• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৯:১১ অপরাহ্ন

আন্তর্জাতিক ইয়াবা কারবারি শাহআলমে সর্বশান্ত হাজারো প্রবাসী : চরম হুমকিতে প্রধান শ্রমবাজার


প্রকাশের সময় : অগাস্ট ২, ২০২১, ৩:১৬ অপরাহ্ন / ৮৭৫
আন্তর্জাতিক ইয়াবা কারবারি শাহআলমে সর্বশান্ত হাজারো প্রবাসী : চরম হুমকিতে প্রধান শ্রমবাজার

বিশেষ প্রতিনিধিঃ সহজ সরল ভদ্র চেহারার আড়ালে ছোট বেলা থেকেই অপরাধ প্রবন মানুষিকতার শাহআলম বর্তমানে দেশের শীর্ষ আন্তর্জাতিক ইয়াবা কারবারিদের ডন হিসেবে পরিচিত। সৌদি আরর রিয়াদের সিকিউরিটি প্রশাসন তার অনুসন্ধান শুরু করলে গত বছর দেশে পালিয়ে আসে। এরপরও একবছরে অন্তত ৫বার গিয়েছে সৌদিতে বিশাল বিশাল ইয়াবার চালান নিয়ে। দেশে বসেই হোয়াইট এপ, ইমু, মেসেঞ্জারে বিদেশে ইয়াবার কারবার পরিচালনা করে নিজস্ব একাধিক এজেন্ট দিয়ে। যেসবের বহু স্বাক্ষ প্রমাণও ইতিমধ্যেই হাতে এসেছে এই প্রতিবেদকের।

জুয়ার বোর্ডে জুয়াড়িদের সুদে অর্থ বিনিয়োগকারী জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত কুমিল্লা জেলা সদরের কালির বাজার ইউনিয়নের ধনুয়াখলা গ্রামের জসিম খানের ২য় ছেলে শাহআলম। ১২বছর আগে এসএসসি পরিক্ষায় ফেল করার পর বড় ভাইয়ের স্ত্রী’র গয়না বিক্রি করে কেনেন নকল এসএসসি পাশ সাটিফিকেট। কুমিল্লা সরকারি কলেজ ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়। এর কিছুদিন পরই পরিবার পরিবারের চাপে রুটিরুটি জোগাড় করতে পাড়ি জমায় সৌদি আরবের রিয়াদ শহরে। সেখানেই ডিশ মার্কেটে দোকানে কাজ করতে থাকে। পরে নিজেই ছোটখাটো একটি দোকান খুলে বসে ইলেকট্রিক ও ডিশ সামগ্রীর। ২০১৬ সালের প্রথম দিকে পরিচয় হয় সৌদি আরবের ইয়াবা কারবারি ও সৌদি পুলিশের সোর্স বরুড়া মহেশ পুর এলাকার মোতালেব ও বরুড়া পৌরসভার বেলভুজ এলাকার ইয়াবা মাফিয়া জুয়েল মোল্লার সাথে। এদের হাত ধরেই আন্তর্জাতিক ইয়াবা ব্যবসা শুরু করে শাহআলম। রহস্যজনক ভাবে জুয়েল মোল্লার মৃত্যু এবং এর কিছুদিন পর ৫হাজার পিস ইয়াবা ও ফিলিপাইনি এক নারীসহ সহ সৌদি গোয়েন্দাদের হাতে আটক হয় মোতালেব। ২০১৮ সাল সৌদির সকল খুচরা ব্যবসায়ীরা তখন শাহআলম এর হাতে চলে আসে। ভাগ্য খুলে যায় শাহআলমের সৌদির খুচরা ইয়াবা ডিলার শাহআলম, দেশে এসে বিশাল চালান নিয়ে প্রবেশ করে সৌদিতে। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এরপর বিভিন্ন ভাবে নতুন পুরাতন প্রবাসী, ওমরার যাত্রী ও কন্টাক্ট এজেন্ট দিয়ে ইয়াবা পাচার শুরু করে। রাতারাতি হয়ে ওঠে কোটিপতি। পরিচিত পায় সৌদির ইয়াবা ডন হিসেবে। বাংলাদেশ ও সৌদি, কাতার, দুবাই এয়ারপোর্ট তার ইয়াবার চালানসহ ধরা পড়লে নাম আসে পত্রিকায়।সৌদি পুলিশের হাতে ইয়াবা ও নারী সহ আটক মোতালেব দুই লাখ রিয়েলের বিনিময়ে ২মাস পরেই বেরিয়ে আসে জেল থেকে। এরপর শুরু হয় মোতালেব শাহআলম দ্বন্দ্ব।
