• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:৩৮ অপরাহ্ন

আমরা কোরআন শরিফ পড়তে পারতাম না, এখন পারি!


প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ১৭, ২০২৩, ৭:৫২ অপরাহ্ন / ৮৭
আমরা কোরআন শরিফ পড়তে পারতাম না, এখন পারি!

মোঃ রাসেল সরকারঃ আমরা কোরআন শরিফ পড়তে পারতাম না, এখন পারি। নামাজের জন্য যে সুরা ও দোয়া জানা দরকার সেগুলো আমরা শিখেছি। ধর্মীয় যেই আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে সেগুলো কীভাবে পালন করতে হয় তা শিখেছি। এমনকি আগে আমাদের কোনো হিজড়া মারা গেলে তার গোসল, জানাজা এসব আমরা করতে পারতাম না। এখন আমরাই আমাদের হিজড়াদের জানাজা দিতে পারবো। জানাজা দেওয়ার জন্য আমাদের আর কারও কাছে যেতে হবে না।’ কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম মাদরাসা ‘দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদরাসা’র শিক্ষার্থী ফারজানা রিয়া।

মাদরাসার আরেক শিক্ষার্থী সোনালী বলেন, গত দুই বছরে আরবি পড়া, নামাজের জন্য সূরা, দোয়া শেখা আর এখন কোরআন শরিফ পড়ছি। আগে এতটা জানা ছিল না। জানাজার নামাজ ও দোয়াটা জানতাম না। এখন সেটা পারি। কেউ মারা গেলে আমরা নিজেরাই জানাজা দিতে পারবো। যারা মুসলমান তাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি ইসলামের শিক্ষাটা গ্রহণ করা। ইসলামের বিষয়ে জানা ও আল্লাহকে খুশি করার জন্যই এখানে পড়ছি।

তিনি বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের কেউ মারা গেলে আগে অনেক সময় কেউ জানাজাও দিত না। এখন পর্যন্ত অনেক জায়গায় এই প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। অপয়া, অলক্ষ্মী বলে জানাজা না দেওয়া, অনেক গোরস্থানে কবর না দেওয়া এমনকি জানাজা দেওয়ায় ইমামের চাকরি চলে যাওয়ার পরিস্থিতি থেকে এখন মুক্তি পাবে। জানাজার জন্য অনুনয় বিনয় না করে নিজেরাই গোসল, জানাজা দিতে পারবে। এমনকি ৫ থেকে ৭ জন হিজড়াকে প্রস্তুত করা হয়েছে বাংলাদেশে কোথাও হিজড়া মারা গেলে তারা গিয়ে গোসল, জানাজা দিয়ে আসবে।

তিনি আরও বলেন, শুধু তাই নয়, কোরআন শরিফ তিলাওয়াত, কেরাত, গজল, আজান দেওয়া, উপস্থাপনাসহ ইসলামিক সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানগুলো কীভাবে পরিচালনা করতে হয় সেগুলো মাদরাসাটিতে শিখছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। ২০২০ সালের ৬ নভেম্বর রাজধানীর পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে লোহার ব্রিজ ঢাল এলাকায় মরহুম আহমেদ ফেরদৌস বারী চৌধুরী ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য দেশের প্রথম মাদরাসা ‘দাওয়াতুল কুরআন তৃতীয় লিঙ্গের মাদরাসা’ প্রতিষ্ঠা করেন মুফতি মুহাম্মাদ আবদুর রহমান আজাদ। দুই বছর পেরিয়ে বর্তমানে রাজধানীর ঢাকাসহ সারাদেশে মাদরাসাটির ৪১টি শাখা খোলা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার দয়াগঞ্জ, জুরাইন, মুগদা, বাড্ডাসহ বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ১২টি শাখা। ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহ সদরের কাঁচারিঘাটে প্রথম শাখা খোলা হয়। পরে পঞ্চগড, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি জেলায় এই মাদরাসার শাখা খোলা হয়েছে। সবশেষ মাদারীপুরের কালকিনি থানায় ৪১তম শাখা খোলা হয়েছে। দেশের ৬৪ জেলায় এর শাখা খোলার পরিকল্পনা রয়েছে মাদরাসা পরিচালকের।

মাদরাসাটিতে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত ক্লাস চলে। আবাসিক সুবিধা না থাকায় ক্লাস শেষেই শিক্ষার্থীরা চলে যান নিজেদের কাজে। কামরাঙ্গীরচরের মূল শাখায় বর্তমানে ২৫ জন শিক্ষার্থী ও তিনজন শিক্ষক রয়েছেন। আর সারাদেশে এই মাদরাসার ৪১টি শাখায় প্রায় ৬০ জন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে প্রায় এক হাজার তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থী শিক্ষা নিচ্ছে। ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শিক্ষকদের বেতনসহ সব খরচ চালানো হয়। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হয় না কোনো অর্থ। এর পাশাপাশি বেদেপল্লি, রিকশার গ্যারেজ ও পথশিশুদের জন্য রয়েছে অস্থায়ী মাদরাসা। যেখানে এক ঘণ্টার জন্য দেওয়া হয় কোরআন শিক্ষা।

মাদরাসাটি বাংলাদেশ কোরআন শিক্ষা বোর্ডের আওতায় নিবন্ধিত হয়েছে। বোর্ডের সিলেবাস অনুসরণ করে চলা মাদরাসাটি থেকে গত বছরই বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এতে ভালো ফলাফল করেছে তৃতীয় লিঙ্গের এই শিক্ষার্থীরা। কোরআন শিক্ষার প্রথম ও দ্বিতীয় ক্লাস এরই মধ্যে শুরু করা হয়েছে মাদরাসাটিতে। সবগুলো শাখায় একই সিলেবাসে চলবে মাদরাসাগুলো। এই সিলেবাস অনুসরণের ফলে ভবিষ্যতে মাদরাসাটি থেকে ধাপে ধাপে আলেম, হাফেজ, মুফতি হবেন বলেও আশা প্রতিষ্ঠানটির প্রধানের।

বাংলাদেশ কোরআন শিক্ষা বোর্ড সরকারের কাছ থেকে কোনোরকম অর্থ না নেওয়ায় অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো নিজেদের অর্থায়নেই চলে প্রতিষ্ঠানটি।

বিশৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, এমনকি খুনসহ নানা অপরাধে যেখানে জড়িয়ে পড়ে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা, সেখানে জীবনযাপন, আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় অনেকটা সুশৃঙ্খল হচ্ছে তারা। মাদরাসাটির ফলে ওইসব এলাকার তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবনমানে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।

মাদরাসাটির শিক্ষার্থী সোনালী বলেন, আমরা নিজেরা আগে একটু উশৃঙ্খল ও এলোমেলোভাবে চলাফেরা করতাম। এখন মাদরাসায় পড়ে অনেকটা শৃঙ্খলভাবে চলছি। একজন মানুষের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হবে, কীভাবে চলতে হবে, বুঝতে হবে তা আমরা এখন জানি ও বুঝি। মাদরাসাটি করা অনেক ভালো একটি কাজ। সবাই ভালো চোখে দেখছে, এগিয়ে আসে। মাদরাসা সম্পর্কে আমরাও এখন মানুষকে জানাচ্ছি এবং কীভাবে এটির আরও উন্নতি করা যায় তার জন্য কাজ করছি।

সাধারণ মানুষের মতোই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের আবেগ অনুভূতি মানবিকতা সব রয়েছে। সমাজের মূলধারা থেকে তাদের আলাদা করে রাখা হয়েছে। অথচ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের চেয়েও শিক্ষকদের বেশি সম্মান ও শ্রদ্ধা করা মানুষের মেধাশক্তিও সাধারণ মানুষের মতোই। মূল জনস্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন বলে জানান মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মুফতি মুহাম্মাদ আবদুর রহমান আজাদ।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের অবহেলিত জনগোষ্ঠী যাদের দিকে কেউ মনোযোগ দেয় না, তাদের পাশে এগিয়েও আসে না। আমরা সেই অবহেলিত জনগোষ্ঠীকেই টার্গেট করেছি তাদের কীভাবে মানবসম্পদে পরিণত করা যায়, একটু শিক্ষার আলো দেওয়া যায়। মূল জনস্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে দিতেই মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেটার কিছু লক্ষণও আমরা তাদের মধ্যে দেখতে শুরু করেছি। তাদের আচার-আচরণ, চলাফেরা, কথাবার্তা ও আমলের পরিবর্তন হয়েছে।

মাদরাসাটিতে আবাসিক ব্যবস্থা চালু না হওয়ায় এখনও শিক্ষার্থীদের তাদের বাসায়ই থাকতে হয়। ফলে এখনও অর্থ সংগ্রহ করেই তাদের জীবনধারণ করতে হয়। আবাসিক ব্যবস্থা চালু ও কর্মসংস্থানের সৃষ্টি না হওয়ায় তাদের অর্থ সংগ্রহের কাজটি বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে জানান মাদরাসার পরিচালক।

মুফতি মুহাম্মাদ আবদুর রহমান আজাদ বলেন, আমরা তাদের অর্থ সংগ্রহের কাজটি বন্ধ করতে পারছি না একটি কারণে তা হলো তাদের রিজিকের জন্য একটি কর্মসংস্থান দিতে পারছি না। মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্য এই নয় এখনই তাদের কাজটা বন্ধ করে দেওয়া। এটার উদ্দেশ্য তাদের আচার-আচরণ চলাফেরা মানসিকতাকে পরিবর্তন করা। এর ফলে যতদিন না তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে ততদিন তারা অর্থ সংগ্রহ করবে।

বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। তবে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংগঠনগুলো বলছে, তাদের সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে লিঙ্গ সমতা, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস, মানসম্মত শিক্ষা, কর্মসংস্থান, অবকাঠামোসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে কার্যক্রম ব্যবস্থা প্রয়োজন। যুগ যুগ ধরে এদেশে নানা অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী। তবে এসডিজি অর্জনে এসব বৈষম্য দূরীকরণের উদ্যোগ নেওয়ায় তাদের ভাগ্য কিছুটা আলোর পথ দেখছে। বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এই জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চলছে। যার অংশ হিসেবে ২০১৩ সালে তাদের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাদের শিক্ষা সহায়তার পাশাপাশি কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ, ভাতা, আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ নানা উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়ায় মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে যুগ পেরিয়ে যাবে। তাই তাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখনই কাজে লাগানোর কথা বলেন মুহাম্মাদ আবদুর রহমান আজাদ।

তিনি বলেন, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতে পারলে সরকার গার্মেন্টস, ট্রাফিক পুলিশিং ব্যবস্থাসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে তাদের কাজে লাগাতে পারবে। এর মাধ্যমে তাদের মানবসম্পদে পরিণত করা সম্ভব হবে।