
নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরাঃ সাতক্ষীরার আশাশুনি বড়দল আফতাব উদ্দিন কলেজিয়েট স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ নিয়ে চলছে রশি টানাটানি। প্রতিষ্ঠানের সভাপতি কে? এ প্রশ্নের জবাব নেই খোদ প্রশাসনের কাছে। সব মিলিয়ে চলছে হযবরল। প্রিন্সিপালের পদ নিয়ে রশি টানাটানি আর সভাপতির অস্তিত্ব না থাকায় দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। নানা মুখি টানাপোড়নে সাধারণ শিক্ষক,শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে এলাকা জুড়ে বিরাজ করছে উৎকন্ঠা।
একে অপরকে দোষারোপ, বিদ্রুপ, কটাক্ষ ও নানামুখী তৎপরতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক ও কর্মচারী।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. শিহাব উদ্দিন সাতক্ষীরা সিটি কলেজে চাকরি নিয়ে চলে গেলে তার শূন্য হয় প্রিন্সিপালের পদ। এরপর এই পদে সহকারী প্রধান শিক্ষক তরুণ কান্তি সানা অথবা কলেজ শাখার সিনিয়র শিক্ষক মোহাম্মদ আলীর স্থলাভিষিক্ত হবার কথা থাকলেও তৎকালীন সভাপতি আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ ডাঃ মোখলেছুর রহমান তা না করেননি। তিনি জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ১৩ নং শিক্ষক বাবলুর রহমান কে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদে বসিয়ে রেজুলেশন করেন। একই সময়ে ৫টি শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান ছিল। জনশ্রুতি আছে চাকরী দেওয়ার নাম করে সে সময় প্রায় ৭০ লক্ষ টাকার আত্মসাত করা হয়েছে।
বাবলুর রহমান দায়িত্ব পেয়ে নিয়োগ পরীক্ষা পূণরায় আয়োজন করতে গেলে বিপত্তি দেখা দেয়। এসময় নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে পত্র পত্রিকায় একাধিক খবর প্রকাশিত হয়।
৫ আগষ্ট দেশের পট পরিবর্তন হওয়ার পর দীর্ঘ কয়েক দিন অনুপস্থিত থাকার পর ১২ আগষ্ট ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বাবলুর রহমান তার কার্যালয়ে আসেন। তখন থেকে তাকে অপসারণের দাবিতে মানববন্ধন সহ ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের অভিযোগে তার পদায়ন বাতিল করতে বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মোহাম্মদ আলী।
বিধি মোতাবেক প্রিন্সিপালের দায়িত্ব প্রাপ্তির দাবিদার জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মোহাম্মদ আলী বলেন, গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর খুলনা শিক্ষা অফিস থেকে বাবলুর রহমান কে দায়িত্ব হস্তান্তর করার নির্দেশনা এলেও তিনি তা না করে আদেশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসেন। এবং আদেশের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে ১০৯৬৫/২৪ নং রিট পিটিশন দায়ের করেন।
এরপর ৮ সেপ্টেম্বর যশোর শিক্ষাবোর্ড থেকে আবারো তাকে দায়িত্ব হস্তান্তরের জন্য বলা হয়। সে সময় কলেজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কৃষ্ণা রায় সরকারি আইনজীবীর কাছে আইনি মতামত নিয়ে বোর্ডে প্রেরণ করেন। আদালতে মামলা থাকায় বোর্ডের আদেশ রোহিত হয়। পরে আদালতে তার মামলাটি খারিজ হয়ে যায়।
তিনি আরও জানায়, ২২ মে যশোর শিক্ষাবোর্ড থেকে কলেজ পরিদর্শক সাক্ষরিত এক আদেশে বলেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২৩-০৪-২৫ তারিখের স্মারক পত্রের নির্দেশনা মোতাবেক বড়দল আফতাব উদ্দিন কলেজিয়েট স্কুলের অধ্যক্ষের পদ শূন্য থাকায় কলেজ শাখার জ্যেষ্ঠ তম শিক্ষক কে অবিলম্বে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান করে বোর্ডকে অবহিত করতে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ও সভাপতিকে বলা হয়েছে। সভাপতি পদ থেকে অব্যাহতি নেওয়ার ফলে এ আদেশের বলে আমি জ্যেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠাতার পরিবারে সদস্য,স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তি,প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক,অভিভাবক,প্রাক্তন শিক্ষক ও ছাত্রদের উপস্থিতিতে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। সাথে সাথে অফিসিয়ালি দায়িত্ব পেতে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করার প্রস্তুতি নিয়েছি।