সুচতুর শাহআলম প্রথমে নিজেই ইয়াবার চালান নিলেও এরপর থেকে ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে সহজ সরল প্রবাসী, বিপদগামী অসহায় দরিদ্র যুবতী ও যুবকদের লোভনীয় টোপ দিয়ে তাদের মাধ্যমে সৌদি সহ মধ্যে প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইয়াবা পাচার করতে থাকে। শাহআলম গত তিন বছরে কয়েক কোটি পিস ইয়াবা পাচার করেছে সৌদি আরব সহ মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। ইয়াবা পাচারের টাকায় ঢাকা ও কুমিল্লায় গড়েছেন আইপি টিভি চ্যানেল, ফ্লাট, প্লিট, বাড়ি, জমি সহ অঢেল সম্পদ।

কাতার, দুবাই, বাহরাইন, সৌদি আরবের জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম পুলিশ, সেসব দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস কর্মকর্তা, প্রবাসী ব্যবসায়ী ও সেসব দেশে কাজ করা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে ভয়ংকর সব তথ্য। সৌদিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের বরাত দিয়ে বিশিষ্ট প্রবাসী ব্যবসায়ী রিপন আকবর বলেন, আন্তর্জাতিক ইয়াবা কারবারিদের ফাঁদে পরে এই নেশায় জড়িয়ে সৌদি আরবের প্রবাসী যুবকরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ২০১৮ থেকে গত জুন মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত প্রায় সহস্রাধিক প্রবাসী শুধু মাত্র ইয়াবা সংক্রান্ত মামলায় আটক হয়েছে রিয়াদ, জেদ্দা, দাম্মাম, আভা, আল কাসিম সহ বিভিন্ন শহর থেকে। ইয়াবাসহ আটককৃত এসব প্রবাসীদের অধিকাংশই কুমিল্লার। বর্তমানের সৌদি আরব বিভিন্ন জেলে প্রায় সারে ৪ শতাধিক প্রবাসীর বেশির ভাগই কুমিল্লা সদর, সদর দক্ষিণ, বরুড়া, বুড়িচং ও আশেপাশের উপজেলার। মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্মের কারনে হুমকির মুখে রয়েছে সৌদির শ্রমবাজার। এসকল আন্তর্জাতিক ইয়াবা কারবারিদের প্রতিহত করা না গেলে দেশের প্রধান শ্রমবাজার যেমন ধ্বংস হবে তেমনি লাখ লাখ প্রবাসীরা সর্বশান্ত হচ্ছে এবং হবে।
রিয়াদের আরেক প্রবাসী ব্যবসায়ী মফিজুল ইসলাম জানান, সৌদিতে ইয়াবা কারবার নিয়ন্ত্রণ কারিদের অধিকাংশই কুমিল্লার কয়েকজন ইয়াবা মাফিয়া। এদের কারনে দেশের ভাবমূর্তি যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি প্রবাসীরা বিপদগামী হচ্ছে। ইয়াবার নেশায় আসক্ত হয়ে অপহরণ, হত্যা, ছিনতাই সহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে অনেকে। এতে করে সাধারণ প্রবাসীরাও বিপদের মুখে পরছেন। শীঘ্রই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে একসময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে সৌদির শ্রমবাজার।

কাতার দুবাই ও বাহারইনেও ইয়াবা পাচার জড়িত শাহাআলম সিন্ডিকেট। সেসব দেশের প্রবাসীদের বিশ্বস্ত সুত্রে প্রাপ্ত তথ্য এবং বিভিন্ন স্বাক্ষ প্রমাণের সত্যতা যাচাই করে দেখা যায় অন্তত ৫টি দেশে শাহআলমের শক্তিশালী ইয়াবা নেটওয়ার্ক রয়েছে। রয়েছে ইয়াবা বিক্রির নিজস্ব এজেন্ট। শাহআলম পাঠানো একাধিক চালান ধরাও পরেছে ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশের শহর ও এয়ারপোর্টে। দেশেও বেশ কয়েকটি ছোট বড় ইয়াবার চালান ধরা পরে প্রশাসনের হাতে। তবে নিজে ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে এজেন্ট দিয়ে কারবার করায় প্রতিবারই বেঁচে যায় মামলা থেকে। তবে গত ২৮ তারিখ সকালে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শাহআলম এর ব্যক্তিগত গাড়ি চালক কুমিল্লা কালির বাজার এলাকার সাদ্দাম হোসেন প্রায় ৯হাজার পিস ইয়াবা সহ আটকের পর সরাসরি তার নাম চলে আসে সমনে। খবর পেয়ে সেদিন ভোরেই বাসাবোর ১নাম্বার রোডের প্যারাডাইজ ভবন থেকে স্ত্রী কে নিয়ে পালিয়ে চট্টগ্রাম চলে যায় বলে জানা যায়। বিশ্বস্ত গোপন সূত্রে সাশআলমের এক সহযোগীর মাধ্যমে জানা যায়, ড্রাইভার সাদ্দামের রিমান্ড কাটাতে এবং মামলায় তার নাম যেন না আসে সেজন্য ৩০ লাখ টাকার অফার করেছেন এক এডভোকেটের মাধ্যমে। স্বেচ্ছাসেবক লীগ এডভোকেট নেতা ও আইবিএন টিভির কতিপয় সাংবাদিক এবিষয়ে দৌড়ঝাপ করছেন বলেও অনুসন্ধানে জানা যায়। এয়ারপোর্টে আটক সাদ্দাম এর আগেও গত বছর মার্চে ঢাকার একটি আন্তর্জাতিক কুরিয়ারের মাধ্যমে শাহআলম এর কাছে সৌদিতে বিপুল পরিমান ইয়াবা পাচার করতে গিয়ে মুন্সিগঞ্জ গজারিয়া এলাকার শাহআলম এর আরো ২সহযোগী সহ আটক হয়ে জেল খাটে। শাহআলম দেশে এসে হাইকোর্টের এক উকিলের মাধ্যমে জামিনে মুক্ত করে।

ইয়াবা কারবারের অবৈধ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে চালু করে অনলাইন আইপিটিভি আইবিএন নামের একটি টেলিভিশন। শুরুতে না বুঝলেও পরে শাহআলমের আন্তর্জাতিক ইয়াবা কারবার সম্পর্কে জানতে পেরে আইবিএন টিভির সেয়ার হোল্ডার, ডিরেক্টর, চিফ কো- অর্ডিনেটর, জাতীয় দৈনিক সবুজবাংলা, অন্যদিগন্ত ও কুমিল্লার স্থানীয় দৈনিক ডাক প্রতিদিনের সিনিয়র সাংবাদিক মাহফুজ বাবু সেখান থেকে সরে আসে। এরপর তাকে কয়েকবার ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে করে ব্যর্থ হয় শাহআলম। পরে চ্যানেলে বিনিয়োগকৃত তার অর্থ এবং পারিশ্রমিক চাইলে শাহআলম বিভিন্ন ভাবে তাকে হুমকি ধমকি দিতে শুরু করে। মিথ্যা মামলায় জড়ানোর চেষ্টাও করে বহু ভাবে। নিজের অনলাইন থেকে মনগড়া বানোয়াট সংবাদ পরিবেশন করে অপপ্রচার চালাতে থাকে। কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাদের দিয়ে আইসিটি মামলা সহ চাঁদাবাজির মামলা দায়ের জন্য তদবির করে ব্যার্থ হয়ে। কুমিল্লায় তার সহযোগী আন্তর্জাতিক ইয়াবা কারবারি মুরাদপুর এলাকার শামীম আহম্মেদ ও মেডিকেল এলাকার মাসুদের মাধ্যমে অপহরণ ও হত্যার চেষ্টায় ব্যার্থ হয়ে ইয়াবা দিয়ে পুলিশের কাছে ফাঁসিয়ে দেয়ার জন্য দশ লক্ষ টাকায় চুক্তিও করে। কয়েকবার হামলাও চালানোর চেষ্টা করে, তবে আগাম তথ্য থাকায় সতর্কতার কারনে প্রানে বেঁচে যায় তিনি। তবে সাদ্দাম শাহজালাল আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে আটকের পর থেকে সে আত্মগোপন করে রয়েছে। তবে সাংবাদিক মাহফুজ বাবুর বিরুদ্ধে শাহআলম ও তার সহযোগী আন্তর্জাতিক ইয়াবা কারবারিদের ষড়যন্ত্র অব্যহত রয়েছে।

