নিজস্ব প্রতিবেদক: রবিন ছদ্মনামের এক যুবক বছরখানেক হলো ভিক্টর ক্লাসিক বাসে চালকের সহকারী (হেলপার) হিসেবে কাজ করছেন। ফাঁকে ফাঁকে স্টিয়ারিংয়ে বসে রপ্ত করেছেন গাড়ি চালানো। এখনও ড্রাইভিং লাইসেন্স মেলেনি। কিন্তু মাঝে মধ্যে ঢাকা মহানগরীর মতো ব্যস্ত সড়কে দিব্বি গাড়ি চালাচ্ছেন। আনাস নামে আরেক হেলপারকে মাঝ রাস্তায় চালক তার আসনে স্টিয়ারিংয়ে বসিয়ে দেন, তুরাগ পরিবহনের একটি বাসে। আনাস বাস চালাতে গিয়ে যাত্রীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন। পরে অবশ্য চালক নিজের আসনে বসে গাড়িটি চালিয়ে গন্তব্যে যান। দুটি ঘটনাই রাজধানী ঢাকার, যার রেশ ধরে অন্তত ৫ জন চালক ও হেলপারের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলছেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া ঢাকা মহানগরে বাস চালানো প্রায় অসম্ভব। তবে কিছু হেলপার যে স্টিয়ারিংয়ে বসছেন না, চালকের আসনে বসছেন না, তেমনটি বলা যাবে না। তারাই কিন্তু সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন। যে কারণে কোনও দুর্ঘটনা ঘটার পর প্রায়ই দেখা যায় গাড়িটি যিনি চালাচ্ছিলেন, তার লাইসেন্স নেই।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সেপ্টেম্বর মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে ৪০৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ৪৭৬ জন এবং আহত ৭৯৪ জন। যানবাহনের ড্রাইভার ও হেলপার নিহতের সংখ্যা ৬৩ জন, অর্থাৎ ১৩.২৩ শতাংশ। দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ১৩৪টি (৩২.৯২%) জাতীয় মহাসড়কে, ১৫৮টি (৩৮.৮২%) আঞ্চলিক সড়কে, ৭৩টি (১৭.৯৩%) গ্রামীণ সড়কে এবং ৩৬টি (৮.৮৪%) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৬টি ১.৪৭% সংঘটিত হয়েছ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, বিদ্যমান আইনে চালকের আসনে হেলপার-কন্ডাকটরদের বসার কোনও সুযোগ নাই, বরং এটি অপরাধও বটে। কিন্তু পুরো গণপরিবহন খাতের অব্যবস্থাপনার কারণে এটি হয়েই চলেছে। ফলশ্রুতিতে সড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে, প্রাণহানি ঘটছে। ঈদের সময় টানা ২-৩ দিন গাড়ি চালানোর সময় এ ধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে। এই নৈরাজ্য ঠেকাতে পরিবহন খাতের আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। হেলপারের ড্রাইভার হওয়ার পেছনে যেসব কারণ রয়েছে, সে বিষয়ে তার ভাষ্য হলো চালকের কর্মঘণ্টা নির্ধারিত না থাকা, টানা ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত গাড়ি চালানো, কর্মচারীর স্বীকৃতি না থাকা, বেতনভুক্ত না করা, নিয়োগপত্র না দেওয়া, মৌখিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালানো এবং সর্বোপরি কার্যকর ও কঠোর মনিটরিং না থাকা। এসব কারণে চালক তার হেলপার বা কন্ডাকটরকে স্টিয়ারিংয়ে যখন তখন বসিয়ে দিচ্ছে। এটা দেখার যেন কেউ নেই। এমন অবস্থা পৃথিবীর কোথাও নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, গণপরিবহনে জন্য ড্রাইভার তৈরির প্রতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সেভাবে শক্তিশালী না। সে কারণে গাড়িতে থাকতে থাকতে, গাড়ি ঘোরাতে-ফেরাতেই হেলপার এক সময় ড্রাইভার হয়ে যাচ্ছে। এভাবে অদক্ষরাও লাইসেন্স জোগাড় করে ফেলছে। আবার অনেক দক্ষও লাইসেন্স পাচ্ছে না। এসব কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে এবং প্রতিটি দুর্ঘটনার পরে বিষয়টি সামনে আসছে। কেবল ঢাকা মহানগরেই নয়, দূরপাল্লার রুটগুলো এবং দেশের অন্যান্য শহরেও হেলপারকে চালকের আসনে দেখা যায়। সেটি নিয়ে সেভাবে আলোচনা না হলেও দুর্ঘটনার পর বিষয়টি সামনে এলে ঢের সমালোচনা হয়ে থাকে। তেমন একটি ঘটনা ঘটে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর। বিমানবন্দর সড়কে সিলেট থেকে আসা এনা পরিবহনের একটি বাস ডিভাইডার টপকে মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দেয়। ঘটনাটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়।
ওই দুর্ঘটনার বিষয়ে এনা পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক আতিকুল আলম আতিক একটি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, টার্মিনালে যানজটের কারণে বাসটি ঢুকতে পারেনি। ফলে সড়কের পাশে গাড়িটি পার্কিং করে ড্রাইভার ঘুমাচ্ছিল। হেলপারও গাড়িতেই ঘুমিয়েছিল। ওই হেলপার গাড়িটি নিয়ে বের হয়েছিল বলে আমার ধারণা। চলতি বছরের গত ২৯ সেপ্টেম্বর বগুড়ার নন্দীগ্রামে একটি বাস (টাঙ্গাইল ব-০১৪২) উল্টে খাদে পড়ে দুই নারী নিহত এবং আরও অন্তত ১৩ জন আহত হন। পরে পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, বগুড়া থেকে যাত্রী নিয়ে পণ্ডিতপুকুরে যাচ্ছিল বাসটি। পথিমধ্যে চালক তার আসনে হেলপারকে বসিয়ে দিলে তিনি গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। সড়ক ফাঁকা থাকায় দ্রুতগতিতে চলতে গিয়ে বাস উল্টে যায়।
হেলপারই ড্রাইভার বনে যাওয়ার ক্ষেত্রে একাধিক গণপরিবহনের মালিকের সঙ্গে তাদের দায় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও কারও সাড়া মেলেনি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলছেন, আমরা তো আর হেলপারকে চালক হতে বলি না। চালককেও হেলপারের হাতে গাড়ি ছেড়ে দিতে বলি না। ঘটনাটি তারা নিজেরাই ঘটিয়ে থাকে, এর দায়ও তাদের। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই।