• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:৩৭ অপরাহ্ন

শীর্ষ নেতৃত্বের গ্রুপিং,নবীন-প্রবীণের দ্বন্দ্ব চরমে : যুব মহিলা লীগে হচ্ছেটা কী?


প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ২৫, ২০২১, ২:৪৮ অপরাহ্ন / ১৯৪
শীর্ষ নেতৃত্বের গ্রুপিং,নবীন-প্রবীণের দ্বন্দ্ব চরমে : যুব মহিলা লীগে হচ্ছেটা কী?

ঢাকা : সমালোচনা যেন পিছু ছাড়ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুব মহিলা লীগের। প্রতিষ্ঠার পর থেকে টানা দুই দশক একই নেতৃত্বে চলা সংগঠনটিতে স্বেচ্ছাচারিতা, শীর্ষ নেতৃত্বের গ্রুপিং এবং নবীন-প্রবীণের দ্বন্দ্ব চরমে। জাতীয় অনুষ্ঠানে সামান্য বিষয়ে ধাক্কাধাক্কি-হাতাহাতি থেকে মারামারির পর্যায়ে চলে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এ নিয়ে বেশ বিব্রত আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা।

জানা গেছে, ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠনটির নেতৃত্বে দুই দশক ধরে আছেন নাজমা আক্তার ও অধ্যাপিকা অপু উকিল। কয়েকবার সম্মেলন হলেও সভাপতি-সম্পাদক পদে পরিবর্তন আসেনি। যার কারণে স্বেচ্ছাচারিতা বেড়েছে সংগঠনে। বেড়েছে দীর্ঘদিন সংগঠন করে আসা নেতাদের সঙ্গে নবাগতদের দূরত্বও। এগুলো নিরসনের বদলে উসকে দেওয়ার অভিযোগ আছে সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে।

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে (১৬ ডিসেম্বর ২০২১) রাজধানীর ধানমন্ডিতে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ফুল দেওয়া নিয়ে ধাক্কাধাক্কি ও পরে মারামারির ঘটনা ঘটেছে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের মাঝে। এ নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর সকালে আওয়ামী লীগের বিজয় শোভাযাত্রার প্রস্তুতি সভায় ব্যাপক আলোচনাও হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম তাদের সতর্ক করেছেন, যেন শোভাযাত্রায় বিশৃঙ্খলা না হয়। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে বলেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

ধানমন্ডির ঘটনায় ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার সভাপতি ও সাবেক এমপি সাবিনা আক্তার তুহিনকে শোকজও করেছেন সংগঠনটির সভাপতি নাজমা আক্তার। শোকজের চিঠিতে মারামারি ছাড়াও বহুল আলোচিত পাপিয়াকাণ্ডও সামনে এসেছে। নোটিশে পাপিয়া ইস্যুতে সংগঠনটির প্রশ্রয়ের বিষয়টি উঠে এসেছে। এসব বিষয়ে ইতোমধ্যে ফেসবুকে পক্ষে-বিপক্ষে লেখালেখিও হচ্ছে। প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রকারান্তে সংগঠনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত সামনে নিয়ে আসছেন।

কী ঘটেছিল সেদিন? : ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনার বিষয়ে যুব মহিলা লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার সভাপতি ও সাবেক এমপি সাবিনা আক্তার তুহিন বলেন, ১৬ ডিসেম্বর ফুল দেওয়া নিয়ে ওখানে (ধানমন্ডি ৩২) কিছুই হয়নি। আমরা যুব মহিলা লীগের সব মেয়েরা দাঁড়িয়ে ছিলাম নাজমা আপা ও অপু দিদির জন্য। এর মধ্যে পেছনে ছেলেদের একটা মিছিলের ধাক্কা খেয়ে সব এগিয়ে গেছে। একই সময়ে অপু দিদিও এসেছেন। তার অনেক পরে এসেছেন নাজমা আপা। আমরা দাঁড়িয়েই আছি, কেউ ফুল দিচ্ছি না। সভাপতি-সম্পাদক এলে ফুল দেবো বলে। কিন্তু মাইকে বাবু ভাই (স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু) বারবার বলে যাচ্ছেন, আমরা একটা ফুল দিয়ে চলে যেতে। উনি বারবার আমার নাম বলছেন, অন্য কাউকে তো চিনেনও না। এমনকি একটা ফুলও দিয়েছেন আমাকে, দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির আগে আমাদের মহানগর শাখার ফুল দেওয়া তো শোভা পায় না। তাই দেইনি।