মিয়ানমার থেকে আসা মাদক ইয়াবার চালানের বড় একটি অংশ পাচার হচ্ছে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে। মাদক সিন্ডিকেট প্রবাসী বাংলাদেশিদের টার্গেট করে ইয়াবার চালান পাচার করছে। সেসব দেশে একশ্রেণির প্রবাসী বাঙালির সহায়তায় গড়ে তোলা হয়েছে ইয়াবাবাজার। বিশাল বিস্তৃতি ঘটানো হয়েছে মাদক নেটওয়ার্কের।
সৌদিতে বাঙালি অধ্যুষিত প্রায় প্রতিটি শহরেই চলছে ইয়াবার রমরমা বাণিজ্য। দেশে বসে কিংবা বিদেশ থাকা সেখানকার একাধিক সিন্ডিকেট প্রধানদের আওতায় প্রায় ৪ শতাধিক ছোট বড় সেলাররা রাতদিন মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবা পৌঁছানোর কাজে ব্যস্ত থাকছেন।
প্রবাসী সূত্র জানান, সৌদিতে মাদক সিন্ডিকেটের তৎপরতার কারণে সে দেশে অবস্থানরত বাঙালিদের মধ্যে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। করোনা মহামারিতে থেমে নেই ইয়াবার কারবার। বিগত দিনে লগডাউনের করনে কিছুটা সঙ্কট দেখা দেয়ায় ১০০ থেকে ১৫০ রিয়েলেও বিক্রি হয়েছে, সরবরাহ বেশী থাকলে ৪০-৫০ রিয়েলে তা পাওয়া যায় বলে জানায়।
প্রবাসীদের অনেকেই জানিয়েছেন, ইসলামী রীতিনীতিকে প্রাধান্য দিয়েই সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান তৈরি হয়েছে। সে দেশে মাদক কেনাবেচা, বহন ও মাদক আখড়া গড়ে তোলার বিরুদ্ধে কঠোর আইন রয়েছে এবং মাদক মামলায় সৌদিতে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত কার্যকর রয়েছে। তা ছাড়া মাদকবাজার গড়ে তোলার পেছনে বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ উত্থাপিত হলে তা বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও দেশের শ্রমবাজার চরম হুমকির মুখে ফেলতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন সচেতন প্রবাসীরা। এদিকে মাদক পাচার ও বাজারজাতের ঘটনায় অনেক প্রবাসীর হাড়ভাঙা পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থের বড় অংশই ইয়াবা বাজারে খরচ হয়ে যাচ্ছে। এর কারন পাচারকৃত মদক ইয়াবার খদ্দের মুলত বাংলাদেশী বিপথগামী প্রবাসীরাই। সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি গুটি কয়েক নাগরিক যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট হিসেবে গ্রহণ করছে বলে জানা গেছে। আর তাদের ইয়াবার নেশা শেখাচ্ছে মাদকের বড় ডিলাররা।

এদিকে সৌদিতে মাদকে আগ্রাসনের কারনে সৌদিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও প্রশ্নের মুখে পড়ার চরম আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের অন্যত্যম ও প্রধান শ্রমবাজার হিসেবে পরিচিত সৌদি আরবে ইয়াবা পাচার ও মাদকবাজার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দেশের মাদক মাফিয়া খ্যাত বড় ৩ টি সিন্ডিকেট তৎপর রয়েছে বলে প্রবাসীসহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণে জানা গেছে। এদের মধ্যে বড় দুটি সিন্ডিকেটের মূল কুমিল্লার এবং অন্যটি কক্সবাজারের