এম রাসেল সরকার, অনুসন্ধানী প্রতিবেদকঃ অনলাইনে প্রতারণার ধরন বদলাচ্ছে৷ টাকা ডলার করে দেয়া, লোহা সোনা করে দেয়া- এগুলো পুরোনো হয়ে গেছে, এখন এসেছে বিনিয়োগ প্রতারণা, অর্ধেক দামে জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রির অফারসহ নানা ধরনের প্রতারণা। এ সব কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যই হলো সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নেয়া। এইসব প্রতারণায় ফেসবুক, টিকটকের পাশাপাশি ব্যবহার হচ্ছে ইউটিউব, ইমো প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ই-কমার্সের নামে অনলাইনে ই-ভ্যালিসহ আরো কিছু কাথিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পরও এই ব্যবসা এখনো বন্ধ হয়নি৷ সাধারণ মানুষের পক্ষে এখন বোঝা কঠিন হয়ে পড়েছে যে কারা প্রতারক এবং কারা প্রতারক নন।
গত বছর মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী সেজে অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে৷ প্রতারিতরা লজ্জায় নিজেদের নামও প্রকাশ করছেন না৷ ওই প্রতারক চক্র ঢাকার অভিজাত এলাকায় অফিস খুলে বিদেশি বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান বলে নিজেদের ওয়েব সাইটে মোটা বেতনে অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ সরকারি চাকরিজীবীদের নিয়োজের বিজ্ঞপ্তি দেয়। যারা যোগাযোগ করেন তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী সেজে বাংলাদেশি প্রতারক চক্রের সদস্যরা। তাদের অফিস, গাড়ি ও হাবভাব দেখে ফেঁসে যান চাকরিপ্রার্থী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা। তাদের বেতন ধরা হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা, পদও দেয়া হয় বিশাল। এরপর বিদেশে বিনিয়োগের টাকা আটকে গেছে বলে কথিত প্রমাণও দেখায়। সাময়িক সাপোর্টের নামে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কয়েকটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় তারা।
একইভাবে ঢাকায় বিনিয়োগের নামে ফেসবুকে গত বছর কিছু ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে আফ্রিকা ও বাংলাদেশি নাগরিকদের একটি প্রতারক চক্র৷ যারা যোগাযোগ করেন তাদের প্রত্যেককে বলা হয় যে তারাই হবেন তাদের ব্যবসার বাংলাদেশি এজেন্ট৷ আবাসন ও কৃষি খাতে তারা বিনিয়োগ করবেন৷ তাদের জমি দেখতেও বলা হয়৷ একজন বাংলাদেশে এসে প্রজেক্টের জন্য কোটি কোটি টাকা দামের জমিও দেখে যান৷ এভাবে আস্থা অর্জন করে বিদেশ থেকে অর্থ পাঠানোর আগে প্রাথমিক কাজের জন্য তাদের স্থানীয় এজেন্টকে ধার হিসেবে টাকা দিতে বলেন। এইভাবে তারা কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়৷ ভুক্তভোগীদের একজন মিজানুর রহমান জানান, ‘‘পাঁচ লাখ টাকা নেয়ার পর বুঝতে পারি তারা প্রতারক। থানায় অভিযোগ করার পর চক্রের সদস্য একজন আফ্রিকান নাগরিককে গ্রেপ্তারও করা হয়৷ তখন আমি বুঝতে পারি তারা এই দেশে থেকেই আমার সঙ্গে সব যোগাযোগ করে। কিন্তু আমার টাকা উদ্ধার করতে পারিনি৷ কারণ টাকা তারা আগেই সরিয়ে ফেলেছে।
ফেসবুকে বন্ধুত্ব করে দামি গিফট পাঠানোর নামে টাকা হতিয়ে নেয়ার কৌশল প্রতারণার পুরোনো কৌশল৷ তারপরও মানুষ ওই প্রতারকদের খপ্পরে পড়ছেন৷ আর উত্তরাধিকার সূত্রে লাখ লাখ ডলারের মালিক হয়ে সেই টাকা বাংলাদেশে পাঠানোর প্রতারণার ফাঁদ পাতা হচ্ছে প্রতিদিনই কেউ পা দিলেই ধরা।
