• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০২:০২ অপরাহ্ন

প্রেমের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেয়াই তার মূল পেশা


প্রকাশের সময় : জুন ২, ২০২৩, ৪:৫৪ অপরাহ্ন / ৩৯
প্রেমের ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতিয়ে নেয়াই তার মূল পেশা

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাভার, ঢাকাঃ নাম শিলা (৪০)। বসবাস করেন সাভার উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নের আকরাইন গ্রামে। আয়ের উৎস হিসেবে দৃশ্যমান কোনো পেশা নেই তার। লোকদেখানো সূদ ব্যবসার অন্তরালে প্রধানত দেহব্যবসার সাথে সাথে টার্গেটকৃত পুরুষদের সাথে কথিত প্রেমের সম্পর্ক গড়ে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণাই বহুরুপী এই নারীর মূল পেশা। তার প্রতারণার জালে জড়িয়ে সর্বশান্ত হয়েছেন ডজন খানেক পুরুষ। এমনকি তার ছলনা ও প্রতারণার হাত থেকে রেহাই পাননি খোদ পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা। শিলা নামে সেই বহুরুপী নারীর প্রেমের ফাঁদে পড়ে প্রায় দশ লক্ষ টাকা খুইয়ে পথে বসেছেন বলে অভিযোগ তুলে শাহাদাত নামের এক যুবক এভাবেই তার প্রতারিত হওয়ার রোমহষর্ক ঘটনার বর্ণনা দিলেন।

ঘটনার বর্ণনায় প্রতারণা শিকার ভুক্তভোগী শাহাদাত হোসেন জানান, গেল বছরের আগষ্ট মাস। অর্থাৎ মাস দশেক আগের কথা। সাভার উপজেলাধীন বিরুলিয়া ইউনিয়নের আকরাইন গ্রামের শিলা নামের (৪০) সেই নারীর সাথে রং নাম্বারে পরিচয় ঘটে নারায়নগঞ্জের চাষাড়া এলাকার বিকাশ ব্যবসায়ী শাহাদাত হোসেনের(৩১)। পরিচয়ের সূত্র ধরে শুরুতে মাঝে মধ্যে মুঠোফোনে একটু আধটু মতবিনিময়ের সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সামনাসামনি একে অপরকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। প্রথমবার সাক্ষাৎ লাভে শিলার পূর্বনির্ধারিত স্থান হিসেবে বিরুলিয়া ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় সুদূর নারায়নগঞ্জের চাষাড়া থেকে ছুটে এসেছিলেন শাহাদাত। প্রায় ঘন্টাখানেকের মিষ্টি-মধুর আলাপ শেষে ফিরে যান নারায়ণগঞ্জে। এরপর মুঠোফোনে দুজনের অহরহ আলাপচারিতার মাত্রা ও বিষয় স্বাভাবিক পর্যায় ছাপিয়ে ঐকান্তিক এক গতিপথ সৃষ্টির সাথে সাথে শুরু হয় দুটি হৃদয়ের ভাব-বিনিময়! আন্তরিকতা, ভাব-আবেগ আদান-প্রদানের মাত্রা চুড়ান্ত পর্যায় অতিক্রম করে এবার প্রেম নিবেদনের পালা! দুটি হৃদয়ের ঐকান্তিক সম্মতির পরিনামে প্রেমের সম্পর্কে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ার এক পর্যায়ে একে অপরের মন যোগাতে পছন্দের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি,রোমাঞ্চ ও ভবিষ্যত পথচলায় ভাবি চিরসঙ্গীর সঙ্গে আনন্দ-বিনোদনের সাগরে নিমজ্জিত! বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে বদ্ধপরিকর দুটি মন! এরই মধ্যে শিলা শাহাদাতকে নিয়ে উত্তরখান এলাকায় বিপুল নামে এক ব্যাক্তির বাসায় নিয়ে যান। মামাতো ভাই ও অভিভাবক পরিচয়ে বিপুলের বাসাতেই বিয়েসাদীর বিষয়ে কথা হয় তাদের। এসবই ঘটে পরিচয়ের মাত্র মাস খানেকের মধ্যেই।