টেকনাফ এলাকার। গত বছর কুমিল্লার কালির বাজার ধনুয়াখলা এলাকর সৌদি ইয়াবা ডন হিসেবে পরিচিত শাহ আলম এর সহযোগী মুন্সীগঞ্জ জেলার সাইদুর নামে একজন রিয়াদে ১৭ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়। যে বর্তমানে দাম্মাম জেলে রয়েছেন এখনো। পরে তার দেওয়া তথ্যসূত্র ধরেই সন্দেহভাজন আরো বেশ কিছু প্রবাসী বাঙালি ও একজন রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করা হয়েছে। তবে মাল্টি ভিসার সুবাদে গ্রেফতার এড়িয়ে দেশে চলে আসে শাহআলম। সৌদির বড় ইয়াবা কারবারি সিন্ডিকেটের আরেকজন বুড়িচং উপজেলার সোন্দ্রম এলাকার শাহপরান। সৌদি প্রবাসীদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, মুলত কুমিল্লার মাদক সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণেই পুরোপুরি চলছে সৌদি আরবের মাদক ইয়াবা বাজার। মুসলমানদের পবিত্র ভূমি মক্কা, মদিনা, রিয়াদ, জেদ্দা, আল কাসিম, দম্মাম, সোলমানিয়া, ভাতা, হারা, সালভোক, মালাজসহ বাঙ্গালী অধ্যুষিত প্রায় প্রতিটি শহরেই রয়েছে বড় ইয়াবা ডন ও ডিলারদের নিজস্ব কিছুু এজেন্ট। আর এদের মাধ্যমে ইয়াবার একচ্ছত্র বাজার গড়ে তোলা হয়েছে। মোবাইল সেলসম্যানদের মাধ্যমে ফোনে ফোনে পৌঁছে দেয়া হয় সেবনকারী প্রবাসীদের ঘরে ঘরে। এদিকে অধিক লাভ আর রাতারাতি বড়লোক হওয়ার আশায় অনেক সেবকারীরাও জড়িয়ে পরছে এ ব্যবসায়।

ইয়াবা ব্যবসায়ীদের প্রলোভন প্রতারণায় ও অল্প সময়ে ধনী হওয়ার লোভে অনেক প্রবাসী ইয়াবা সিন্ডিকেটে বিনিয়োগ করে নিঃস্বও হয়ে গেছেন। ইয়াবা বাণিজ্যে পুঁজির নামে যারাই মোটা অঙ্কের টাকা আগাম বিনিয়োগ করেছেন, সিন্ডিকেট প্রধানরা তাদের অনেকেই সামান্য কিছু ইয়াবা দিয়ে কিংবা কৌশলে অল্প কিছু ইয়াবা দোকান বা রুমে রেখে সৌদি গোয়েন্দা ও পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে পাওনা টাকা পুরোপুরি আত্মসাৎ করেছেন। আবার বেশী লাভ দেয়ার কথা বলে দেশ থেকে বাকীতে ইয়াবার জোগান দেয়া মাদক কারবারিদের থেকে নেয়া মাল সে দেশে ধরা পড়ার কথা বলে তাদের টাকা মেরে এই সিন্ডিকেট প্রধানদের কয়েকজন হয়েছেন রাতারাতি কোটিপতি। তবে এসবের সত্যতা জানার পর সৌদি ইয়াবার ডিলার সেদেশের প্রশাসন থেকে বেঁচে দেশে এলেও পাওনাদারদের ভয়ে নিজের গ্রাম বা এলাকায় আসতে পারেন না।
ইয়াবা কারবারে বিনিয়োগ ও দ্রæত ধনী হওয়ার লোভের ফাঁদে পরে গত ৩ বছরে কুমিল্লা, বরুড়া, আদর্শ সদর, সদর দক্ষিণ, বুড়িচংয়ে কমপক্ষে সহস্রাধিক প্রবাসী নিঃস্ব হয়েছে। যাদের অনেকেই এখনো সৌদির বিভিন্ন জেলে বন্দী রয়েছেন আবার অনেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লগ্নি দিয়ে জেলে খেটে খালি হাতে দেশে এসে এসেছেন সে দেশে ফিংগার প্রিন্ট দিয়ে। অপরাধের কারনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট রাখা সৌদি প্রবাসীরা আর চাইলেও সেদেশে বৈধ পথে আর প্রবেশ করতে পারবে না। দুতাবাস বাংলাদেশ কমিউনিটি ও রিয়াদ পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত শুধুমাত্র ইয়াবা সংক্রান্ত মামলায় আটক হয়েছে প্রায় সহস্রাধিক বাংলাদেশী প্রবাসী। যাদের অধিকাংশই কুমিল্লা, ব্র্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার।

