বিশেষ প্রতিনিধিঃ রাজধানীর মুগদা থানার ৭১ এবং ৭২নং ওয়ার্ড, রাস্তার এপার-ওপার। ৭১-এ কাউন্সিলর খায়রুজ্জামান খায়রুল আর ৭২-এ শফিকুল আলম শামীম। আবার তারা দুজনেই মান্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এলাকায় তারা দুজনে ‘দ্বিরত্ন’ নামে পরিচিত। মান্ডা এলাকার শেষ মাথায় কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নির্মাণের কাজ চলছে। এই কাজ শুরু করতে গিয়ে বারবার বাধার মুখে পড়তে হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। শেষ পর্যন্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৭২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিকুল আলম শামীমের ‘অনুমতি’ পাওয়ার পর রাতারাতি দূর হয়ে যায় সব ‘বাধা’। এখন নির্বিঘ্নেই চলছে নির্মাণকাজ। তবে ‘অনুমতি’ পাওয়ার নেপথ্যের কথা জানতে চাইলে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকপক্ষরা আক্ষেপের সুরে শুধু বলেন, কুমিরের মুখের সামনে থেকে এত কথা বলা যায় না।
অন্যদিকে যারা তাদের চাহিদা মতো চাঁদা দেয়নি তাদের প্রতিষ্ঠানের সামনে ইটের ওয়াল করে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছেন এই দুই কাউন্সিলর, যা বর্তমানে চলমান এবং ময়লার ডাম্পিং স্টেশন করবে বলেও হুমকি দিচ্ছে। আব্দুল মালেক (ছদ্মনাম) নামের একজন জমির মালিক বলেন, আমার দোকানসহ আরও কয়েকজনের দোকানের সামনে দেয়াল দিচ্ছে যেন আমাদের দোকান পেছনে পরে যায়। আর যারা তাদেরকে টাকা দিয়েছে তাদের দোকানের সামনে সুন্দর করে রাস্তা করে দিচ্ছে।
আনন্দনগর রাস্তা দিয়ে চলাচলের মুখে মাত্র ১২ ফিট রাস্তা রেখেছে। অথচ এ রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন ১২-১৩ হাজার লোক যাতায়াত করে। কিছুদিন আগে এখানে উচ্ছেদ অভিযানের নামে কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে দ্বিরত্ন কাউন্সিলররা। যারা তাদের টাকা দিয়েছে তাদের স্থাপনায় কোনো কিছুই হয়নি। আর যারা দেয়নি তাদের স্থাপনায় বুলডোজার দিয়ে দুই হাতের পরিবর্তে ১০ হাত উচ্ছেদ করিয়েছেন। এ ব্যাপারে মেয়রের বরাবর লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
মান্ডা শেষ মাথায় দেখা গেছে, একজনের দোকানের সামনে ইট দিয়ে পুরো ব্যারিকেড দেওয়া। সমস্ত রাস্তার পাশে সিরামিক ইট দেওয়া আর এখানে একটু ব্যতিক্রম। এই কাজে দায়িত্বরত প্রকৌশলী বাহাউদ্দিন আহমেদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ জায়গায় আমরা সিটি করপোরেশন কিছুই করিনি। এখানে কাউন্সিলরের ব্যক্তিগত রেশারেশি আছে একজনের সঙ্গে। আর তিনিই নিজ উদ্যোগে এই বাউন্ডারি দিচ্ছেন। দেয়াল নির্মাণের বিষয়ে জানতে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা-৭ কে ফোন করলে তিনি বলেন, আমি প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে জানাচ্ছি। কিন্তু পরবর্তীতে তাকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়াও এলাকার প্রধান সড়কের দুই পাশে বাজার বসিয়ে এবং ব্যাটারিচালিত রিকশার টোকেন বাণিজ্য করে মাসিক প্রায় ৫০ লাখ টাকার বাণিজ্য করেন এই দ্বিরত্ন কাউন্সিলররা।
