• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:২৭ পূর্বাহ্ন

স্বামীর নির্যাতনে মৃত্যু ১০৭ , ধর্ষণের ঘটনা ৭ হাজার ২২২ : বিগত বছরে বেড়েছে নারী সহিংসতার ঘটনা


প্রকাশের সময় : জানুয়ারী ১, ২০২২, ১:১৯ অপরাহ্ন / ২৭৭
স্বামীর নির্যাতনে মৃত্যু ১০৭ , ধর্ষণের ঘটনা ৭ হাজার ২২২ : বিগত বছরে বেড়েছে নারী সহিংসতার ঘটনা

নিজস্ব প্রতিবেদক :বিগত বছরে করোনা মহামারিতেও বছর জুড়ে নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা বেড়েছে। গত চার বছর আগের তুলনায় নারী নির্যাতন বেড়েছে ১০ গুণ। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ১০৭ জন নারীর মৃত্যু হয় স্বামীর নির্যাতনে। যৌন হয়রানির হাত থেকে বাদ যাননি তৃণমূলের নারী থেকে শুরু করে শহরের শিক্ষিত কর্মজীবী নারীও।এ বছর ধর্ষণের বিভীষিকা এতই বেড়েছে যে চলন্ত বাসেও নারী যাত্রীরা ছিল অনিরাপদ। সব মিলিয়ে ২০২১ সালে সরকার ঘরে কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারেনি। উলটো নির্যাতনের আরো নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।

গত ১৯ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ বন্দরে চলন্ত বাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক গৃহবধূ। বন্দরের মদনপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এ ঘটনা ঘটে। পরে কৌশলে নির্যাতনের শিকার নারী বাস থেকে নেমে জরুরি সেবা ৯৯৯ এ ফোন করলে পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে। জানা যায়, বাসটি মদনপুর এলাকায় পৌঁছানোর পর বাসের সব যাত্রী নেমে গেলে চালক ও দুই সহকারী চলন্ত বাসে উচ্চৈঃস্বরে গান বাজিয়ে সেই গৃহবধূকে ধর্ষণ করে। এর আগে চলতি বছরের মার্চে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় নূর আয়শা নামের এক নারীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে শওকত ওসমান নামে এক ব্যক্তি নির্যাতন করে। উপজেলার বরইতলী ইউনিয়নের মোরাপাড়ার হাপানিয়াকাটা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ নির্যাতনের ধারণ করা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। গত ১৪ ডিসেম্বর শরীরে বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন নিয়ে রাজধানীতে মৃত্যু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী এলমা চৌধুরী মেঘলার। এলমার অভিভাবকদের অভিযোগ স্বামীর নির্যাতনে শিকার হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। জানা যায়, বিয়ের পর থেকেই এলমাকে তার স্বামী ও পরিবারের লোকজন শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীরা শুধু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন না, তারা স্ট্রিট ভায়োলেন্সেরও শিকার হচ্ছেন। এমনকি নারী এখন পর্যটন স্পটগুলোতেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নির্যাতনের জায়গাগুলো এখন ভিন্নতর হচ্ছে। আবার যে নারীরা উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন তাদের অনেককেই কোথাও না কোথাও যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। অবস্হা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে নারীর প্রতি নির্যাতনকে সমাজ এখন কোনো বিষয় বলেও গ্রাহ্য করছে না।

সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মহামারির মধ্যেও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রায় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এ সময় দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মোট ঘটনা ঘটে ২১ হাজার ৭৮৯টি যা এর আগের অর্থবছরে ছিল ১৮ হাজার ৫০২টি। সে হিসাবে এক বছরে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এ সময় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭ হাজার ২২২টি। যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫ হাজার ৮৪২টি। অন্য দিকে নারী নির্যাতনের ঘটনা এক বছরে ১২ হাজার ৬৬০টি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪ হাজার ৫৬৭টি হয় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ১০৭ জন নারীর মৃত্যু হয় স্বামীর নির্যাতনে। পারিবারিক সহিংসতার কারণে ৯২ জন নারী আত্মহত্যা করেন। ৪১ জন নারীকে তার নিজ পরিবারের লোকজন হত্যা করে। পারিবারিক সহিংসতার জন্য ২৬৬টি মামলা দায়ের করা হয়। সংস্হাটির তথ্যমতে, এ সময় ১ হাজার ১০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন ২৩৪ জন। ২৮৬ জন নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। এ জন্য মোট মামলা হয় ৮৬৪টি। ১১ মাসে মোট ১০৯ জন নারী ও তরুণী যৌন হয়রানির শিকার হন। এদের মধ্যে ১০ জন আত্মহত্যা করেন। আর মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এর দেওয়া তথ্যে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যৌতুকের কারণে মোট ৫৫ জন গৃহবধূর অকাল মৃত্যু হয় এবং নির্যাতনে ৯৭ জন আহত হন।

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের যুগ্মসচিব উম্মে কুলসুম বলেন, আমাদের প্রত্যেকটা ঘরকে নারীদের জন্য নিরাপদ দুর্গ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তা হলেই নারী নির্যাতনের হার কমে যাবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জন্য একটি চমত্কার সংবিধান দিয়ে গিয়েছিলেন। যে সংবিধানে নারী-পুরুষসহ সব শ্রেণি-গোত্রের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ তৈরিতে সরকার চিন্তা করছে। নারী নীতি ও বিভিন্ন পলিসি রয়েছে। তার পরও আমরা দেখছি, নারী নির্যাতনের হার বেড়েই চলেছে। এই বিষয়টি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নানা প্রতিকুলতার মাঝেও আত্মশক্তিতে বিকশিত নারীসমাজ যারা আজ নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তারাই আগামী দিনে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তবে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে নারীর অবদান থাকলেও নারীর অবদানের স্বীকৃতি এবং অংশীদারিত্বের স্বীকৃতি এখনো আসেনি। নারীর প্রতি সহিংসতা দূর করে প্রকৃত উন্নয়ন ঘটাতে হলে উন্নয়নের মূলধারায় নারীকে যুক্ত করতে হবে, রাষ্ট্রীয় নীতি নারীবান্ধব হতে হবে, বাস্তবায়নকারীদের জেন্ডার সংবেদনশীল হতে হবে, সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীদের সম-অধিকার দিতে হবে।