এছাড়া বাবলুর রহমান সম্পর্কে তিনি বলেন, সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল বাবলুর রহমান ছিলেন সাবেক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি। এছাড়া কয়রা পাইকগাছার সাবেক সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান বাবর পকেটের লোক হওয়াতে সম্পূর্ণ দলীয় ক্ষমতার বলে ১২ জন জ্যৈষ্ঠ শিক্ষককে উপেক্ষা করে চেয়ার দখল করেছিলেন।
অপরদিকে সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল বাবলুর রহমান বলেন, আইনগত ভাবে আমি এখনো বৈধ। জোর পূর্বক মোহাম্মদ আলী কিছু লোকজনকে সাথে নিয়ে প্রিন্সিপালের রুমে তালা ভেঙে তার চেয়ার দখন করেছেন। এছাড়া অনেক প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র তসরুপ করছেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
প্রিন্সিপালের রুমে তালা ভেঙ্গে প্রবেশ করা কাগজপত্র তসরুপ করার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী (এমএলএস) পুলিন কুমার বিশ্বাস বলেন,এমন কোন ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানের জমিদাতার পরিবারের সদস্যরা ও স্থানীয় বর্তমান, সাবেক শিক্ষক- অভিভাবক-ছাত্ররা এসে রুমে তালা খুলে দিতে বললে আমি তালা খুলে দেই। তারা কিছুক্ষন সেখানে বসে আলোচনা করে মোহাম্মদ আলী স্যারকে দায়িত্বে বসিয়ে দিয়ে কিছু সময় পর সবাই একসাথে চলে গেলে আমি আবারও তালা লাগিয়ে দেই। কোন কাগজ পত্র নিতে দেখিনি।
এ বিষয়ে ভূগোলের প্রভাষক ইদ্রিস আলী বলেন, আমাদের প্রায় সকল শিক্ষকের উপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠাতার কন্যা হাসিনা আপা এসে সবার সাথে আলোচনা করে অচলাবস্থা দূর করার লক্ষ্যে জ্যৈষ্ঠতার ভিত্তিতে মোহাম্মদ আলী স্যার কে দায়িত্বে বসিয়ে চলে যান। এর বাহিরে কোন ঘটনা ঘটেনি।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে মোহাম্মদ আলীকে বসানোর বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতার কন্যা হাসিনা বেগমের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, এলাকার শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রতিষ্ঠানটি আমার পিতা খুব কষ্ট কর গড়ে তুলেছিলেন। গত আওয়ামী লীগের আমলে শিক্ষক নামের কিছু দুষ্কৃতিকারী আর কিছু আওয়ামী লীগের নেতারা মিলে নিয়োগ বাণিজ্য সহ নানা অপকর্ম করে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের ক্যাডার হিসেবে বাবলুর রহমান জ্যেষ্ঠতা লংঘন করে সম্পূর্ণ দলীয় প্রভাব খাঁটিয়ে দায়িত্ব নেন। বর্তমানে শিক্ষা বোর্ডর চিঠি আছে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে দেওয়ার জন্য। প্রতিষ্ঠানের কোন সভাপতি না থাকায় এবং অচল অবস্থা দূর করার জন্য আমরা এলাকাবাসী মিলে আলোচনা করে প্রতিষ্ঠান বাঁচানো স্বার্থে মোহাম্মদ আলী সিনিয়র হওয়ার কারনে তাকে দায়িত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠান চালাতে বলেছি। অবশ্য প্রশাসন যখন সভাপতি হিসেবে কাউকে দায়িত্ব দিবেন তখন সভাপতিসহ কমিটির সদস্য এবিষয়ে বিধি মোতাবেক সিদ্ধান্ত নিবেন।
এ বিষয়ে আশাশুনি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আতিয়ার রহমানের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, আমি বড়দল কলেজিয়েট স্কুলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। এই পদ থেকে আমি পদত্যাগ করেছি। এবিষয়ে আমি কিছুই জানি না সে কারণে এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। বর্তমানে স্কুলের সভাপতি কে জানতে চাইলে তিনি জানেন না বলে জানান।
অন্যদিকে বড়দল আফতাব উদ্দিন কলেজিয়েট স্কুলের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কৃষ্ণা রায় জানান, বিষয়টা আমার কানে এসেছে। প্রতিষ্ঠানের বর্তমান সভাপতি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আতিয়ার রহমানের সঙ্গে আলোচনা করলে বিস্তারিত জানা যাবে। আতিয়ার রহমান যেহেতু আগেই পদত্যাগ করেছেন বলে জানানো হলে তিনি বলেন, পদত্যাগের বিষয়টি আমি জানা নেই। তাহলে এই মুহূর্তে বড়দল আফতাব উদ্দিন কলেজিয়েট স্কুলের সভাপতি কে? এ বিষয়ে তিনি কোন উত্তর দিতে পারেননি।
আপনার মতামত লিখুন :