে হয়ে পড়েছেন তারা। হাটবাজারে তাদের যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে, ছেলে মেয়েদের পড়াশুনাও পুরোপুরি বন্ধ। কি এমন আক্রোশে এসব ঘটানো হলো? তার জবাবে গ্রামবাসী জানিয়েছেন, খোঁজ নিয়ে দেখেন দোহারের কোনো প্রবাসী পরিবারই ভালো নেই। ঘরে ঘরে মোস্তফা কামালের তাণ্ডব রয়েছে। এ তাণ্ডব টাকা হাতানোর তাণ্ডব। যতো বেশি অত্যাচার চলবে তত বেশি টাকা আদায় এমন মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে উঠেছেন থানার দারোগারাও।

ফ্রান্স প্রবাসী সিরাজ ও মিরাজ কয়েক মাস জেলহাজত খেটে বেরিয়ে এলেও তাদেরকে ফ্রান্সে যাওয়ার ক্ষেত্রে নানারকম বাধা বিঘ্নতার সৃষ্টি করা হচ্ছে। থানার সূত্রগুলোই তাদের কাছে এখন ওসির নামে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করছেন। অন্যথায় আরো মামলা দিয়ে তাদের চিরতরে বিদেশ যাওয়া বন্ধ করারও হুমকি দেয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সিরাজ গাজীর পরিবার। তারা তিন ভাই জেলে থাকাবস্থাতেই বাবার করুণ মৃত্যু ঘটে। থানার ওসি মোস্তফা কামালের ইন্ধনে তার পরিবারের গড়ে তোলা মাদ্রাসাটিও জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।

ওসি মোস্তফা কামালের বিরুদ্ধে অভিযোগে শেষ নেইঃ এর আগেও ওসি মোস্তফা কামাল অর্থের বিনিময়ে খোদ আওয়ামী লীগের দুই কর্মীকে নাশকতা মামলায় জড়িয়েছেন। তার রুমে কোনো সমস্যা নিয়ে গেলে এমন হুমকিও শুনতে হয় ‘এই এটা ওসির রুম, একদম সাঁটিয়ে দিব।’

গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর পৌরসভার চণ্ডীবর্দী এলাকার গ্রামে ওসি মোস্তফা কামালের কোটি টাকার আলিশান বাড়ি এলাকার সবার নজর কেড়েছে। রাতারাতি তার এ উত্থান নিয়ে রয়েছে নানা সমালোচনা। উপজেলার মানুষের মনে তার আয় নিয়ে নানা প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা রয়েছে। গোপালগঞ্জের নাম ভাঙিয়ে চলা এ পুলিশ কর্মকর্তার অনিয়মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায় না কেউ। মোস্তফা কামাল ২০০০ সালে এসআই হিসেবে চাকরিতে যোগদানের পর অবৈধ অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে রাতারাতি পাল্টে যায় পারিবারিক অবস্থান। সাভার থানার সেকেন্ড অফিসার ও আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নামে-বেনামে মুকসুদপুর, ঢাকা, সাভার ও আশুলিয়ায় গড়ে তোলেন অঢেল সম্পত্তি। এলাকায় তিনি কোটিপতি পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত।

তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার ওসি থাকাকালে মোস্তফা কামাল টাকা পেলে সব অবৈধ কাজকেই বৈধতা দিতেন। ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই নবাবগঞ্জ থানায় ওসি হিসেবে যোগদানের পর তিনি অবৈধ অর্থ উপার্জনে আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েন। দোহারে বদলি হয়ে যেন হাতের মুঠোয় স্বর্গ পেয়ে বসেছেন। ইছামতি নদীতে মাটি কাটা, বালু উত্তোলন, পরিবহন খাত, মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সখ্য এবং নাশকতা মামলার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চাকরি জীবনের ২০/২২ বছরে কোটি কোটি টাকার গাড়ি, বাড়ি ও সম্পত্তির মালিক এখন মোস্তফা কামাল। তার কর্মকাণ্ডে থানার একাধিক কর্মকর্তা বিপাকে থাকলেও নাম-পরিচয় প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি, কারণ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দোহাই দিয়ে তিনি নির্বিঘ্নে অপকর্ম চালিয়ে আসছেন।

ওসি মোস্তফা কামাল যা বললেনঃ ঢাকার দোহার থানার অফিসার ইনচার্জ মোস্তফা কামাল জানান, সিরাজ ও মিরাজ গাজীদের পরিবার এলাকায় খুবই অত্যাচারী মানুষ হিসেবে পরিচিত। তারা দাপট দেখিয়ে যাকে তাকে মারধোর করাসহ এলাকায় মাদক ব্যবসায়েও শেল্টার দিয়ে থাকে। এলাকার মাদ্রাসাটি পর্যন্ত তারা পুড়িয়ে দিয়েছে। নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে মামলা নেয়া হয় এবং তাদের গ্রেফতার করতে যাওয়া পুলিশ সদস্যদের পর্যন্ত নাজেহাল করার ঘটনা ঘটে। সুতরাং তাদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে যা যা পদক্ষেপ নেয়ার দরকার ছিল তাই তাই করা হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে ওসি মোস্তফা কামাল বলেন, টাকা লুটপাট, ঘুষ গ্রহণ বা ঘুষ দাবির সকল অভিযোগ মিথ্যা, ভিত্তিহীন। আসলে সিরাজ গাজী, মিরাজ গাজীদের পরিবারটা এলাকায় সমাজচ্যুত হিসেবেই পরিচিত। তারা এখন পুলিশকে পাল্টা হয়রানি করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন ওসি।