লকডাউন শেষে ইদানীং ফ্লাইট চালুর পর থেকে আবারো ইয়াবা জব্দ ও গ্রেফতার বেড়েছে সৌদি আরবে:
গত মে মাসে সৌদি পুলিশ ও গোয়েন্দাদের অভিযানে আল কাসিম এলাকা থেকে মানিকগঞ্জ জেলার ফিরোজ (জামাই ফিরোজ) নামের ব্যক্তিকে ৭০ পিস ইয়াবাসহ আটক করে জেলে পাঠানো হয় । এর দু’সপ্তাহ আগেই রিয়াদ থেকে ইয়াবা সিন্ডিকেটের আরেক সদস্য ব্র্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার জুবায়ের হোসেন যাবের নামে একজন আটক হন। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আল কাসিম এলাকা থেকে নোয়াখালী জেলার ইউসুফ ও আলাউদ্দিন নামে আরও দুই ব্যক্তিকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ আটক করে জেলে পাঠানো হয়। এ ছাড়া কুমিল্লা সদরের কালির বাজার ইউনিয়নের একজনও ইয়াবাসহ গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হন। গত দু মাসে শাহআলম এর সৌদি এজেন্টদের মধ্যে ৬ জন আটক হয় আল কাসিম, রিয়াদ ও জেদ্দা থেকে। যাদের দুজেনর বাড়ি বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নের হরিণধরা এলাকায়। একজন কোটবাড়ি গন্ধমতি এলাকার একজন বল্লাভপুর ও দুজন বিবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার। আরকৃতদের পরিবারের সদস্যরাও জানেন না প্রাবাসের কেন জেলে রয়েছেন তারা।

প্রবাসে মাদকে জড়িয়ে কিংবা ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পরে নিঃস্ব হয়ে দেশে আসা ও বিদেশে জেলের ঘানি টানছে অনেকে!! যাদের বেশির ভাগই শাহআলমের ইয়াবা ব্যবসা পরিচালনা করতো।
গত ক’বছরে সৌদি থেকে জেল খেটে নিঃস্ব রিক্ত হস্তে দেশে আসা প্রবাসীদের মাঝে কুমিল্লা কালির বাজার ইউনিয়নের প্রবাসীদের সংখ্যাই বেশী। জীবিকার তাগিদে পরিবারের সুখের আশায় বিদেশে গিয়ে শ্রম বিক্রি করতে গিয়ে ইয়াবা কারবারিদের ষড়যন্ত্র বা অধিক মুনাফর লোভে দেশের পরিবার ও নিজের ভাবমূর্তি খুইয়েছন বহু যুবক। সদর উপজেলার কালির বাজার ইউনিয়নের ধনুয়াখলা গ্রামের প্রবাসী নোমান ইয়াবা চক্রের ষড়যন্ত্রে আটক হয়ে এখনো রিয়াদ জেলে আটকে আছে। একই এলাকার আমির, এছাড়াও তৌহিদ ও মইন নিজ এলাকার এক বন্ধু ইয়াবা ডিলারের দেয়া একটি প্যাকেট দোকানে রেখে আটক হয় সৌদি গোয়েন্দাদের হাতে। সেদেশে জেলে খেটে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে ফেরত আসে নিজ দেশে। আনন্দপুর গ্রামের ওহাব মিয়ার ছেলে রাশেদ, নরু মিয়ার ছেলে খোকন, একই গ্রামের উত্তর পাড়ার সাদ্দাম, জাকির হোসেনের ছেলে সবুজ, তৈয়ব আলীর ছেলে বিল্লাল রয়েছে রিয়াদ জেলে। কোটবাড়ি গন্ধমতি এলাকার হেসেন, বুড়িচংয়ের ময়নামতি এলাকার মোতালেব হোসেন মুন্সি রয়েছে জেলে। সদরের দিঘলগাও গ্রামের ওহিদ মেম্বারের ছেলে রিপন এখনো রয়েছে জেদ্দা জেলে, আনোয়ার, সাদ্দাম