এরইমধ্যে সিদ্ধান্ত পাক্কা; খুব তাড়াতাড়িই বিয়ের পীড়িতে বসছেন দুজন। ফলে ভাবি স্ত্রীর আবেদনে সাড়া যুগিয়ে গহনাগাঁটি কেনাকাটার প্রয়োজনীয়তাও তো খুবই স্বাভাবিক! নারায়নগঞ্জের চাষাড়া অর্থাৎ নিজের ক্ষুদ্র বিকাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আশপাশের একটি পরিচিত জুয়েলারির দোকান থেকে গত ২৭ সেপ্টেম্বর ভাবি স্ত্রীর পছন্দই স্বর্ণের দুই জোড়া কানের দূলের সঙ্গে সঙ্গে একটি আংটিও কিনে ফেলেন। স্বতঃস্ফূর্ত মনে ভাবি স্ত্রী শিলার জন্যে গহনা কিনতে এর পরদিন ২৮ সেপ্টেম্বর স্বর্ণের চেইন কিনতে এক লক্ষ টাকা দেন তিনি।

শহাদাত আরো জানান,পরদিনই শিলার (৪০) চোখে সমস্যার কথা উল্লেখ করে তার মুঠোফোনে ফোন করে কান্নাকাটি জুড়ে দেন। আগামীকালই তার চোখ অপারেশন করাতে হবে বলে জানিয়েছেন ডাক্তার। অন্যথায় সে আর কোনোদিনই চোখে দেখতে পাবে না। সেদিনও তাকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আরো পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠান তিনি।

এরপর থেকে প্রায় প্রতিনিয়তই নানা সমস্যা যেনো পিছু ছাড়েনা শিলার। তার আকরাইনের ছয় শতাংশ জমির তিন শতাংশ জমি বিক্রির চেষ্টা চলছে। জমি বিক্রি হওয়ার সাথে সাথেই শাহাদাতকে তার সমস্ত টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে নিয়ম করে ধার হিসেবে বিভিন্ন অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয় শিলা। তার সুচারু অভিনয়, ছলচাতুরী ও প্রেমের মোহে অন্ধ হয়ে আগে-পিছে কোনো কিছু না ভেবেই দু-একদিন পরপরই শিলার ব্যবহৃত বিকাশ পার্সোনাল একাউন্টসহ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন অংকের অর্থ দিতেই থাকেন শাহাদাত।

এক পর্যায়ে হঠাৎ ব্যবসায়িক প্রয়োজনে জরুরি ভিত্তিতে ভাবি স্ত্রী শিলাকে চলতি মাসের মাঝামাঝিতে ফোন করে তার কাছে আপাততঃ পঞ্চাশ হাজার টাকা ফেরত চাইলে কোনো টাকা দিতে পারবে না বলে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় সে। শিলার আচরণে হঠাৎ এমন রহস্যময় পরিবর্তন লক্ষ্য করে তাৎক্ষণিকভাবে নিজের প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি আন্দাজ করেন শাহাদাত। তবে ভালোবাসার মানুষটি তার সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে;যেনো বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না তিনি। আরো একবার ফোন করে তার সমস্যা জানিয়ে ফের পঞ্চাশ হাজার টাকা ফেরত চাইলে,’কিসের টাকা,সে কোনো টাকাই নেয়নি’ বলে শিলার কর্কশ জবাবে বুক কেঁপে ওঠে শাহাদাতের! মাথায় হাত দিয়ে হিসেব মিলিয়ে শাহাদাত অগত্যা বুঝতে পারেন, বিগত দীর্ঘ আট মাস যাবত নিয়মিত ভাবি স্ত্রী শিলা জমি বিক্রি করে ফেরত দিবে জানিয়ে বিভিন্ন অংকের অর্থ হাতিয়ে নিতে নিতে তার ছোট্ট বিকাশ এজেন্ট ব্যবসায় পুঁজি হিসেবে খাটানো প্রায় লাখ দশেক টাকার পুরোটাই যে কব্জা করে নিয়েছে!

