• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৫৩ অপরাহ্ন

ক্রেতা সংকটে মৃৎ শিল্প, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অস্তিত্ব হারাচ্ছে


প্রকাশের সময় : জুন ৪, ২০২৩, ২:২৯ অপরাহ্ন / ৩৬
ক্রেতা সংকটে মৃৎ শিল্প, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অস্তিত্ব হারাচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ আবহমান বাংলার ঐতিহ্য বহনকরা মৃৎ শিল্প সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হারতে বসেছে। আধুনিক সময়ে এসেও মান্ধাতা আমলের পদ্ধতি ব্যবহার করে জিনিসপত্র তৈরি করায় ক্রেতা সংকটে অস্থিত্ব হারাচ্ছে এই শিল্পটি। কেউ কেউ পরিবর্তন করছে পেশা, আর যাঁরা আঁকড়ে ধরে রেখেছেন তাদের জীবনমান সময়ের তুলনায় নিম্নমুখী ও কষ্টসাধ্য। তবে হাল ছাড়েনি অনেকেই, স্বপ্ন দেখছেন পুরনো দিনের সেই ব্যবসায়ী আমেজ ফেরত পাবার। এজন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার। এক সময় এই মৃৎশিল্প থাকা লালমনিরহাটের বিভিন্ন এলাকা গুলোতে ব্যস্ততা দেখা গেলেও বর্তমানে আধুনিক শিল্পের প্রসারে মৃৎশিল্পীর তৈরি জিনিসপত্র এড়িয়ে যাচ্ছে মানুষ। ফলে সময়ের সাথে সাথে অস্তিত্ব হারাচ্ছে শিল্পীরাও।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার পূর্ব দীঘলটারীর বাসিন্দা সত্তরউর্ধ যতিন পাল বলেন, কুমারী ব্যবসা আর চলে না, অনেক কষ্টে বাপ-দাদার পেশা ধরে আছি। ধর্মীয় উৎসবে প্রয়োজন শুধু এমন জিনিস তৈরি করে কোনোমতে দিনাতিপাত করছি। যতিন পাল জানান, তার বংশের প্রায় ১০ এর অধিক পরিবার একসময় এই পেশায় থাকলেও বর্তমানে তিনি ব্যতিত অন্যরা পেশা পরিবর্তন করেছে। একই এলাকার ষাটোর্ধ খর্গো পাল জানান, ছোটবেলা থেকেই এ কাজ করেন তিনি। বাপ দাদার দেওয়া পেশার বাহিরে অন্য কাজ শেখা হয়নি তাই পেশা পরিবর্তন করেননি। একার কাজে কষ্ট হওয়ায় গৃহিণীর সহযোগিতা নিয়ে এই পেশায় থেকে অনেক কষ্টে চলছেন। খর্গো পাল বলেন, বিশেষ সময়ে বাচ্চাদের জন্য খেলনা, শোপিজ বানানো হয়।তখন ব্যবসা ভালো চলে। আর বছরের অধিকাংশ সময়ে ধর্মীয় উৎসবের প্রয়োজনীয় মাটির জিনিস বানানো হয় যা দিয়ে সংসার চলে। খর্গো পাল সরকারের নিকট দাবি করে বলেন, প্লাস্টিকের ভীরে প্রায় মূল্যহীন আমরা। সবাই উন্নত হয়েছে। শুধু আমরাই পুরনো পদ্ধতিতে চলি, সরকার পেশা ও মৃৎ শিল্পীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সহজ শর্তে ঋণ দিলে আমরা বাজার চাহিদা অনুযায়ী জিনিসপত্র তৈরি করতাম। এতে ঐতিহ্য রক্ষা ও পেশা বেচে থাকতো।

একই এলাকার নারী মৃৎশিল্পী প্রমিলা বালা বলেন, অনেকে ব্যবসা পরিবর্তন করলেও আমরা অন্য কাজ জানিনা তাই পেশা পরিবর্তন করতে পারিনা। হাঁড়ি-পাতিল, পায়খানার পাটসহ নানা জিনিস বানিয়ে রাখি কিন্তু ক্রেতা কম এসব জিনিসের। সরকার সহযোগিতা করলে উপকৃত হতাম বলে জানান তিনি। সদর উপজেলার হারাটি কুমারপাড়ার বাসিন্দা বিনোদ চন্দ্র পাল বলেন, আগে ব্যবসা ভালো চলতো।অনেকেই পেশা ছেড়েছে। আমি খুব কষ্টে পেশা ধরে রেখেছি। সরকার নানা সুবিধা দিতে চেয়েছিলো কিন্তু দেয়নি। একই এলাকার অবিনাস চন্দ্র পাল বলেন,বর্তমানে সবাই প্লাস্টিকের জিনিসপত্র ব্যবহার করে। আর আমাদের তৈরি জিনিসের দাম তুলনামূলক বেশি, মাটিসহ প্রয়োজনীয় কাচামালের দাম বেশি মানুষ ক্রয় করে না। অনেকসময় খরচের সাথে বিক্রির দাম মিল না থাকায় লোকসান গুণতে হয়।

অবিনাশ পাল বলেন, হয়ত এই শিল্প এবং শীল মৃৎ শিল্প ও শিল্পীদের পেশা এবং তাদের অস্তিত্বের বিষয়ে লোকসংস্কৃতি গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রের আহবায়ক সূফী মোহাম্মদ বলেন, আবহমান বাংলার অন্যতম এক ঐতিহ্য ছিলো মৃৎশিল্প। এই মৃৎশিল্পীরা আজ তাদের পেশা থেকে সরে আসছে। বাজারে এখন প্লাস্টিক, লোহা, মেলামাইনসহ অন্যান্য পন্যের ভিরে মৃৎশিল্প একেবারে শেষ। তিনি বলেন, এই মৃৎশিল্পের উন্নয়ন যদি সম্ভব না হয় তাহলে একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে মৃৎশিল্পীরা। বর্তমানে মৃৎশিল্পীরা অর্থের যোগান ও প্রশিক্ষণের অভাবে মানসম্মত পণ্য তৈরি করতে পারছে না ফলে বাজার চাহিদায় নিজেদের পন্যকে খাপ খাওয়াতে পারছে না। লোক ঐতিহ্যের অংশ এই মৃৎশিল্প রক্ষার জন্য শিল্পীদের আধুনিক প্রশিক্ষণের আওতায় এনে প্রযুক্তির সমন্বয়ে পণ্য তৈরীতে সহযোগীতা, সহজ শর্তে লোন এবং সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা করা গেলে পুরোনো সফলতা ফের দরা দিবে এই শিল্পে। এজন্য প্রশিক্ষণ প্রদান, আর্থিক সহযোগীতা, লোন প্রদান কর্মসূচি পরিচালনা কারী অধিদপ্তরের নিকট দাবি জানিয়েছেন তিনি।

এ বিষয়ে সমাজ সেবা অধিদপ্তর লালমনিরহাটের উপ-পরিচালক মোঃ আব্দুল মতিন বলেন, কুমার-কামারসহ ৮টি পেশার মানুষের অর্থাৎ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী জীবনমান উন্নয়ন শীর্ষক কার্যক্রম জেলার পাঁচ উপজেলায় ২০১৭ সাল থেকে চলমান রয়েছে। প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের যাতায়াত ভাতা ও অনুদান দেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে এ সুবিধা পাবেন সকলপ্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জনগণ এবং এই সেবা প্রদান কার্যক্রম সমাজসেবার অব্যাহত থাকবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।