ইয়াবাসহ আটক হয়ে জেলে খেটে এসেছে দেশে। বাখরাবাদ এলাকার এমদাদ, মনষাশন গ্রামের মোহর আলীর ছেলে রয়েছে ইউনুস রয়েছে রিয়াদ জেলে, এছাড়াও একই গ্রামের আজহার, আরমান, মিল্লাত সহ এ গ্রামের আরো কয়েকজন একই মামলায় জেলে খেটে দেশে এসেছে। ছনগাও গ্রামের প্রবাসী রুবেল দেশে এসে ৩০হাজার পিস ইয়াবা নিয়ে এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় আটক হয় ঢাকা সিআইডির হাতে। দীর্ঘদিন জেল খেটে কদিন আগে ছাড়া পেয়ে ঢাকায় বসে সৌদিতে ইয়াবা করবার চালানো ধনুয়াখলা গ্রামের ব্যবসায়ীর সাথে আবারো যোগ দিয়েছে বলে কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করে। এছাড়াও অলিপুর সমুয়ার পাড় গ্রামের মাসুদ ও বুড়িচংয়ের ময়নামতি এলাকার নওমুসলিম শাকির বর্তমানে একই মামলায় জেল খাটছে সৌদির রিয়াদ জেলে। সদর উপজেলার ২নং উঃ দুর্গাপুর ইউপির মজিদ মিয়ার ছেলে নাসির ১৮শ পিস ইয়াবা সহ দাম্মামে নিজের রুমে আটক হয়ে ২বছর জেল খেটে দেশে আসে। এছাড়াও কালির বাজার সৌয়দপুর, কমলাপুর বল্লাভপুর ও পাশের উপজেলা বরুড়া সহ আশেপাশের এলাকার বহু প্রবাসী যুবক ইয়াবার ভয়াল থাবায় ধ্বংস হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ইয়াবার মামলায় জেল খেটে দেশে আসা ভুক্তভোগী প্রাসাদের দেয়া বক্তব্য বেড়িয়ে আসে মুল হোতাদের নাম।
ইমিগ্রেশন পুলিশ ও র‌্যাব, সিআইডি, সিভিল অ্যাভিয়েশন সহ মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রবাসীরা জানান, দ্রুত তদন্ত করে দেশে বিদেশে থাকা যে সকল প্রবাসী মাদক কারবারিদের কঠোর আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচার কার্যকর করা হোক। অন্যথায় লাখ লাখ রেমটেন্স সৈনিক হুমকির মুখে পরবে। মাদকের কড়াল গ্রাসে দেশ হারাবে তাদের সূর্যসন্তানদের।
দেশ থেকে যেভাবে বিদেশে পাঠানো হয় ইয়াবা:
মিয়ানমার থেকে জল ও স্থল পথে মেথাম্ফিটামিনযুক্ত মাদক ইয়াবা কেবল দেশেই ঢুকছে না, বরং দেশের ভূখন্ড ব্যবহার করে ইয়াবার ছোট-বড় চালান ভিনদেশেও পাচার হচ্ছে। আকারে ছোট বহনে সুবিধা ও স্ক্যনারে ধরা না পড়ায় নানা ভাবে বিমানযোগে ইয়াবা পৌঁছে যাচ্ছে গন্তব্য। কখনো ডিলাররা নিজেরা কিংবা ভাড়া করা লোকের সাথে চুক্তির মাধ্যমে ইয়াবা পাচার করিয়ে থাকে। আচারের কৌটা, রান্না করা গরুর মাংস, কার্টুন, লাগেজ, মোবাইলের পাওয়ার ব্যাংক, কাঁচামাল এমন কি পাকস্থলীর ভেতরে নারী ও পুরুষের মাধ্যমে চালান পৌঁছে দেয়া হয় গন্তব্যে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশি ও আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়ারা বাংলাদেশকে ইয়াবা পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। এসব ইয়াবা কারবারিদের বেশিরভাগ টাকাই দেশে আসে হুন্ডির মাধ্যমে ও স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে। আকাশপথে ভিনদেশে ইয়াবা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি ডাক ও বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসকেও ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া সোনা চোরাচালানের মতো এয়ারলাইনস ক্রু ও বিমানবালাদের মাধ্যমেও ইয়াবা পাচার হচ্ছে।

