জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একাধিক সূত্র দাবি করেছে; সম্প্রতি ১৮ ও ২২ এবং ১৩ নং ক্যাম্পেসহ বেশ কয়েকটি ক্যাম্পে সম্প্রতি বেশ কিছু বিদেশী পিস্তল ও অস্ত্রের চালান ঢুকেছে। ক্যাম্প দখলে নিতে কথিত আরসাই এ অস্ত্রের চালান এনেছে মিয়ানার থেকে। অন্যদিকে আগে থেক ভারী অস্ত্র সজ্জিত হয়ে শক্ত অবস্থানে রয়েছে মাস্টার মুন্না ও নবী হোসেন গ্রুপ। এতে করে দুই গ্রুপের মধ্যে যে কোনসময় বড় ধরনের সংঘাতের ঘটনা ঘটতে পারে বলে অংশকা করা হচ্ছে।
সাধারণ রোহিঙ্গারা বলছে, এখন শুধু রাতে নয়, ক্যাম্পে দিনেও চলছে অস্ত্রের ঝনঝনানি। উখিয়া টেকনাফে ৩২ টি ক্যাম্পেই পরস্পরবিরোধী একাধিক রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ এখন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই শিবিরগুলোর সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খুনাখুনি, অপহরণ, গুম, লুটপাট স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে রূপ নিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে উখিয়া-টেকনাফের পুরো অঞ্চলে। নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে স্থানীয়রা।
জানা গেছে, উখিয়া টেকনাফে রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের এখন একপ্রকার সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। মাদকের কারবার ক্যাম্প কেন্দ্রিক গড়ে উঠা কয়েকটি বাজারের নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ও বাইরে গড়ে উঠেছে সশস্ত্র অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ। তাদের দাপটে পরিস্থিতি ক্রমেই হানাহানির দিকে মোড় নিচ্ছে। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে প্রতিদিন গোলাগুল ও তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুনাখুনির মতো ঘটনা ঘটছে। টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে ক্যাম্পে নিরাপত্তায় নিয়োজিত (পাহারাদার) রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক ও মাঝিদের।
এদিকে ক্যাম্পে অভ্যন্তরে নতুন করে অস্ত্র চালানের পাশাপাশি সীমান্তের জিরো পয়েন্টে থাকা রোহিঙ্গা বড় মাপের অস্ত্রধারী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বেশিরভাই এখন ক্যাম্পে ফিরেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এতে করে কোন সময় ক্যাম্পে বড় ধরনের সংঘাতের আংশকা করা হচ্ছে।এখন ক্যাম্পের অভ্যন্তরেও বাইরে উৎকণ্ঠা ও ভয়-ভীতি আরো বাড়ছে।বিষয়টি স্বীকার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার জন্য বিট পুলিশিং কাউন্সেলিং, নিয়মিত সচেতন সমাবেশ করলেও কোন কাজে আসছে না। উল্টো টার্গেট করে খুন করা হচ্ছে ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবক পাহারাদারদের এবং মাঝিদের। সম্প্রতি উখিয়ার ১৮ নং ক্যাম্পে সন্ত্রাসীরা অতর্কিতভাবে নিরাপত্তায় নিয়োজিত এপিবিএন পুলিশের ওপরেও এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। এতে এক রোহিঙ্গা শিশু নিহত হয়েছে। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এক রোহিঙ্গা নারী।
এ ছাড়াও গত পাঁচ মাসেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ২০ টির মত খুনের ঘটনা ঘটেছে৷ যার অধিকাংশ খুনের শিকার হয়েছেন ক্যাম্পভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতা (মাঝি) ও স্বেচ্ছায় পাহারারত স্বেচ্ছাসেবক৷ গত ২০১৭ সালের পর থেকে ক্যাম্পে এ পর্যন্ত খুনের ঘটনা ঘটেছে ১২০টির বেশি। এ অবস্থায় ক্যাম্পে সন্ত্রাসমুক্ত এবং নিরস্ত্র করণে নিয়মিত সেনা অভিযানের দাবি জানিয়েছে সেখানকার জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়রা।
রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়া পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটি মহাসচিব এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ও বাইরে অসংখ্য সশস্ত্র গ্রুপ গড়ে উঠেছে।তারা মাদকের ব্যবসা অপহরণ ও ডাকাতিসহ এবং নানা অপরাধের করে যাচ্ছে।রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি এসব সশস্ত্র গ্রুপের টার্গেটে পরিণত হয়েছে স্থানীয়রা। রোহিঙ্গারা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলবেঁধে বাড়ি ঘেরাও করে স্থানীয়দের তুলে নিয়ে মারধর করছে।অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করছে। এতে করে দিনদিন স্থানীয়দের নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়ছে।সামনে হয়তো ক্যাম্পের আশাপাশে বসবাস করা কঠিন হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, অন্তত ৩০ হাজার রোহিঙ্গা অস্ত্রধারী রয়েছে বলে আমার মনে হয়। এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের নিরস্ত্র করতে নিয়মিত সেনাবাহিনীর অভিযান অথবা ক্যাম্পের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দিতে হবে। এ ছাড়াও মোবাইল,ইন্টারনেট ব্যবহার নিষিদ্ধ, ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গাদের অবাদে চলাচল বন্ধ করা গেলে কিছুটা অপরাধ কমে আসবে বলে মনে করেন গফুর উদ্দিন চৌধুরী।
রোহিঙ্গা অধ্যুষিত কুতুপালং এলাকার ইউপি সদস্য ইঞ্জিনিয়ার হেলাল উদ্দিন বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যুদ্ধ চললেও; ইয়াবার চালান আসা বন্ধ হয়নি। আর মাদক কারবারকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পে প্রতিদিন গোলাগুলি অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটেই চলছে। আমার মনে হয় মিয়ানমার পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেকে আশান্ত করে তুলছে।ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র মজুত রয়েছে উল্লেখ করে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালনা করে এসব অস্ত্র উদ্ধারের দাবি জানান হেলাল উদ্দিন।
নাম প্রকাশ না করে রোহিঙ্গাদের একটি সূত্র দাবি করেছে, মিয়ানমার সরকারে তাদের অভ্যন্তরে আর্কান আর্মির সাথে যুদ্ধের মধ্যেও ক্যাম্পের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গুলোকে অস্ত্র পেতে সহযোগীতা করেছে। মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন সময় এসব অস্ত্র ও পিস্তল আনা হয়েছে। সূত্রটির দাবি, প্রত্যবাসন ঠেকাতে কৌশলগত কারনে ক্যাম্পকে আশান্ত করে রাখতে চায় মিয়ানমার সরসকার।অভিযোগ আছে, ক্যাম্পে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করছে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী টেকনাফ রঙ্গীখালী এলাকার গিয়াস বাহিনী, সালমানশহ বাহিনী এবং হোয়াইক্যং কাঞ্চর পাড়ার খাইরুল বশরসহ আরও কয়োটি গ্রুপ। তারা ইয়াবার চালানের বিনিময় অস্ত্র সরবরাহ করে থাকে বলে জানা গেছে।
গত ২১ সেপ্টেম্বর হোয়াইক্যং কাঞ্চর পাড়া মেজর অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য খান এর হ্যাচারি পাশে বড় ধরনের একটি অস্ত্রের চালান হাতবদলের ঘটনা ঘটেছে। এদিন মাগরীবের সময় বিদেশি পিস্তলসহ ১০ থেকে ১৫ অস্ত্র খাইরুল বশরসহ কয়েকজন চিহৃত ইয়াবা কারবারি রোহিঙ্গাদের হাতে তুলে দিয়েছেন বলে একাধিক সূত্র দাবি করেছে। এসময় বাদশা নামে একজন অস্ত্রের চালানটি লুটের চেষ্টা করলে মারামারির ঘটনাও ঘটে। সূত্রটি আরও বলছে, ইয়াবার চালানের বিনিময় খাইরুল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়মিত অস্ত্র সরবরাহ করে থাকেন।
যদিও খারুল বশর অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ২১ সেপ্টেম্বর অস্ত্র বিষয়ে আমি কিছু জানি না।তবে ঘটনাস্থল ৫ শতাধিক মানুষ জড়ো হয়েছিল বলে আমি জেনেছি। একটি গ্রুপ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। সম্প্রতি পিস্তল হাতে কয়েকজন রোহিঙ্গা যুবকের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। অস্ত্র হাতে একটি ভিডিও বার্তায় ৪ মাঝিকে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন মো. হাসিম নামের এক যুবক। ভিডিওতে ওই যুবক দাবি করেন, তার মতো ২৫ জন যুবককে অস্ত্র দিয়ে ইসলামী সংগঠন ‘মাহাজ’ নামের একটি সংগঠন। খুনের শিকার মাঝিদের নামও বলেছেন এই যুবক। তারা হলেন ১৮নং ক্যাম্পের হেড মাঝি জাফর, ৭নং ক্যাম্পের ইসমাঈল, কুতুপালং এক্সটেনশন ক্যাম্প-৪ এইচ ব্লকের এরশাদ ও হেড মাঝি আজিমুল্লাহ।
রোহিঙ্গা যুবক আরও বলেন, তাদের সামনে আরও বড় মিশন ছিল। কিন্তু সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। তাই এই খারাপ জগত ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চান। তবে অস্ত্রধারী ওই যুবক গ্রেফতার না হওয়ায় এখনো এ ভিডিও বার্তার রহস্য উদঘাটন হয়নি। ওই যুবকসহ অস্ত্রহাতে ভাইরাল হওয়া আরও কয়েকজনকে ধরতে অভিযান চলছে বলে জানিয়েছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
ক্যাম্পে ফিরেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা : এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নজর রাখা একটি গোয়েন্দ সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানান, ১৮ নং ক্যাম্পে সম্প্রতি কিছু অস্ত্র ঢুকেছে বলে পেয়েছে তারা। এ ছাড়াও ২২ নং ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী একটি পাহাড়ে সশস্ত্র কিছু লোকজন আশ্রয় নিয়েছে। একইভাবে ১৩ নম্বর ক্যাম্পেও কিছু অস্ত্র ও অপরিচিত কিছু লোকজনের আনাগোনা বেড়েছে বলে তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দা সংস্থা।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব থাকা ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক মোহাম্মদ। তিনি বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলির কারণে এখন সীমান্ত অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ কারণে জিরো পয়েন্টে থাকা রোহিঙ্গা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফিরে এসেছে। তারা মাদকের কারবার অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়,ধর্ষণ সহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। টার্গেট করে রোহিঙ্গাদের মাঝি ও নিরাপত্তায় নিয়োজিত কয়েকজন সেবকদের খুন করেছে। তাদের ধরতে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে, অনকেই ধরাও পড়েছে। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
ক্যাম্পে নতুন করে অস্ত্র চালান ঢুকার প্রসঙ্গে সহকারী পুলিশ সুপার মো. ফারুক মোহাম্মদ বলেন, আমাদের কিছু তথ্য রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং আমাদের নিজস্ব সংস্থার গোয়েন্দা ইউনিটির সদস্যদের সাথে সমন্বয় করে আমরা অভিযান পরিচালান করে যাচ্ছি আপনারাও তথ্য দিয়ে সহয়তা করুন।সব ধরনের অপরাধীদের আইনের আওয়াতায় আনা হবে।
রোহিঙ্গা নেতাদের তথ্যমতে, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রতিরোধের মূখে ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সশস্ত্র গ্রুপ আরসা। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের জন্য আরসাকে দায়ি করা হয়।
হত্যাকেণ্ডের পর ক্যাম্পে প্রায় নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আলোচিত নবী হোসেন ও মাস্টার মুন্না গ্রুপ এর কাছে। এখন আরসা আবারও ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ ফিরে ফেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এতে করে ক্যাম্পের প্রতিদিন হত্যাকাণ্ড ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে।সামনে আরও বড় ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে এমন আংশকা কথা জানিয়ে সর্তক করেছে দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থাও।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, এখন ইয়াবা চালানের সাথে অস্ত্র বাধ্যতামূলক নিতে হয়। এর মানে হচ্ছে, ইয়াবা চালানের সাথে রোহিঙ্গা নিয়মিত অস্ত্রো নিয়ে আসছো। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অস্ত্রসহ ধরা পড়া কয়েকজনও অস্ত্রের বিনিময় ইয়াবা চালানের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
এদিকে সম্প্রতি ক্যাম্পে বেশ কয়েকটি হামলার সাথে জড়িত বলে নাম এসেছে ইসলামী মাহাস নামের এটি ধর্মীয় সংগঠনের। তবে, দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, ইসলামী মাহাসের অস্থিত্ব ক্যাম্পে নাই। মূলতো আরসা ও মাস্টার মুন্না গ্রুপের সদস্যরা ইসলামী মাহাসের নাম ভাঙিয়ে হামলা চালাচ্ছে যাতে করে প্রশাসন ও রোহিঙ্গাদের চোখে ধুলো দেওয়া যায়।
অর্ধশতাধিক সশস্ত্র বাহিনী ও সদস্য কারা: গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃংঙ্খলা বাহিনী,স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গাদে নেতাদের তথ্যমতে, ক্যাম্পের ভিতরে ও বাইরে অন্তত অর্ধশতাধিক ছোট বড় সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে উঠেছে। প্রত্যেক বাহিনীতে ৩০ থেকে ১০০ জন পর্যন্ত সদস্য রয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে ক্যাম্পগুলো হয়ে ওঠে অপরাধের অভয়ারণ্য। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি ও খুনাখুনিতে জড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা। তথ্যমতে, ক্যাম্পে অধিক পরিচিত সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে রয়েছে মাস্টার মুন্না গ্রুপ, আলোচিত নবী হোসেন গ্রুপ,মৌলভী ইউসুফ গ্রুপ, রকি বাহিনী, শুক্কুর বাহিনী, আব্দুল হাকিম বাহিনী, সাদ্দাম গ্রুপ, জাকির বাহিনী, পুতিয়া গ্রুপ, সালমান শাহ গ্রুপ, গিয়াস বাহিনী,মৌলবী আনাস গ্রুপ, কেফায়েত, জাবু গ্রুপ, আবু শমা গ্রুপ, লেড়াইয়া গ্রুপ, খালেদ গ্রুপ ইত্যাদি। শাহ আজম গ্রুপ, ইব্রাহিম গ্রুপ, খলিল গ্রুপ।
ক্যাম্পের একাধিক বাসিন্দা ও আইনশৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব গ্রুপের কিছু সদস্যের নামও পাওয়া গেছে। তারা হলেন- আবদু জব্বার,নুরুল আমি, শাহ আলম, মোঃ কেফায়ত,নুরুন নবী, আবদুল হাকিম, সুলতান, জকির আলম,মো. আব্দুল্লাহ ওরফে দাদা ভাই, বুলু, সুলতান, নবী হোসেন, সফিক, রফিক, মুর্তজা, হামিদুল্লাহ, আবদুস শুকুর, শরীফ হোসেন, মো. রহমান, সবেদ উল্লাহ, আব্দুল্লাহ, ফয়সাল, মো. সোলাম, হামিদ হোসেন, মুহিবুর রহমান, দিলদার, আবু সাইদ, তাহের, ফারুক, মুক্কুস, জুবায়ের, মুস্তফা, আব্দুল্লাহ আইদি, হাসন শরীফ, আব্দুল জলিল, হাফেজ উল্লাহ, আরমান খান, আইয়ুব, আমির হোসেন, নুর ইসলাম, আলী আকবর, কামাল, জাইবু রহমান, নাজিমুদ্দিন, সোনা উল্লাহ ও আরাফাত।
অভিযোগ আছে, নবী হোসেন, মাস্টার মুন্না গ্রুপসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিক্তিক বেশিরভাগ সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিদের যোগাযোগ রয়েছে। ক্যাম্প অশান্ত করার জন্য সন্ত্রাসী গ্রুপকে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা ফ্রিতে দিচ্ছে মিয়ানমার সরকার। মূলত বিশ্বের দরবারে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরা, আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়াকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করা এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত করতে চায় মিয়ানমার।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ ধরনের অপরাধে মোট দুই হাজার ৪৩৮টি মামলা হয়েছে৷ এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা পাঁচ হাজার ২২৬ জন৷ এই পাঁচ বছরে অস্ত্র উদ্ধার মামলা ১৮৫টি, মাদক উদ্ধার মামলা এক হাজার ৬৩৬টি, ধর্ষণ মামলা ৮৮টি, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় বা আদায়ের চেষ্টার মামলা হয়েছে ৩৯টি৷ পাঁচ বছরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১১০টি৷ হত্যা মামলা হয়েছে ১০০টি৷ জোড়া খুনের ঘটনা ঘটেছে ছয়টি৷ যদিও বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থার হিসেবে ১২০টির বেশি হত্যাকেণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
ছাড়াও, অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুুতি, মানব পাচারসহ ১২ ধরনের অপরাধে রোহিঙ্গারাদের নামে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে গত আগস্ট পর্যন্ত মাত্র এক বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২ ধরনের অপরাধে মামলা হয়েছে এক হাজার ১৪০টি৷ এই সময়ে অস্ত্র উদ্ধার ৯৮টি, মাদক উদ্ধার ৮৭৪টি, ধর্ষণ ২৩টি ও হত্যা মামলা হয়েছে ৩০টি।নিরাপত্তায় নিয়োজিত রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে: টার্গেট করে ক্যাম্পে নিরাপত্তায় নিয়োজিত রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক এবং মাঝিদের হত্যা করা হচ্ছে।গত পাঁচ মাসে ক্যাম্পে ২০টির মত হত্যাকেণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।তাদের বেশিরভাই স্বেচ্ছাসেবক ও মাঝি বলে জানাগেছে।
সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ এরশাদ নামের একজন স্বেচ্ছাসেবক খুন হন৷ ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর নামের এক নেতা৷ ১৮ সেপ্টেম্বর খুন হন আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস৷ ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন৷ ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নেতা মারা যান৷ গত ২২ জুন কথিত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) গুলিতে নিহত হন৷ ৩ মে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)৷
পুলিশ জানায়, ক্যাম্পে রোহিঙ্গারাই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছে৷ এই স্বেচ্ছাসেবকরাই এখন সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন৷ ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে তিনজন এডিশনাল ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তার নেতৃত্বে আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন তিনটি পৃথক ইউনিট ৮,১৪,১৬ এর অধীনে প্রায় দুই হাজার পুলিশ সদস্য কাজ করে যাচ্ছে।
সব তথ্য উল্লেখ করে জানতে চাইলে ১৪ এপিবিএন এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ হারুন-অর-রশিদ বলেন, ক্যাম্পে অস্ত্রের চালান ঢুকছে কিনা জানি না। তবে, ক্যাম্পে হানাহানি ও সংঘাত বন্ধে সন্ত্রাসী ও অস্ত্রবান এবং ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িতের ধরে নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এখন আগের চেয়ে আরও বেশি গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করা হয়েছে। অস্ত্র চালান ঢুকার তথ্যটি খতিয়ে দেখা হবে। তিনি আরও বলেন, যে কোনমূল্য আমরা ক্যাম্প থেকে সন্ত্রাস, অস্ত্র ও মাদকমূক্ত করতে চাই। সেভাবে কাজ করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
রোহিঙ্গা শিবিরে নিরাপত্তায় নিয়োজিত ১৬ এপিবিএন এর অধিনায়ক এডিআইজি হাসান বারী নুর বলেন, ক্যাম্পে এপিবিএন পুলিশের তিনটি ইউনিটে ই সন্ত্রাসী অস্ত্রাবাজী ও মাদক কারবার বন্ধে অভিযানের পাশাপাশি, বিট পুলিশিং কাউন্সেলিং, সচেতনা বৃদ্ধির সমাবেজসহ নানা ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সম্প্রতি সংঘটিত খুনের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জড়িতের আইনের আওয়াতায় আনা হয়েছে।ধরাছোঁয়া বাইরে থাকা অপরাধীদেরও ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
কক্সবাজার পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ও ক্যাম্পের বাইরে সন্ত্রাসী গ্রুপ গুলোকে নির্মূল করার জন্য কাজ করছে পুলিশ ও আইনশৃংঙ্খলা সংস্থা গুলো। সন্ত্রাসীদের চিহৃিত করে পরিকল্পনা অনুয়ায়ী তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। স্থানীয়দের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে সামনে চলমান অভিযান আরও বেশি জোরালো হবে বলে উল্লেখ করে স্থানীয়রা যারা এসব সন্ত্রাসীদের পৃষ্টপোষকতা করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান এসপি।
ক্যাম্পে সেনাবাহিনী মোতায়েন প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর অব. মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলামের মতে শরণার্থী ক্যাম্প পাহারা দেয়া সেনাবাহিনীর কাজ না। তিনি বলেন, প্রত্যাবাসান না হওয়া পর্যন্ত প্রশাসনকে কঠোর উদ্যোগী হতে হবে। ক্যাম্পবর অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে কারা, মদদ দিচ্ছে করা, সবাইকে চিহৃিত করে কঠোরভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি কোন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দিয়ে দেশের বিরুদ্ধে কাজ করাচ্ছে কিনা, কারা করাচ্ছে সেটাও চিহৃতি করতে হবে। এ জন্য প্রশাসনের উপস্থিতি আরও বৃদ্ধি করতে হবে।এবং গোয়েন্দা তৎপরতাও আরও বৃদ্ধি করতে হবে। এসব উদ্যোগ নিলে ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব মনে করেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।
আপনার মতামত লিখুন :