ফুল দেওয়ার সময় একটু আধটু ধাক্কাধাক্কি হয়। এ নিয়ে আমাদের আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ সতর্ক করেছেন। তারা বলেছেন, যাতে শোভাযাত্রায় কোনো সমস্যা না হয়। আমরা সেভাবেই বিষয়টি দেখেছি। অনেক পরে সভাপতি নাজমা আপা এসেছেন। উনার জন্য আমরা জায়গাও করে দিয়েছি, ভিডিও ও ছবিতে দেখবেন। কিন্তু উনি নিজ জায়গায় না এসে আমার পেছনে চলে এসেছেন। তখন আপার সঙ্গে থাকা অন্যরাসহ সবাই দেখলাম পেছন থেকে আমাকে ঘুষাইতেছেন। উনি (নাজমা আক্তার) আমার সঙ্গে ফুল দেবেন না, এমন একটা ভাব। আমাকে বের হয়ে যেতে বলেছেন। আমি বললাম আপা, যে অবস্থা কেমনে বের হবো? পরে উনার সঙ্গে মেয়েরাও আমার চুলে ধরেছে। দেখলাম নিজের একটা সম্মান নষ্ট, এই পরিস্থিতিতে আমি ফুল না দিয়ে বের হয়ে চলে এসেছি।

সাবেক এই এমপি বলেন, আমি চলে আসার পর আমার শাখার মেয়েদের একা পেয়ে লিলি, রিমি, লাবনী, সুমি, কানিজ, লুৎফাসহ নাজমা আপার অনুসারীরা গাছের ডাল ভেঙে, পুলিশের লাঠি নিয়ে পিটিয়েছেন। এতে আহত হয়েছেন মিরপুর থানা সভাপতি ফেন্সি আহমেদ, ১৩ নম্বর ওয়ার্ড সভাপতি নিপা, সাধারণ সম্পাদক শাহীনুর, রূপনগরের সাধারণ সম্পাদক লাইজু, দারুস সালামের সভাপতি আয়েশা আক্তার নীলা, সহ-সভাপতি সুপ্তী, ঢাকা মহানগরের সদস্য দোলা, তেজগাঁওয়ের বিথিসহ অনেকে। প্রত্যেকের অবস্থা খারাপ, আমি কিন্তু ফেসবুকে ছবি দিয়েছি।

সাবিনা আক্তার তুহিন বলেন, উনি (সভাপতি নাজমা আক্তার) আমাকে সঙ্গে নিয়ে ফুল দেবেন না। আবার আমরা আলাদা ফুল দিলেও দোষ। তাহলে করবো কী? আমার তো পদ আছে। উনি আমাকে অপছন্দ করতে পারেন, আমার পদ তো অস্বীকার করতে পারেন না।

 কী আছে কারণ দর্শানোর নোটিশে? : পাপিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাসহ চারটি বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর যুব মহিলা লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি সাবিনা আক্তার তুহিনকে। ওই চিঠিতে প্রথম কারণ হিসেবে বলা হয়, আপনি ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় দিবস উদযাপন এবং শ্রদ্ধা নিবেদনের আগে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় অসাংগঠনিক কর্মকাণ্ড করেছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নাজমা আক্তারসহ অনেককে অপমান, নাজেহাল এমনকি শারীরিকভাবে আহত ও লাঞ্ছিত করেছেন। জাতির পিতার রক্তের স্মৃতি বিজড়িত ৩২ নম্বর বাড়ি আমাদের পবিত্র স্থান, আবেগ, অনুভূতির জায়গা। সুবর্ণজয়ন্তীর একটি ঐতিহাসিক দিনে আপনার ও আপনার কর্মীদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির অনেককে চোখের জল নিয়ে বাড়ি ফিরতে হলো। এর প্রকৃত এবং গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান করুন।

দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা হয়, আপনি ২০১৭ সালের ২৪ জুলাই থেকে দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় সাড়ে চার বছরে কোনো থানা, ওয়ার্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন করে কমিটি গঠন করেননি। এর ফলে দলীয় কর্মীরা পদ এবং অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। সাংগঠনিক নিয়ম মেনে আপনার দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত না করার ফলে দল সুসংগঠিত হচ্ছে না, অথচ পদ আঁকড়ে আছেন। এর সুনির্দিষ্ট এবং যথাযুক্ত ব্যাখ্যা প্রদান করুন।

এরপরের কারণে বলা হয়েছে, নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক (শামীমা নূর) পাপিয়া আপনার দীর্ঘদিনের পারিবারিক বন্ধু। তার অপকর্মের জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে গড়া সংগঠন যুব মহিলা লীগ দেশে-বিদেশে অনেক সমালোচনার মুখে পড়ে। আপনার বিরুদ্ধে পাপিয়াকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আছে। এর প্রকৃত ও গ্ৰহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান করুন।

চিঠিতে শেষ কারণ হিসেবে বলা হয়, গত ১৭ ডিসেম্বর আপনি আপনার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখেছেন নাজমা আক্তার ১/১১ এর সময় আপনাকে কোর্ট ও সাবজেলে যেতে নিষেধ করেছিল এবং নাজমা আক্তার শেখ হাসিনার মুক্তি আন্দোলনে অংশ না নিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন। আপনার উপরোক্ত বক্তব্যের উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ আপনাকে হাজির করার নির্দেশ প্রদান করা হলো।

চিঠির শেষদিকে বলা হয়, এমতাবস্থায়, সংগঠনের শৃঙ্খলা ও স্বার্থপরিপন্থি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে আপনার বিরুদ্ধে কেন সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তার ব্যাখ্যাসহ লিখিত জবাব বুধবার (২২ ডিসেম্বর) থেকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে যুব মহিলা লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হলো। একই সঙ্গে পরবর্তী নির্দেশ দেওয়া ব্যতীত আপনাকে যুব মহিলা লীগের সব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হলো।

শোকজ নিয়ে সাবিনা আক্তার তুহিনের বক্তব্য : শোকজের বিষয়ে সাবিনা আক্তার তুহিন বলেন, আমি নেত্রীর (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) কর্মী। সংগঠন করি। সাংগঠনিক কোনো বিষয়ে আমাকে কেউ দোষারোপ করতে পারবে না। আমি সাংগঠনিক কাজ ঠিকঠাকই করি। তবে ব্যাগ টানার রাজনীতি করি না। উনি (সভাপতি নাজমা আক্তার) উনার রাজনীতি করুক, আমি আমারটা করি। আমাকে মারলেন, সেটিও তো আমি অভিযোগ করিনি। কিন্তু তারা আমার কর্মীদের মারধরের ঘটনা ধামাচাপা দিতে এখন এই শোকজ সামনে নিয়ে এসেছেন। আমি তো কোনো অন্যায় করিনি, যারা অন্যায় করেছেন, তাদের তো কিচ্ছু হচ্ছে না। আমাকে নেতা বানিয়েছেন নেত্রী (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা)। আমি নেত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।

এ বিষয়ে দারুস সালাম থানা যুব মহিলা লীগের সভাপতি আয়েশা আক্তার নীলা তার ফেসবুকে লিখেছেন, আমি নিজে ওই ঘটনায় উপস্থিত ছিলাম। আমার মতো ওই ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে অনেকেই ছিলেন। আমার সাথের বন্ধুরাও অনেকে আহত হয়েছেন। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে মুখ খোলেননি। এখন না বলে আর পারছি না। নাজমা আপাসহ তার বাহিনীরা আমাদের কাউকেই নিস্তার দেননি। বিভিন্ন জায়গায় আমাদের বিভিন্নভাবে আহত করেছেন। লাঠি বাঁশ নিয়ে তারা যেভাবে আমাদের দিকে এগিয়ে এসেছেন, মনে হয়েছে তারা পূর্বপরিকল্পনা করে এ অনুষ্ঠানে এসেছেন। সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের কাছে আমার এই ক্ষুদ্র কর্মীর আকুল আবেদন, এর সুষ্ঠু তদন্ত করে সঠিক বিচার পাইয়ে দিয়ে আমাদেরকে উপকৃত করবেন।

জানতে চাইলে যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অপু উকিল বলেন, ফুল দেওয়ার সময় একটু আধটু ধাক্কাধাক্কি হয়। এ নিয়ে আমাদের আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ সতর্ক করেছেন। তারা বলেছেন, যাতে শোভাযাত্রায় কোনো সমস্যা না হয়। আমরা সেভাবেই বিষয়টি দেখেছি।

এসব বিষয়ে বক্তব্য নিতে বারবার চেষ্টা করেও যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তারকে পাওয়া যায়নি। একবার ফোন রিসিভ করে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, আমি তো ফোন ধরছি না। আমি একটু ব্যস্ত আছি মিটিংয়ে। সন্ধ্যার পর ফোন দিয়েন।তার কথা মতো (২১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যার পর কল করলেও নাজমা আক্তারের সাড়া মেলেনি।