মিয়ানমার ও কুমিল্লার ভারত সীমান্ত দিয়ে জল ও স্থল পথে চাহিদার তুলনায় কয়েক গুণ বেশি ইয়াবা হামেশাই দেশে ঢুকছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে ভিনদেশে পাচারের জন্যও চোরাকারবারি চক্র দেশে ইয়াবার মজুদ গড়ে তুলছে। সরাসরি ধরা না পড়লে বিদেশে ইয়াবা পাচারে জড়িতদের সন্দেহ করার মত তেমন কোন কারনও নেই। অনেক প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী ব্যবসায়ী এবং দেশের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা নেতাকর্মীরাও আন্তর্জাতিক ইয়াবা কারবারে জড়িত রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। বিদেশে বড় বা বিশাল কোন ব্যবসা না থাকলেও তবে এসব মাদক কারবারিদের বেশীর ভাগই বছরে বেশ কয়েকবার যাতায়ত করে থাকে দেশে ও বিদেশে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর সৌদি আরবে ওমরাহ করতে যাওয়ার সময় বাঁশখালীর একজনকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে লাগেজ ভর্তি ১০ হাজার ৮০০ পিস ইয়াবাসহ আটক করেন নিরাপত্তারক্ষীরা। এয়ার অ্যারাবিয়ার একটি বিমানে শারজাহ হয়ে তার জেদ্দা যাওয়ার কথা ছিল। তখনই মূলত আকাশপথে ভিনদেশে ইয়াবার চালান পাচারের বিষয়টি প্রথমবারের মতো নজরে আসে। গত এক বছরে ঢাকা শাহজালাল ও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে লুকিয়ে ইয়াবা পাঠানোর সময় অন্তত ১৪টি ছোট বড় চালান আটক করা সম্ভব হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর জানিয়েছে। এসব ইয়াবা চালান জব্দের ঘটনায় নয়টি মামলা ও চারটি জিডি হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টদের নজরদারি এড়িয়ে অবৈধ উপায়ে বহুগুণ বেশি চালান সেসব দেশে পৌঁছে বলে ধারণা করা হয়। গেল এক বছরে বাংলাদেশ ছেড়ে জেদ্দা, কাতার, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিমানবন্দরে অবতরণের পর ইয়াবাসহ অন্তত ১১ বাংলাদেশি আটকের ঘটনা ঘটেছে। বিশ্লেষকদের ধরনা মতে, চালানের যা ধরা পরে এসব ইয়াবা ধরা পরা চালানের পরিমান খুবই কম, এরচেয়ে বহুগুণ বেশী অনেকটা নিরাপদেই পৌঁছে যায়।

মাদক পাচারে জড়িত বিমান কর্মকর্তারাও!
সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের দুই কর্মীকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ আটক করার ঘটনাও ঘটেছে। তারা দুজনই বিমানের ফ্লাইট স্টুয়ার্ট পদে ছিলেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রিয়াদের হোটেল র‌্যাডিসন ব্লু সৌদি পুলিশের মাদক নিয়ন্ত্রণ শাখা অভিযান চালিয়ে মাদকসহ তাদের আটক করে। তারা দেশ থেকে কৌশলে নিজেদের লাগেজে ইয়াবা ঢুকিয়ে নিয়ে যান এবং হোটেল থেকে মাদক সিন্ডিকেটের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলেন বলে আটককারী কর্মকর্তারা বিবৃতি দেন।