এদিকে শিলাকে ফোন করলে শিলাও আর আগের মতো ফোন রিসিভ করে না। রিসিভ করলেও তার উল্টো পাল্টা আচরণ লক্ষ্য করে প্রতারিত হওয়ার বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিতভাবে বুঝতে বাকি থাকেনা। উপায়ন্তর না পেয়ে শাহাদাত শিলার মামাতো ভাই উত্তরখান এলাকার বিপুলের সাথে যোগাযোগ করলে বিপুলও জানায়,শিলা তার কোনো মামাতে বোন নয়;ব্যবসায়িক প্রয়োজনে পরিচিত মাত্র। মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ে শাহাদাতের। কোনরূপ উপায় খুঁজে না পেয়ে সর্বশেষ ১৮ মে সরাসরি শিলার আকরাইনের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন শাহাদাত। কিন্ত শিলা তার সাথে অশালীন ব্যবহার করে তাকে তার বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলে; অন্যথায় লোকজন ডেকে তাকে মারধরের ভয়ভীতিও প্রদর্শন করে।

ভুক্তভোগী শাহাদাত জানান,কারণ হিসেবে নেপথ্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে আশপাশের লোকজনদের জিজ্ঞেস করতেই বহুরুপী নারী শিলার আসল পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হন শাহাদাত। আসলে দীর্ঘ আট মাস যার ছলনায় মত্ত হয়ে গভীর প্রেমে মগ্ন ছিলেন, ভাবি স্ত্রী হিসেবে শীঘ্রই বিয়ের পীড়িতে বসবেন বলে নিজের সর্বস্ব উজার করে দিয়েছেন; শিলা নামের সেই নারী বিবাহিত। দশ-বারো বছরের একটি কণ্যাসন্তানও রয়েছে তার। ভাবতেই শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু হিম হয়ে আসে তার।

আরো খোঁজখবর নিয়ে শাহাদাত জানতে পারেন,মিরপুরের রুপনগর আবাসিক এলাকায় বসবাসকালীন সময়ে এক গার্মেন্টস কর্মীর সাথে বিয়ে হয় শিলার। তার অনিয়ন্ত্রিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য বেশি দিন সে সংসার টেকেনি। এরপর মাসুদ নামে এক ব্যাক্তির সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে করে সে। বহুগামী নারী শিলার অসামাজিক কার্যকলাপে বিরক্ত ও অতিষ্ঠ হয়ে সামাজিক সম্মানের ভয়ে দ্বিতীয় স্বামী মাসুদও তাকে ফেলে পাড়ি জমান সৌদি আরবে। বর্তমানে শিলা একজন পেশাদার দেহব্যবসায়ী-ভয়ংকর এক প্রতারক চক্রের সক্রিয় সদস্য। তার প্রতারণার ফাঁদ থেকে রেহাই পাননি একাধিক পুলিশ কর্মকর্তাও।

শাহাদাত জানান, আকরাইনের জমি-বাড়িটিও তার নিজের টাকায় কেনা নয়। সেটিও পুলিশের এক কর্মকর্তার সাথে প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছে সে। আমার সাথে সম্পর্কে জড়ানোর আগে শিলা পুলিশের জনৈক এক এসআইয়ের সাথে সম্পর্কে জড়ায়। সেই পুলিশ কর্মকর্তার সরলতার সুযোগ নিয়ে নিজের বৈবাহিক জীবনের অতীত ও কণ্যাসন্তান থাকার বিষয়টি গোপন করে বিয়ের প্রলোভন দেখান। সেই পুলিশ কর্মকর্তাও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আকরাই নিজের নামে তিন শতাংশ ও শিলার নামে তিন শতাংশসহ ছয় শতাংশ জমি কেনেন। যার মূল্যবাবদ পুরো টাকাই তিনি পরিশোধ করেছিলেন। কিন্ত নিজের নামে জমি রেজিষ্ট্রেশনের পরই শিলার আসল চেহারা উন্মোচিত হয়। আত্মসম্মানের ভয়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তা নিজের নামের তিন শতসংশ জমি বিক্রি করে একরকম ‘ছেড়ে দে মা কেন্দে বাঁচি’ বলে পালিয়ে আসার মতো তার কবল থেকে রেহাই পান।

