ঢাকা : প্রত্যেক যাত্রীর বিমান ভাড়া থেকে এমবারগেশন ফি, ট্রাভেল ট্যাক্স, ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স, এক্সাইজ ডিউটি ট্যাক্স ছাড়াও বিমান বন্দরের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য ৯৩৩ টাকা করে নেয় বেসমারিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। যাত্রীরা ভাড়ার সঙ্গে এসব ফি দিলেও সেবা পাচ্ছেন না। উল্টো বিমানবন্দরে ট্রলি না পেয়ে লাগেজ মাথায় নিতে হচ্ছে তাদের। দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরের এমন বেহাল দশায় বাংলাদেশিদের পাশাপাশি বিদেশি যাত্রীরা ক্ষুব্ধ। কয়েক মাস ধরে এই সমস্যা প্রকট রূপ নিলেও এখনও কোনও সমাধান বের করতে পারেনি বেবিচক। গত ৯ ডিসেম্বর রাতে বিমান বন্দরে দেখা গেলো, কয়েকজন বিদেশি যাত্রী ট্রলির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও না পেরে লাগেজ ও অন্যান্য মালামাল টেনে-হেঁচড়ে বের করতে হয়েছে তাদের। যাদের একাধিক লাগেজ আছে তারা একটিকে মাথায় বয়ে নিয়ে কিছুদূরে রেখে এসে অন্যটি তুলে নিচ্ছেন।
বিদেশ থেকে আসা ফ্লাইট অবতরণের পর যাত্রীরা ইমিগ্রেশন শেষ করে লাগেজ বেল্ট থেকে নিজেদের মালামাল সংগ্রহ করেন। সেখানেই ট্রলি প্রয়োজন। কারণ মালামাল নিয়ে যাত্রীরা কাস্টম জোনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যান। কিন্তু এখন লাগেজ বেল্টে ট্রলি না পেয়ে অপেক্ষা করতে হয় যাত্রীদের। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কখনও কখনও ট্রলি পাওয়া যায়। অনেকে ট্রলি না পেয়ে বাধ্য হয়ে বেল্ট থেকে মাথায় করে লাগেজ নিয়ে কাস্টম জোনে আসেন। এরপর আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফের মাথায় লাগেজ নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হতে হচ্ছে তাদের।
বিশ্বের প্রায় সব বিমানবন্দরে যাত্রীরা টার্মিনাল থেকে পার্কিং জোন পর্যন্ত ট্রলি ব্যবহারের সুবিধা পান। কিন্তু হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ক্যানোপির (যাত্রী ছাউনি) বাইরে ট্রলি নেওয়ার সুযোগ নেই। এ কারণে যেসব যাত্রীর গাড়ি পার্কিং জোনে থাকে তাদের ল্যাগেজ নিয়ে দুর্ভোগে পড়তে হয়। বাধ্য হয়ে মাথায় লাগেজ নিয়ে বের হওয়ার চিত্র প্রতিদিনের।
যাত্রীদের ভোগান্তির কথা ছেড়ে কয়েক বছর আগে ট্রলিম্যানদের ট্রলি সংগ্রহে কষ্ট হবে বিবেচনা করে ক্যানোপি গ্রিল দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন নারী, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তিরা। এছাড়া একাধিক লাগেজ বহনকারীরা পড়েন নিরাপত্তা ঝুঁকিতে। কারণ প্রায়ই লাগেজ চুরি, ভুলে ফেলে যাওয়া কিংবা বদলে যাওয়ার ঘটনা হচ্ছে বিমানবন্দরে। একইভাবে যেসব যাত্রী বিদেশ যাচ্ছেন তারাও ট্রলি সংকটে ভোগান্তিতে পড়ছেন। শাহজালাল বিমানবন্দরে বর্তমানে দিনে গড়ে ১০০টি ফ্লাইট চলাচল করে। এগুলোতে প্রায় ২০ হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। যাত্রীদের জন্য বিমানবন্দরে প্রায় ২ হাজার ২০০টি ট্রলি আছে। এর মধ্যে ১ হাজারের বেশি ট্রলি ব্যবহারের অনুপযোগী।
একইদিনে কাছাকাছি সময়ে পাঁচটি আগমনী ও পাঁচটি বহির্গমন ফ্লাইট থাকলে কমপক্ষে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার ট্রলির প্রয়োজন পড়ে। এসব ট্রলি ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত জনবলও নেই বিমানবন্দরে। যে কয়েকজন ট্রলিম্যান কাজ করেন তারা প্রটোকলসহ অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। ট্রলিম্যানদের জন্য নির্ধারিত পোশাক থাকলেও তারা তা ব্যবহার করেন না। এ কারণে যাত্রীরা ট্রলি খোঁজায় সহায়তা পান না। যাত্রীদের ব্যবহারের পর সীমিতসংখ্যক ট্রলি এখানে-সেখানে পড়ে থাকলেও সেগুলো সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে উদাসীন ট্রলিম্যানরা। যাত্রীদের প্রশ্ন, একটি ট্রলির দাম কত এবং উন্নয়ন ও নিরাপত্তা ফি নিলেও তার বিপরীতে যাত্রীদের কী সেবা দেয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ?
অনলাইনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আকৃতি ও মানের ভিন্নতায় একটি ট্রলির দাম ৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। একটি ফ্লাইটে গড়ে ২০০ জন যাত্রী থাকলে বিমানবন্দর উন্নয়ন ও নিরাপত্তা ফি আদায় হচ্ছে জনপ্রতি ৯৩৩ টাকা করে মোট ১ লাখ ৮৬ হাজার ৬০০ টাকা। মোটামুটি মানের একটি ট্রলি ১৫ হাজার টাকা ধরলে একটি ফ্লাইটের যাত্রীদের ফি থেকেই ১২টি ট্রলি কেনা সম্ভব। সারাদিনে ১০০টি ফ্লাইট চলাচল করলে সেগুলোর যাত্রীদের ফি দিয়ে দিনে কমপক্ষে ১ হাজার ২০০টি ট্রলি কিনতে পারেন বেবিচক।
সৌদি আরব থেকে আসা আবুল আলিম হতাশা নিয়ে বলেন, আমরা বিদেশে কী সেবা পাই আর দেশে এসে কী দেখতে হয়! সরকারি কর্মকর্তা-মন্ত্রীরা যে বিদেশ যান, তারা কি মাথায় লাগেজ নেন কিংবা কাউকে মালামাল মাথায় নিতে দেখেন? বিদেশ ঘুরে তারা কী শিক্ষা পান? কী কাজে লাগে এসব অভিজ্ঞতা? আমার কথা বাদ দিলাম, আমি তো কামলা (শ্রমিক); এই যে বিদেশি লোকজন আমাদের দেশে এসে তারা ট্রলি না পেয়ে লাগেজ মাথায় নিচ্ছে, এটা দেখলে তো নিজের কাছেই লজ্জা লাগে। ন্যূনতম লজ্জাবোধ থাকলে বিমানবন্দরে দিনের পর দিন এই দৃশ্য দেখা লাগতো না।
দুবাই থেকে আসা মো. রফিকুল ক্ষোভ নিয়ে মন্তব্য করেন, বিমানবন্দর তো কেউ বিনামূল্য ব্যবহার করছে না। সরকার নানান ট্যাক্স আর চার্জ নিচ্ছে। এসব টাকা কার পকেটে যায় এবং কী হয় সেই জবাবদিহিতা নেই। অযোগ্য লোকজন চেয়ারে বসে আছে দেখে আজ আমাদের মাথায় লাগেজ বয়ে নিতে যেতে হচ্ছে।
ট্রলি না পেয়ে ক্ষুব্ধ যাত্রীদের অনেকেই বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। মুনসুর আলী নামের একজন যাত্রী বলেন, ‘একটা ট্রলির দাম কত টাকা? বিদেশে সুপার শপের পার্কিংয়ে যে পরিমাণ ট্রলি থাকে তার অর্ধেকও এই বিমানবন্দরে নাই। হাজার হাজার মানুষ লাগেজ মাথায় নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হচ্ছে, লজ্জা থাকলে মন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত।
কেন ট্রলি কেনা হচ্ছে না জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাহজালাল বিমানবন্দরের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিমানবন্দর থেকে বিভিন্ন চার্জ আদায় হলেও সেই টাকা বেবিচকের কাছে জমা থাকে। বিমানবন্দরের জন্য কোনও কিছু কেনার প্রয়োজন হলে তাদের কাছে আবেদন করতে হয়। বেবিচকের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড স্টোর ইউনিট (সেমসু) সেই পরিপ্রেক্ষিতে উদ্যোগ নেয়। এমনকি কোন মানের জিনিসপত্র কেনা হবে সেই সিদ্ধান্তও তারাই নেয়। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের নিজে থেকে কিছু কেনার সুযোগ নেই। এখন সেমসু যদি গুরুত্ব না দেয় কিংবা গড়িমসি করে তাহলে তো বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কিছু করার নেই। ট্রলি কেনার বিষয়টি অনেক আগেই জানানো হয়েছে, এখন পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে তাদের ওপর।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী ট্রলি সংকটের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ৫০০টি নতুন ট্রলি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সহসা চলে আসবে। যেসব ট্রলি আমাদের সংগ্রহে আছে সেসব নিয়ে হয়তো মিস ম্যানেজমেন্ট হচ্ছে। সেদিন দেখলাম বিমানবন্দরের প্রবেশপথে অনেক ট্রলি। সেগুলো যেন যথাস্থানে থাকে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
আপনার মতামত লিখুন :