• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৮:২৫ পূর্বাহ্ন

ব্যয় সংকোচন : বিসিএস প্রশাসন ও পুলিশের ১২০ কর্মকর্তা অবসর ঝুঁকিতে


প্রকাশের সময় : অক্টোবর ২১, ২০২২, ১২:০০ অপরাহ্ন / ৯২
ব্যয় সংকোচন : বিসিএস প্রশাসন ও পুলিশের ১২০ কর্মকর্তা অবসর ঝুঁকিতে

বিশেষ প্রতিনিধি,ঢাকা: বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের তিনটি ব্যাচের অন্তত ৯০ জন কর্মকর্তা এবং পুলিশ প্রশাসনের ১৫তম ব্যাচের ৩৩ জন কর্মকর্তা রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে নানা সময়ে পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন। তাঁরাই এখন মূলত সরকারের অবসরে পাঠানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে অবসরে পাঠানো তথ্য ও সম্প্রচার সচিব মকবুল হোসেন প্রশাসন ক্যাডারের দশম ব্যাচের কর্মকর্তা ছিলেন। আর পুলিশে পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন ১২তম ব্যাচের দুজন কর্মকর্তা। তাদের দুজনকেই অবসরে পাঠানো হয়েছে। বাকি যে এসপিকে অবসরে পাঠানো হয়েছে তিনি ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা এবং বঞ্চিতদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন। এই ব্যাচের কর্মকর্তারা এখন অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিআইজি পদে পর্যন্ত আছেন।

একাধিক সাবেক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অবসরে পাঠানো হলে পুলিশের ক্ষেত্রে এই হিসাব ২৭তম ব্যাচ পর্যন্ত যেতে পারে বলে গুঞ্জন আছে। কারণ এই ব্যাচের কর্মকর্তারা এখন মাঠ পর্যায়ে পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সে ক্ষেত্রে ২৭তম ব্যাচ পর্যন্ত ধরলে পুলিশে বঞ্চিত কর্মকর্তার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২২৫ জনের মতো। কিন্তু এত কর্মকর্তাকে তো আর একসঙ্গে অবসরে পাঠানো সম্ভব নয়; যদিও তাঁদের সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আবার প্রশাসন ক্যাডারে জেলা প্রশাসক পদ বিবেচনায় নিলে ২৪তম ব্যাচের পর্যন্ত যাঁরা বঞ্চিত হয়ে আছেন তাঁরাও ঝুঁকির হিসাবে যুক্ত হবেন। এই হিসাবে ঝুঁকিতে থাকবেন আরো তিন শর বেশি কর্মকর্তা। প্রশাসনের এত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে হয়তো অবসরে পাঠাবে না সরকার। কিন্তু অবসরের চলমান প্রক্রিয়ার কারণে এসব কর্মকর্তা আতঙ্কে বা শঙ্কায় আছেন। সরকারের একাধিক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, এই কর্মকর্তাদের সরকার পদোন্নতি দিচ্ছে না। কিন্তু তাঁদের পেছনে প্রতি মাসে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। তবে সরকার স্পষ্ট কোনো কারণ না বলায় প্রশাসনের ভেতরে অস্থিরতা চলছে।

আবার আরেক পক্ষ বলছে, গত ১৪ বছরে পদের চেয়ে অনেক বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারে অতিরিক্ত সচিবের পদ আছে ২১২টি। এর বিপরীতে কর্মকর্তা আছেন ৪২৭ জন। যুগ্ম সচিব পদ ৪৩৩টি। কর্মকর্তা আছেন ৭১৬ জন। উপসচিবের পদ আছে এক হাজার ৭৩টি। এই পদে কর্মকর্তা আছেন এক হাজার ৬৩৩ জন। ফলে পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে হতাশায় থাকা সবাইকে অবসরে পাঠালেও প্রশাসনে কর্মকর্তা সংকট হবে না। বরং কিছুটা শৃঙ্খলা ও সমন্বয় বাড়বে। এত বেশি না হলেও পুলিশের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা চলছে। গত চার দিন সচিবালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকে এখন সহকর্মীদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করছেন। অনেকে কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না। এ নিয়ে কথা বলতে চাইলে একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, সময় ভালো না, নাম উল্লেখ করে কিছু লিখবেন না।