শাহাদাত আরো জানান, প্রতিদিন নতুন নতুন টার্গেটকৃত পুরুষদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো,দেহব্যবসা ও প্রতারণাই শিলার বর্তমান পেশা জানতে পেরে তিনি ভীষণভাবে ভেঙে পড়েন।

সর্বশেষ গত ২৫ মে স্থানীয় বিরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম মণ্ডলের নিকট তার প্রতারণার বিষয়ে বিচার দেন। কিন্ত চেয়ারম্যান তার বক্তব্যের কোনো পাত্তাই না দিয়ে উল্টো শিলার পক্ষে সাফাই গাইতে থাকেন। কোনো উপায় না দেখে সেখান থেকে বেড়িয়ে শেষবারের মতো ফের শিলার বাড়িতে গিয়ে তার হাতে পায়ে জড়িয়ে ধরে কাকুতিমিনতি করে আমার টাকাপয়সা ফেরত চাইলে সে ফের আমার সাথে চরম খারাপ ব্যবহার করে। আমার কাছ থেকে কোনো টাকপয়সা নেয়নি;এমনকি দীর্ঘ আট মাসের সম্পর্কের সবকিছুই অস্বীকার করে সে। পরবর্তীতে টাকাপয়সা দাবি কিংবা এধরণের কোনো বিষয়ে তার বিরুদ্ধে থানা পুলিশকে তো দূরের কথা -যে কাউকে জানালে আমাকে নারী শিশু নির্যাতন আইনে মিথ্যা ধর্ষন মামলায় ফাঁসিয়ে দিবে বলে ভয়ভীতি ও হুমকিধামকি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। এমতাবস্থায় আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। আমার টাকা ফেরত পাওয়া সাথে সাথে তার এমন পরিণতি কামনা করি;যেনো ভবিষ্যতে আমার মতো কারো সাথে এমন প্রতারণা করে সর্ব শান্ত করার সাহস না পায় সে।

তবে অভিযুক্ত শিলার মুঠোফোনে ফোন করে এ বিষয়ের সত্যতা জানতে চাইলে প্রথমে শাহাদাতের নিকট থেকে কোনো টাকা নেননি বলে তার অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেন। তবে শাহাদাতের বিকাশ এজেন্ট নাম্বার থেকে শিলার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরের বিকাশ পারসোনাল একাউন্টে বিভিন্ন সময়ে লেনদেনের হিসেবে সেই স্কিন শর্ট রয়েছে জানালে এবার সে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন,হ্যা। সত্যি বলতে, শাহাদাতের সাথে কিছুদিন আমার খুব ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিলো এবং সম্পর্ক থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে শাহাদাত আমার মোবাইলের বিকাশ নাম্বারে টাকা এনেছে সত্যি। কিন্ত সে টাকা তো সে নিজেই খরচ করেছে।

এদিকে আকরাইনের জমি কিভাবে কিনলেন সে সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে শিলা প্রথমে বলেন,আমার ছয় শতাংশ জমির মধ্যে আমি তিন শতাংশ বিক্রি করে দিয়েছি। অপরদিকে ওই জমি তিনি নিজে কেনেননি বরং প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে শিলা বলেন,হ্যা যিনি এই জমি কিনে দিয়েছিলেন তিনি আমার ভাই। কিন্ত তিনি কেমন ভাই এমন প্রশ্নের কোনে সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন পুরুষদের সাথে প্রতারণার অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন,সেটি আমার একান্তই ব্যাক্তিগত বিষয়। কোনো সাংবাদিককে এবিষয়ে কৈফিয়ত দিতে তিনি রাজি নন।

এ বিষয়ে বিরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম মন্ডল বলেন,বিষয়টি শুনেছি। অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে উভয় পক্ষকে ডেকে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করবো।