• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১১:৪৪ অপরাহ্ন

আন্ডারওয়ার্ল্ডের সেই ক্যাসিনো সাঈদ প্রকাশ্যে আসার পর তার ক্যাডার বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে


প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ১৭, ২০২৩, ৬:৪৪ অপরাহ্ন / ৯৬
আন্ডারওয়ার্ল্ডের সেই ক্যাসিনো সাঈদ প্রকাশ্যে আসার পর তার ক্যাডার বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে

মোঃ রাসেল সরকার,ঢাকাঃ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ‘পলাতক’ সাঈদের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। অর্থাৎ, পাসপোর্ট ব্যবহার করে বৈধ পথে দেশে ঢুকতে বা বের হতে গেলেই তার গ্রেফতার হওয়ার কথা। তাহলে কীভাবে নির্বিঘ্নে দেশে ফিরে সব মামলায় জামিন নিয়ে প্রকাশ্যে এলেন তিনি? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

জানুয়ারির শেষ দিকে ওমান থেকে কলকাতা আসেন সাঈদ। এরপর ৩০ জানুয়ারি বেনাপোল সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধ ভাবে দেশে ঢুকে অতিগোপনে পরপর তিনটি মামলায় জামিন নেন। জামিন পেয়েই মতিঝিল ও আরামবাগ এলাকার হারানো আধিপত্য কবজা করার সব বন্দোবস্ত করেই মঙ্গলবার হকি ফেডারেশনের সভায় যোগ দেন তিনি। এরপরই সব মহলে হইচই পড়ে যায়। ঘনিষ্ঠজনরাও ক্যাসিনো সাঈদের এই ক্যারিশমা দেখে বিস্ময়ে হতবাক। এদিকে সাঈদ প্রকাশ্যে ফিরতেই এলাকায় তাণ্ডব শুরু করেছে তার ক্যাডার বাহিনী। চাঁদাবাজি ও অবৈধ অর্থের উৎসের দখল ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা।

মঙ্গলবার জামাল ওরফে ক্যাসিনো জামালের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী স্থানীয় মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি আহমদ ইসলাম পুতুলের ওপর হামলা চালিয়েছে। তাকে নির্মম ভাবে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে। মুগদা জেনারেল হাসপাতালের সিসিইউতে গুরুতর অবস্থায় চিকিৎসাধীন তিনি। মারধর করা হয়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রহমত আলী ও তার স্ত্রী মর্জিনাকে।

স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোজাম্মেল হককেও লাঞ্ছিত করেছে তারা। সাঈদের সেকেন্ড ইন কমান্ড যুবলীগের বহিষ্কৃত স্থানীয় নেতা জামালের নেতৃত্বে চাঁদাবাজ বাহিনী ফের গা ঝাড়া দিয়ে ওঠায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায় উল্লিখিত সব তথ্য। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর এক সপ্তাহ আগে সিঙ্গাপুর যান মমিনুল হক সাঈদ। এর পাঁচ মাস আগে ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের পর তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা করে দুদক। আর সিআইডি করেছে অর্থ পাচারের পৃথক দুটি মামলা। এসব মামলায় গ্রেফতার এড়াতে তখন আর দেশে ফেরেননি তিনি। তবে সিঙ্গাপুর থেকে পাড়ি জমান ওমানে। দেশ থেকে বিপুল অর্থ পাচার করে সেখানে তিনি বিত্তবৈভব গড়ে তুলেছেন বলে জানতে পেরেছে সিআইডি।

তিন বছর পর সেখান থেকে দেশে ঢুকে গ্রেফতার এড়িয়ে প্রকাশ্যে আসতে সক্ষম হওয়ায় তার ঘনিষ্ঠজনরাও মনে করছেন, সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করে ফেলেছেন সাঈদ। তাই তাকে আর জেলে যেতে হবে না।

জানতে চাইলে মমিনুল হক সাঈদ বলেন, কবে, কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় দেশে ফিরেছি, কীভাবে জামিন পেয়েছি, তা একান্তাই আমার বিষয়। এ সংক্রান্ত কোনো প্রশ্নের জবাব আমি দেব না। তবে আমি সব মামলায় স্থায়ী জামিনে আছি। আর আমি এই প্রথম হকি ফেডারেশনের সভায় যোগ দিইনি। বিদেশে থাকা অবস্থায় করোনাকালীন অনলাইনে ফেডারেশনের অনেক সভায় অংশ নিয়েছি।