আইনজীবী মনজিল মোর্শেদ বলেন, সরকার কেন অবসরে পাঠাচ্ছে তা বলে দেওয়াই ভালো। না বলার ফলে প্রশাসনে অস্থিরতা তৈরি হবে। এতে সরকারে কাজও ব্যাহত হবে। অবসরে পাঠানোর যেসব কারণ এখন পর্যন্ত আলোচনায় আছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে সুবিধাভোগী বা ওই সময় নিয়োগপ্রাপ্ত এবং এসব কারণে গত ১৪ বছর পদোন্নতিবঞ্চিত, দেশে-বিদেশে সরকারি তথ্য পাচার, অনিয়ম, অসদাচরণ ও নিষ্ক্রিয়তা। যেমন তিন পুলিশ সুপারের অবসরের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারবিরোধী প্রচারণা, ঠিকমতো অফিস না করার অভিযোগ আছে। তবে তথ্যসচিব মকবুলের বিষয়ে অবসরের কারণ নিয়ে সরকারের মন্ত্রী বা সচিব পর্যায় থেকে কোনো কথা বলা হয়নি। সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জনস্বার্থে তাঁদের অবসরে পাঠানো হয়েছে। সরকারি চাকরি আইন অনুযায়ী, চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হলে সরকার জনস্বার্থে, প্রয়োজন মনে করলে কারণ দর্শানো ছাড়াই অবসর দিতে পারে।

বহুল প্রচলিত সরকারি কর্মচারী আইন বইয়ের লেখক সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, বিএনপি সরকারও এভাবে অনেক কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কর্মকর্তারা আদালতে গেলে সরকার সব মামলায় হেরে যায়। কারণ জনস্বার্থে যে অবসরে পাঠানো হয়েছে তা সরকার পক্ষ আদালতে প্রমাণ করতে পারেনি। তিনি বলেন, এর কারণ, সরকারি কোনো কর্মকর্তা অপরাধ করলে তাঁর নামে বিভাগীয় মামলা হবে। বিভাগীয় মামলা না করে কর্মকর্তাদের সরাসরি অবসরে পাঠানোর ফলে কোনো মামলায় বিএনপি সরকারের পক্ষে তখন রায় যায়নি। ফিরোজ মিয়া বলেন, সরকার যে ধারায় কর্মকর্তাদের অবসরে পাঠাচ্ছে এর মূল উদ্দেশ্য হলো ব্যয় সংকোচন। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কর্মকর্তার প্রয়োজন হচ্ছে না বা সরকার এত কর্মকর্তা চালাতে পারছে না, তখন কারো চাকরির বয়স ২৫ বছর হলে সরকার ব্যয় সংকোচন নীতির আলোকে তাঁকে অবসরে পাঠাতে পারে। তখন তাঁর সব সুবিধা দিয়ে বিদায় করে দিতে হবে। তবে কাকে বাদ দেওয়া হবে এ জন্য একটা বাছাই কমিটি করতে হবে।

উদাহরণ হিসেবে সাবেক এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, বেসরকারি কিছু কম্পানি অনেক সময় আর্থিক সংকটে পড়লে এভাবে চাকরি থেকে কর্মীদের বাদ দেয়। কিন্তু সরকারের বেলায় বিষয়টা ভিন্ন। প্রজ্ঞাপনে সরকার জনস্বার্থের কথা বলছে। প্রশ্ন হচ্ছে, জনস্বার্থটা কী? কেউ যদি সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করে, অদক্ষ হয়, দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন না করে, যদি কোনো অপরাধ করে তাহলে অবশ্যই তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করতে হবে। এরপর আইন অনুযায়ী বিচার হবে। বিচার না করে সব সুবিধা দিয়ে এভাবে চাকরিচুত্য করা হলে উল্টো জনস্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে।