• ঢাকা
  • সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২৯ পূর্বাহ্ন

কালের আবর্তনে ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি ও গাড়িয়াল পেশা


প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ৯, ২০২৪, ১০:৩৩ অপরাহ্ন / ২২
কালের আবর্তনে ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি ও গাড়িয়াল পেশা

মানছুর রহমান জাহিদ, পাইকগাছা, খুলনাঃ “বউ চলেছে বাপের বাড়ি, গাঁয়ের পথে গরুর গাড়ি- গাড়ির উপর আছে ছই, বউয়ের সাথে যাবে সই” কবিতার লাইনগুলো কিছু কাল আগেও বাস্তবে প্রচলিত ছিল। কিন্তু এমন দৃশ্য বর্তমানে অদৃশ্য প্রায়। বর্তমানে শহর তো দূরের কথা গ্রামাঞ্চলেও এখন গরুর গাড়ির দেখা পাওয়াটা বড়ই দুষ্কর। অথচ এমন এক সময় ছিলো যখন গ্রাম-গঞ্জের মানুষদের একমাত্র বাহন ছিল গরুর গাড়ি। সেটি খুব বেশি সময় আগের কথা নয়। ২০-২২ বছর আগেও এইসব গরুর গাড়ির কদর ছিল অনেক বেশি। কিন্তু এখন কালের আবর্তনে ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই গরুর গাড়ি। সেই সাথে হারিয়ে যেতে বসেছে গাড়ি ও চাকা তৈরির পেশাও। বর্তমানে মোটরসাইকেল, রিকশা-অটোরিকশা, ইঞ্জিন ভ্যান, টেম্পু, থ্রি-হুইলারের মতো দ্রুত গতির যানবহনগুলো সেই জায়গা দখল করেছে।

অপরূপ গ্রাম-বাংলার হারিয়ে যাওয়া এক মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যের ঐতিহ্য ‍এই গাড়ি। একটা সময় খুলনার পাইকগাছা উপজেলার গ্রামাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বাহন ছিল গরুর গাড়ি। প্রযুক্তির ছোঁয়া ও দ্রুত গতির যানবহনের কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গরুর গাড়ি ও গাড়িয়াল পেশা। সময়ের ব্যবধানে এখন এই গরুর গাড়ি স্থান পেয়েছে সংবাদপত্র ও বইয়ের পাতায়। কিছু কিছু উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে এখনও দেখা মেলে কিছু গরুর গাড়ি। এসব গরুর গাড়ি যারা চালান তাদের বলা হয় গাড়িয়াল।

গ্রাম-বাংলার জনপদে কৃষি ফসল ও বিয়ে, এমন কি নতুন বৌ আনা-নেয়া করা হতো গরুর গাড়িতে করে। এছাড়াও মানুষ পরিবহণের অপরিহার্য প্রিয় বাহন দুই চাকার গরুর গাড়ি থাকলেও যান্ত্রিক ছোঁয়া আর ডিজিটাল পদ্ধতির কাছে হার মেনে বিলুপ্তপ্রায় এ পেশাটি। মাঝেমধ্যে প্রত্যন্ত এলাকায় দু-একটি গরুর গাড়ি চোখে পড়লেও শহরাঞ্চলে একেবারেই দেখা যায় না। সে কারণে শহরের ছেলেমেয়েরা তো দূরের কথা, বর্তমানে গ্রামের ছেলেমেয়েরাও গরুর গাড়ির শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়। আবার অনেক শহরে শিশুরা গরুর গাড়ি দেখলে বাবা-মাকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে এটা কী?

গরুর গাড়ি দুই চাকাবিশিষ্ট গরু বা বলদে টানা এক প্রকার বিশেষ যান। এ যানে সাধারণত একটিমাত্র অক্ষের সাথে চাকা দুটি যুক্ত থাকে। গাড়ির সামনের দিকে একটি জোয়ালের সাথে দুটি গরু বা বলদ জুটি মিলে গাড়ি টেনে নিয়ে চলে। সাধারণত চালক বসেন গাড়ির সামনের দিকে। আর পেছনে বসেন যাত্রীরা। বিভিন্ন মালপত্র বহন করা হয় গাড়ির পেছন দিকে। বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য ও ফসল বহনের কাজে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল ব্যাপক।

কৃষক সমাজে যুগ যুগ ধরে ফসল বপন ও কৃষি পণ্য বহনের গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে পরিচিত ছিল গরুর গাড়ি। একটা সময় কৃষি কাজে গরু দিয়ে হালচাষ করা হতো। কিন্তু, এখন পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, থ্রি-হুইলারের মতো আধুনিক যানবহন ও যন্ত্রপাতির কারণে গরুর গাড়ির আর প্রয়োজন হয় না।

ধান কাটার সময় লাইন ধরে গরুর গাড়িতে করে ধান নেয়া হতো কৃষকের উঠানে। গাড়িয়ালদের ভাওয়াইয়ার সুরে মুগ্ধ হতো কৃষক-কৃষাণি। গরুর গাড়িতে চড়ে বর-বধূ যেত। এই গাড়ি ছাড়া বিয়ে হতো না। বিয়ের একমাত্র বাহন ছিলো গরুর গাড়ি। বিয়ের অনুষ্ঠানে বরযাত্রী যেত গরুর গাড়ি নিয়ে। সারিবদ্ধ গরুর গাড়ি দেখার জন্য রাস্তার দুপাশে মানুষ ভিড় করতো। আর তাই চালকে উদ্দেশ্য করে নববধূ বলতো,”ওকি গাড়িয়াল ভাই, আস্তে চালাও গাড়ি, আরেক নজর দেখিবার নাও মুই দয়ার বাপের বাড়িরে গাড়িয়াল”।

নবান্ন নতুন বছরকে ঘিরে আয়োজন করা হতো গরুর গাড়ির দৌড় প্রতিযোগিতা। হাজার হাজার গ্রাম বাংলার মানুষ প্রত্যক্ষ করতো প্রতেযোগিতার দৃশ্য। এসবের কিছুই নেই এখন। খুলনার পাইকগাছা অঞ্চলের গ্রাম বাংলা থেকে ঐতিহ্যবাহী গরুর গাড়ি হারিয়ে যাওয়ায় এসব অনুভূতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বর্তমান যুগের ছেলেমেয়েরা। আধুনিকতার প্রবাহে ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনেক কিছু আমরা হারাচ্ছি। আমাদের জীবন থেকে হারাচ্ছে এ রকম নানা ঐতিহ্য।