মতিঝিল ও আরামবাগ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, তার বাহিনীর টেন্ডার ও চাঁদাবাজি সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমি মতিঝিল-আরামবাগ এলাকায় থাকি না। আমার কোনো বাহিনী নেই। তিন বছর বাইরে থাকলে আমার বাহিনী থাকে কীভাবে।’ যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা জামাল আপনার সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে চাঁদাবাজ ও দখলদার বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জামাল নামে কাউকে আমি চিনি না।

মতিঝিল ও আরামবাগে সরেজমিনে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সাঈদের চাঁদাবাজ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা হাসান উদ্দিন জামাল ওরফে ক্যাসিনো জামাল। মতিঝিল ও আরামবাগের সব ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদা তোলে জামাল গ্রুপ। তার ক্যাডার বাহিনী মঙ্গলবার মতিঝিল এলাকায় মৎস্যজীবী লীগ নেতা আহমদ ইসলাম পুতুলের ওপর হামলা চালায়।

এ ঘটনায় মামলা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি। উলটো যাকে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে, সেই পুতুলকে প্রধান আসামি করে পালটা একটি মামলা করেছে হামলাকারীরা।

আহত পুতুলের বড় ভাই স্থানীয় যুবলীগ নেতা নূরুল ইসলাম চৌধুরী নুরু বলেন, সাঈদ প্রকাশ্যে আসার পর তার ক্যাডার বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আমার ভাই মতিঝিল ও দিলকুশায় হোটেল ও ক্ষুদ্র দোকানগুলোয় দুধ ও চা-পাতা সরবরাহের ব্যবসা করেন। মঙ্গলবার বিল তুলতে গেলে তার ওপর হামলা চালানো হয়।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাঈদের ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা মোহামেডান ক্লাব থেকে সেনাকল্যাণ ভবন পর্যন্ত ফুটপাতে চাঁদাবাজি, ফুটপাতের দোকানগুলোয় দুধ-চা পাতা সরবরাহ, মাদক বাণিজ্যসহ অবৈধ আয়ের সব উৎস নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।

এলাকায় ইয়াবার ডিলার হিসাবে সক্রিয় জামালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হত্যা, অস্ত্রসহ অন্তত ৬টি মামলার আসামি শফিকুল ইসলাম ইকবাল ওরফে নাইন ইকবাল (নাইন এমএম পিস্তলসহ গ্রেফতার হওয়ায় তিনি নাইন ইকবাল হিসাবে পরিচিতি পান)। এছাড়া এই এলাকা থেকে চাঁদা তোলার কাজ করে জয়, মোস্তফা ও বসির। সেনাকল্যাণ ভবনের পাশের একটি মার্কেটের চারটি দোকানও দখল করেছে জামাল ও তার সহযোগীরা।

এছাড়াও অবজারভার ভবনের পাশে জায়গা দখল করে ১৫/১৬টি দোকান বানিয়ে ভাড়া দিয়েছে জামাল। এখান থেকে মাসে অন্তত ৪ লাখ টাকা ভাড়া আসে। আর আরামবাগ প্রেস এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে আকাশ। প্রেসে যারা কালি, কাগজসহ বিভিন্ন ধরনের মালামাল সরবরাহ করেন, তাদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়।

এছাড়া মতিঝিলের হোটেল পূর্বাণীতে রাতের আসরে মাদক সরবরাহ করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন আকাশ। এই আকাশই স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোজাম্মেল হককে লাঞ্ছিত করেন।

জানতে চাইল মোজাম্মেল হক বলেন, সাঈদ প্রকাশ্যে আসার পর মতিঝিল-আরামবাগ এলাকায় ক্যাসিনো গ্রুপ ফের পুরোমাত্রায় সক্রিয়। তারা এরই মধ্যে আরামবাগে রাজাকার ভবন হিসাবে পরিচিত হাজীর বিল্ডিংয়ের পেছনের অংশে চারটি কক্ষ ফের দখলে নিয়েছে। মতিঝিল এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ময়লা তোলার ব্যবসা করেন মর্জিনা আক্তার।