এম রাসেল সরকারঃ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যে কতটা com)কিতে পড়েছে, তা বর্তমান পরিস্থিতি দেখলে বোঝা যায়। গোটা বিশ্বে, ভুয়া তথ্য মোকাবিলার নামে দমনমূলক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে চলেছেন স্বৈরশাসকেরা, অনলাইনে তথ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য অত্যাধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার বাড়তে দেখা যাচ্ছে এবং সমালোচনামূলক সাংবাদিকতার ওপর দমন-পীড়নও চলছে সমানতালে।
সাংবাদিকেরা সহিংসতা ও বিধিবহির্ভূত আটকের শিকার হয়ে চলেছেন, তাঁদেরকে গোপন নজরদারির লক্ষ্যবস্তু বানানো হচ্ছে এবং এই প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে সংঘাত ও নির্বাচনের সময়গুলোতে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের হুমকি বা হামলার জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না এবং সাংবাদিকদের ওপর সহিংস হামলার জন্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী বা কোনো অরাষ্ট্রীয় শক্তিকে বিচারের মুখোমুখিও হতে হয় না।
সাংবাদিকেরা এখন যে সব ভিত্তিহীন মামলার শিকার হচ্ছেন, তা আগে কখনো দেখা যায়নি। স্ল্যাপ (স্ট্র্যাটেজিক ল-স্যুটস অ্যাগেইনস্ট পাবলিক পার্টিসিপেশন) নামে পরিচিত এই মামলাগুলো সাজানো হয় সাংবাদিক বা সেই সব ব্যক্তিকে ভয়ভীতি দেখানোর জন্য, যাঁরা ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আচরণ নিয়ে সমালোচনা করেন। প্রায় ক্ষেত্রে, এসব মামলার অভিযোগগুলো হয় ভিত্তিহীন, অসার বা অতিরঞ্জিত; এগুলো দায়ের করা হয় কোনো সাংবাদিক বা মানবাধিকার কর্মীকে চাপে ফেলার জন্য এবং এঁদের সঙ্গে কোনো অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয় থাকে না।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য সমস্যার আরেকটি বড় উৎস হলো অনলাইনে তথ্য নিয়ন্ত্রণের রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা। অনেক গণমাধ্যম কর্মীরা কাজ করতে হয় কঠোর ও দমনমূলক পরিবেশে। তাই এসব জায়গায় ইন্টারনেট হয়ে ওঠে মুক্ত ও স্বাধীন মতপ্রকাশের শেষ জায়গা। কিন্তু এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ওপরও দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে নানান কৌশলে। বর্তমানে বেশ শক্ত হাতে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করা হয়—কখনো ওয়েবসাইট সাময়িকভাবে ব্লক করে দিয়ে, কখনোবা ক্রমাগত ফিল্টারিংয়ের মাধ্যমে।
স্বাধীন সাংবাদিকতার চর্চা এখন বিশাল এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কোথাও কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা এমন আইন প্রণয়ন করছেন, যা কথা বলার অধিকার ক্ষুণ্ন করছে; কোথাও এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে যে, সাংবাদিকেরা তাঁদের কাজ চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন না। চলছে সাংবাদিকদের ওপর হামলা-মামলা হয়রানি হুমকি ও নির্যাতন।
কিন্তু সাংবাদিককের সুরক্ষার কোনো আইন নাই। তাই সহজেই চুরি, ডাকাতিসহ রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার আসামি করা যায় সাংবাদিকদের। সর্বশেষ ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ছাড়াও আরো যেসব আইন ও বিধি সাংবাদিকদের ওপর নিয়ন্ত্রক হিসেবে আছে, আদালত অবমাননা আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট, বাংলাদেশ দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, কপিরাইট আইন, প্রেসকাউন্সিল অ্যাক্ট, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, পোস্ট অফিস অ্যাক্ট, শিশু আইন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইন, বাংলাদেশ শ্রম আইন, তথ্য অধিকার আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ভোক্তা অধিকার আইন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ সুরক্ষা আইন এবং বাংলাদেশের সংবিধান।
এ সব আইনের মধ্যে বেশ কিছু আইন আছে ঔপনিবেশিক আমলের। যেমন আদালত অবমাননা আইন ১৯২৬ সালের আর অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩ সালের। যা বর্তমানে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বেশি ব্যবহার হচ্ছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন। তবে ফৌজদারি আইন এবং মানহানি আইনও ব্যবহার করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে গত বছর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলা করেছেন। খবর প্রকাশের কারণে মামলা হয়েছে ৯০টি। সরকারের কর্মকর্তরা প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন ২৬ জন সাংবাদিককে। তাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১০ জন সাংবাদিক। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা হামলা করেছেন ২৫ জন সাংবাদিকের ওপরে। সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে ৩৪ জন এবং হামলার শিকার হয়েছেন ২৫ জন।
এদিকে সিনিয়র সাংবাদিক নেতা ও জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার চেয়ারম্যান লায়ন নূর ইসলাম বলেন, সাংবাদিকেরা বর্তমানে শক্তিমানদের নির্যাতন ও মামলার শিকার হচ্ছেন। প্রশাসন, পুলিশ ছাড়াও এমনকি ইউপি মেম্বার, চেয়ারম্যানরাও এই বাইরে নয়। যারা দুর্নীতিবাজ তাদের তোপের মুখে আছেন সাংবাদিকেরা।
এডভোকেট শামীম আহমেদ বলেন, সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণে যত আইন আছে সেগুলো মাথায় রাখলে তারা সাংবাদিকতা করতে পারবেন না। তাদের এই আইন ভুলে কাজ করতে হবে। শুধু মাথায় রাখতে হবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থ। দুর্নীতির খবর প্রকাশ জনস্বার্থে প্রকাশ করতে হবে। এখানে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বা নিরাপত্তার কোনো বিষয় নাই।”তার মতে, এখন সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন। আরো যেসব কালা কানুন আছে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে সাংবাদিক সংগঠনগুলো। আর আইনে সাংবাদিক সুরক্ষার কিছু বিধান আছে সেগুলো সাংবাদিকদের জানতে হবে। তিনি আরও বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদলতের নির্দেশনা আছে সাংবাদিক তার সোর্স প্রকাশ করতে বাধ্য নয়।
সাংবাদিক নেতা ও জাতীয় সাংবাদিক সংস্থার কার্যকরী সভাপতি আবুল বাসার মজুমদার বলেন, সাংবাদিকদের বিশেষ করে যারা ঢাকার বাইরে কাজ করেন তাদের নানা ধরনের ফৌজদারি মামলা দিয়ে থাকে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা, রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা এবং হয়রানিও করে থাকেন। এটা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এর বিরুদ্ধে দেশের সকল সাংবাদিক সংগঠন গুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নাই।
সর্বশেষ বলতে চাই, আইন আর ক্ষমতার কাছে জিম্মি সাংবাদিকরা, বাংলাদেশে সাংবাদিকেরা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নির্যাতনের শিকার হন সবচেয়ে বেশি। আর সাংবাদিকদের প্রচলিত আইন ছাড়াও আরো কমপক্ষে ১৯ ধরনের আইন ও বিধি মাথায় নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। আমি মনে করি সুনির্দিষ্টভাবে সাংবাদিক সুরক্ষা আইন দরকার।সাংবাদিকদের জন্য এখন এটা জরুরি হয়ে পড়েছে। আসুন সকল সাংবাদিক সংগঠন গুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলি।
(লেখকঃ এম রাসেল সরকার,সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী। ইমেইল- Sheikhmdraselbd@gmail.com)
আপনার মতামত লিখুন :