• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:০২ অপরাহ্ন

আপনজনদের দ্বারাও নারীর জীবন এখন হুমকির মুখে পড়ছে : পরিবার ও আপনজনের কাছেও অনিরাপদ নারী


প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ২৮, ২০২১, ১২:০৩ অপরাহ্ন / ২৪৮
আপনজনদের দ্বারাও নারীর জীবন এখন হুমকির মুখে পড়ছে : পরিবার ও আপনজনের কাছেও অনিরাপদ নারী

বিশেষ প্রতিনিধি : পরিবার ও আপনজনেরাও আর নারীর জন্য নিরাপদ নয়। অতি আপনজন বাবা-চাচা, স্বামী, ভাই হয়ে উঠছে নিপীড়ক। আপনজনদের দ্বারাও নারীর জীবন এখন হুমকির মুখে পড়ছে। বিভিন্ন কেস স্টাডি থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানসিক অবক্ষয়, নৈতিকতার অভাব, মাদকাসক্ত, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে এখন অনেক পরিবারেই বর্ণনাতীত কিছু অমানবিক ও পাশবিক ঘটনা ঘটছে। যা সমাজের বিবেকবান মানুষদের ভাবিয়ে তুলেছে।

গত ২১ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে গৃহবধূকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করে মাথার চুল এবং চোখের ভ্রু কেটে দেয় স্বামী, দেবর ও শাশুড়ি। জানা যায়, গৃহবধূ গুলনাহার পারভিন মিনুর (৩০) ১৫ বছর আগে মেহেদী হাসান সুজনের (৪৩) সঙ্গে বিবাহ হয়। গত ৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি শাহজাদপুরে বেড়াতে যান তারা। মিনু বিবাহের পর থেকেই বিভিন্নভাবে স্বামীর সংসারে নির্যাতিত হয়ে আসছিলেন। সবশেষ গত ১৫ ডিসেম্বর মিনুর স্বামী সুজন স্ত্রীকে পারিবারিক কলহের জের ধরে অমানবিক শারীরিক নির্যাতন করে এবং এক পর্যায়ে মাথার চুল ও চোখের ভ্রু কেটে দেয়।

১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীতে স্বামী ইফতেখারের বাড়িতে শারীরিক নির্যাতনে মারা যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ইলমা চৌধুরী মেঘলা (২৫)। এ ঘটনার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই স্বামীর নির্যাতনে মৃত্যু হয় চট্টগ্রামের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির এলএলবি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদা খানম আঁখির। স্বামীর নির্যাতনে ১৯ ডিসেম্বর রাতে নগরীর একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্হায় আঁখি মৃত্যুবরণ করে। দুই বছর আগে প্রেম করে বিয়ে করেন আঁখি ও আনিসুল। বিয়ের পর থেকে যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে মারধর করতেন আনিসুল।

৮ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে বাবা ও তার বন্ধুর নামে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মামলা করেছে এক কিশোরী। মেয়েটির চাচা আব্দুল মালেক জানান, তার ভাই আবদুল খালেক মালয়েশিয়া প্রবাসী। প্রায় এক বছর আগে তিনি করোনার কারণে দেশে ফিরে আসেন। ফেরার পর থেকে তিনি স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন করতেন, এক পর্যায়ে স্ত্রী তার কিশোরী মেয়েকে রেখে বাবার বাড়িতে চলে যান। এরপর গত ১ ডিসেম্বর রাতে বাবা খালেক ও তার বন্ধু আব্দুল কাদির কিশোরী মেয়েটিকে ধর্ষণ করেন। ভয়ে মেয়েটি কাউকে কিছু জানায়নি। এরপর থেকে প্রতি রাতেই কিশোরী মেয়েটিকে ধর্ষণ করত বাবা। ৬ ডিসেম্বর মেয়েটি তার চাচিকে বিষয়টি জানালে, চাচা-চাচি র্যাবের কাছে অভিযোগ দেন। থানার ওসি জানান, মঙ্গলবার রাতে মেয়েটি ধর্ষণ মামলা করে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সম্প্রতি জানায়, দেশের প্রায় ৮৪ শতাংশ নারী ক্রমাগত রাস্তা, যানবাহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রে এমনকি বাড়িতেও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আর ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোট ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ১৯৪টি। এর মধ্যে ৪৮৯ জন নারী ও ৭০৫ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বিজ্ঞজনেরা বলছেন, আগে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনাগুলো যৌতুক বা স্বামী-স্ত্রীর পরকীয়ার সম্পর্কের কারণে ঘটলেও এখন এর ব্যপ্তি বেড়েছে। বিশ্বায়নের এই যুগে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার চিত্র দেখে মানুষ সহিংস হয়ে উঠছে। এর মধ্যে মানুষের মোবাইল ফোন আসক্তি বৃদ্ধির কারণে একটি পরিবারের সব সদস্যই এক ধরনের মানসিক সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। এতে পারিবারিক জটিলতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার মহামারির কারণে অর্থনৈতিক ধস নেমেছে। অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে পারিবারিক জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। স্বামীরা স্ত্রীকে, স্ত্রীরা স্বামীকে পরকীয়ার জন্য সন্দেহ করছেন, যা জটিল এক মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা তৈরি করছে। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক এ সমস্যা সমাধানে আমাদের পরিবার ও রাষ্ট্র থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্হা নেওয়া হচ্ছে না। আর পরিবারে একা যে স্বামী নির্যাতন করছে তা নয়, এর সঙ্গে পরিবারের অন্য ব্যক্তি যেমন, শাশুড়ি, দেবর-ননদ যুক্ত হচ্ছেন, তখন স্বামীও ক্ষমতাধর হয়ে উঠছেন। ফলে পারিবারিক সহিংসতা একের পর এক ঘটে চলেছে।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী এ প্রসঙ্গে বলেন, বর্তমানে দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিটি ক্ষেত্রেই উদ্বেগজনকহারে বেড়ে চলেছে। সহিংসতার ঘটনাগুলো সারা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এই ঘটনার প্রকৃত দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে অপরাধীরা পেশিশক্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে পার পেয়ে যাবে। ফলে এদেশে তনু, নুসরাতসহ অগণিত নারী ও শিশু হত্যার বিচারহীনতার মধ্য দিয়ে দেশের সমগ্র নারী ও শিশু অনিরাপত্তায় থাকবে।