সম্প্রতি ফেসবুক ও ইউটিউবার প্রত্যয় হিরনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ফেসবুক ও ইউটিউবে কনটেন্ট তৈরির আড়ালে অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারের অভিযোগে৷ গত তিন বছর ধরে ভারতীয় এক এজেন্টের সঙ্গে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচারে চুক্তি ছিল প্রত্যয় হিরনের৷ নিষিদ্ধ জুয়ার ব্যবসা প্রচারে একেকটি বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য প্রত্যয় নিতেন প্রায় লাখ টাকা।
আর ‘নুর কিচেন’ নামে একটি প্রতারক চক্র ফেসবুকে পেতেছে বিনিয়োগ প্রতারণার ফাঁদ। তারা ঢাকা মেডিক্যালে খাবার সরবরাহের কাজ পেয়েছে বলে আকর্ষণীয় মুনাফার লোভ দেখিয়ে বিনিয়োগ করার জন্য প্রলোভিত করে। কমপক্ষে তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হবে৷ তারা আদৌ ওই ধরনের কোনো কাজ পায়নি৷ আর প্রতিষ্ঠানটিও বাস্তবে অস্তিত্বহীন।
অনলাইনে প্রতারণার ধরনঃ গেয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান জানান, এখন ছোট থেকে বড় সব ধরনের প্রতারণাই হচ্ছে অনলাইনে৷ গৃহশিক্ষক দেয়া থেকে শুরু করে পাত্র-পাত্রী সবখানেই অনলাইন প্রতারণা৷ আর প্রতারকরা সময়ের সাথে কৌশলও বদলাচ্ছে।
অনলাইনে জুয়া এখন ভাইরাসের মতো হয়ে গেছে: মশিউর রহমান
ডিভোসর্ড প্রবাসী পাত্রী পরিচয়ে প্রতারক চক্রের শিকার হচ্ছেন অনেকে। কেউ আবার অনলাইনে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে ফেঁসে যাচ্ছেন৷ তিনি জানান, ‘‘ঢাকায় উচ্চবিত্তরাও এর শিকার হচ্ছেন৷ এমন কয়েকজন আমার কাছে অভিযোগ নিয়ে এসেছেন যারা টাকা তো খুইয়েছেনই এখন মান ইজ্জত কীভাবে রক্ষা করবেন সেই চিন্তায় তারা কাতর৷ তারা লিখিত অভিযোগও করতে চাননা৷ শুধু প্রতারক চক্রকে থামাকে পারলেই যেন তারা বেঁচে যান।
ফেসবুকে বিদেশি নারীর ছবি ব্যবহার করেও চলছে প্রতারণা৷ তাদের কেউ ইউএস আর্মি বা নেভির সদস্য বলেও পরিচয় দেন৷ সেই ধরনের ছবিও থাকে৷ ফেসবুকে বন্ধুত্ব তৈরি করে৷ তারপর নানা কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেয়৷ কেউ আবার আছেন বিদেশি কথিত বিনিয়োগকারী।
‘‘আর অনলাইনে জুয়া এখন ভাইরাসের মতো হয়ে গেছে৷ সর্বশান্ত হয়ে অনেকে আমাদের কাছে আসেন৷ কিন্তু এই জুয়ার মূল লোক দেশের বাইরের৷ আমরা মাঝেমধ্যে তাদের এদেশীয় এজেন্টদের ধরি৷ কিন্তু টাকা আর পাওয়া যায়না৷ চীনা একটি অ্যাপ ব্যবহার করে তরুনরা ব্যাপকভাবে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছে৷ ইমো নাম্বার হ্যাক করেও অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটছে,’’ জানান এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা৷
আর অনলাইনে এখন মাদকের বিরাট বাজার গড়ে উঠেছে৷ এর সঙ্গে প্রধানত তরুণরা যুক্ত৷ মাদকসেবী এবং ব্যবসায়ী সবাই তরুণ৷ টিকটক হৃদয়ের কথা সবাই এখন জানেন৷ সে অনলাইনে টিকটক তারকা বানানোর লোভ দেখিয়ে ভারতে অনেক নারীকে পাচার করেছে৷ টিকটক হৃদয় এখন ভারতের কারাগারে আটক আছেন৷ মশিউর রহমান বলেন, ‘‘তারপরও টিকটক প্রতারণা থামছে না৷ প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দিচ্ছেন অনেকেই৷’’
প্রতারণার সর্বশেষ সংস্করণ ইমো প্রতারণাঃ বুধবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা দপ্তরের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম টিম ইমো প্রতারণার একটি চক্রের চার সদস্যকে আটক করেছে৷ তারা মেয়ে সেজে নারী কন্ঠে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ। সুন্দর চেহারার ছবি দিয়ে কথিত নারীর আইডি থেকে মেসেজ দেয়া হতো প্রবাসীদের৷ এরপর শুরু কথোপকথন ও ছবি আদান-প্রদান৷ সুন্দর ছবি ও মধুর কন্ঠের অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার সহজেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তেন প্রবাসীরা৷ পরে ভিডিও কলের প্রলোভনে কৌশলে প্রবাসীদের ইমো আইডি নেয়া হতো নিয়ন্ত্রণে৷ পরে ইমো নম্বর পরিবর্তন করে অ্যাকাউন্টের প্রাইভেসি হিস্টোরিতে গিয়ে পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের নম্বর সংগ্রহ করে নানা বাহানায় হাতিয়ে নিতো হতো লাখ লাখ টাকা। এই প্রতারক চক্রটি প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত টাকা দিয়ে জায়গা-জমি কিনে ও বিলাসবহুল বাড়ি করে উন্নত জীবনযাপন করে আসছিল
লিমিটলেস সম্ভাবনা, লিমিটলেস প্রতারণাঃ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা দপ্তরের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, ‘এখন সব কিছুই ওপেন৷ তাই লিমিটলেস সম্ভাবনা, লিমিটলেস প্রতারণা। বিকাশ প্রতারণা এবং ইমো হ্যাকিং এখন অনলাইন প্রতারণার শীর্ষে আছে বলে জানান তিনি৷ এছাড়া অনলাইনে বিভিন্ন সরকারি কাজ পাইয়ে দেয়া, ওয়ার্ক অর্ডার করিয়ে দেয়া, চাকরি দেয়াসহ নানা প্রতারণা চলছে
তার কথা, আসলে অধিকাংশ অনলাইন প্রতারণাই হয় বেশি লাভ বা বেশি কিছু পাওয়ার লোভ দেখিয়ে৷ সবাই জানেন ব্যাংক রেট কত৷ বিনিয়োগে লাভের সম্ভাবনা কত৷ এখন এক লাখ টাকায় মাসে ১০ হাজার টাকা লাভের অফার দেয়৷ ফলে অনেকেই ফাঁদে পা দেন। তবে এইসব অপরাধের অপরাধীদের ধরা কঠিন। সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে গোয়েন্দারা এখন নানা ধরনের প্রযুক্তি ও ডিভাইস ব্যবহার করছে বলে জানান তিনি৷ তবে প্রতারকরাও অনেক স্মার্ট৷ তারা নতুন যত প্রযুক্তি আসে সবগুলোই ব্যবহার করতে পারে।
আগে সাইবার ক্রাইম ও অনলাইন প্রতারণা নিয়ে মানুষ তেমন অভিযোগ করতো না৷ এখন অভিযোগ বাড়ছে৷ প্রচুর অভিযোগ আসছে৷ তবে মামলা কম৷ মানুষ ফোনে জানাচ্ছে, এসএমএস দিচ্ছে, মৌখিকভাবে অভিযোগ করে সমাধান চান৷ সেক্ষেত্রে হয়ত সমাধান করা যায় কিন্তু আইনগত ব্যবস্থা সবসময় নেয়া যায় না বলে জানান তিনি।
সচেতনতার বিকল্প নেইঃ সাইবার ক্রাইম নিয়ে কাজ করেন আইটি এক্সপার্ট তানভীর হাসান জোহা৷ তিনি বলেন, অনলাইন প্রতারণা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের সতর্ক হতে হবে। লোভ সামলাতে হবে৷ অনলাইনে কারো সঙ্গে পরিচয় হলে সাবধান থাকতে হবে। বিনিয়োগ করা বা দামি উপহার পাওয়ার আশায় কাস্টমস ডিউটির নামে লাখ লাখ টাকা দেয়ার আগে যাচাই করতে হবে। তিনি বলেন, ভূমি নিয়ে, ফ্ল্যাট নিয়ে প্রতারণা ধরা এখন সহজ হয়েছে৷ কারণ ভ‚মি ব্যবস্থাপনা এখন ডিজিটাল৷ অন্যান্য ক্ষেত্রে একটু দক্ষতা এবং ডিজিটাল জ্ঞান থাকলে অনলাইনেই অনেক কিছু চেক করা সম্ভব৷ যেমন, একটি ফেসবুক আইডি বিশ্লেষণ করলেই অনেক তথ্য পাওয়া যায় এবং বোঝা যায়।
তার কথা, পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট অনেক আধুনিক হয়েছে৷ কিন্তু প্রতারকরা আরো এগিয়ে৷ আর প্রতারিত হলে অভিযোগ করতে হবে৷ প্রতারিত হওয়ার আগেও কোনো অফার বা প্রস্তাবের বিষয় ওই ইউনিটের পরামর্শ নেয়া যায়।
আর মশিউর রহমান বলেন, আমরা তো আইনি সহায়তার জন্য আছি৷ কিন্তু একটু সচেতনতা অনেক কাজে আসে অনলাইন প্রতারণা থেকে বাঁচতে৷ সচেতন হলে আমরা অনলাইনে ইজ্জতহানি, মানহানি ও অর্থ খোয়ানো থেকে বাঁচতে পারি।
আপনার মতামত লিখুন :