মান্ডা, গ্রীন মডেল টাউন, ঝিরানি খালপাড় ও আনন্দনগর, টাকি পাড়া, মেইন রোড, মধ্য পাড়া, বড় পাড়া নিয়ে ৭২ ও ৭১ নম্বর ওয়ার্ড। বেশ কয়েক দিন ওই ওয়ার্ড ঘুরে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে কাউন্সিলর শামীম এবং খায়রুল ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। নতুন বাড়ি তোলার আগে অবশ্যই এই দ্বী-রত্নের সম্মতি নিতে হয়। সে জন্য দিতে হয় মোটা অঙ্কের চাঁদা। এ ছাড়া জমি ও বাড়ি দখল, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ এবং বিচার-সালিশের নামে টর্চার সেল চালানোর অভিযোগও পাওয়া গেছে এই দুই জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে।
এলাকার লোকজনের অভিযোগ, কাউন্সিলর শামীম ও খায়রুলের যাবতীয় অপকর্মের অন্যতম সহযোগী চিহ্নিত অপরাধী ইমন, শুভ, সুমন, মুরাদ, মিজান ও মামুন। তাদের মধ্যে ইমন নিয়ন্ত্রণ করেন মাদকের কারবার। এই গ্রুপটি প্রায়ই এলাকার বিভিন্ন প্রতিবাদী মুরব্বিদের চর-থাপ্পর দিয়ে রাস্তাঘাটে অপমান করে, যাতে করে কাউন্সিলরদের নিয়ে সবার ভেতরে আতঙ্ক বিরাজ করে।
এ ব্যাপারে এক কলেজ শিক্ষক বলেন, এই গ্রুপটি কিছুদিন আগে আমাদের এলাকার একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় হাজি সাহেবকেও হামলা করে রক্তাক্ত করেছিল। যদিও থানায় মামলা নেয়নি। পরে হাজি সাহেব কোর্টে মামলা করেছিলেন। অদ্যাবদি কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি বরং থানায় প্রায়ই ওসি সাহেব তাদের দাওয়াত করে খাওয়ান।
একাধিক দিন ৭২ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন স্থান ঘুরে ভুক্তভোগীদের নানা অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। তবে কাউন্সিলরের লোকজন এতটাই বেপরোয়া যে, তাদের অপকর্ম নিয়ে মুখ খুলতেও ভয় পান সবাই। কেউ কেউ কথা বলেছেন নাম-পরিচয় গোপন রেখে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, একটি হত্যা মামলার তালিকাভুক্ত আসামি ৭১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর খায়রুজ্জামান খায়রুল। তার নামে পরোয়ানা থাকলেও তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে না।
অবশ্য মুগদা থানা আওয়ামী লীগ নেতা এবং ওই ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা আবু তাহের বলেন, এলাকাটি পুরোপুরি অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। যারা এসব অপরাধ দমন করবেন, তারাই যদি এসবের নেতৃত্বে থাকেন- তাহলে কী অবস্থা হয়, তা এলাকার বাসিন্দারা টের পাচ্ছেন। দখল, চাঁদাবাজি আর মাদক- সব অপরাধই আছে ৭১ ও ৭২ নম্বর ওয়ার্ডে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলাকার দু’জন স্কুলশিক্ষক প্রায় একই কথা বলেন। তারা জানান, কাউন্সিলরের লোকজনের অত্যাচার তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। সবাই মুখ বুজে সহ্য করছেন।ভুক্তভোগীদের একজন বলেন, কাউন্সিলর শামীম এবং খায়রুলের কাছে কেউ জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিচার-সালিশ নিয়ে গেলে তিনি আগে দলিল দেখতে চান। দলিলে ঝামেলা থাকলে তিনি আগ্রহ দেখান। ওয়ারিশদের মধ্যে ঝামেলা লাগিয়ে তিনি একটা অংশ নামমাত্র মূল্যে লিখে নেন। বিচারপ্রার্থী দুর্বল হলে শেষ পর্যন্ত ওই জমি গ্রাস করে নেন তিনি। আবার ওয়ারিশ সনদও বিক্রি করেন হাজার হাজার টাকায়। এর বাইরে মান্ডা মেইন রোডের কাঁচাবাজারের নিয়ন্ত্রণও দুই কাউন্সিলর ও তার লোকজনের হাতে। ওই বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বাজারে ৫ শতাধিক অস্থায়ী দোকান রয়েছে। প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক ২০০ টাকা চাঁদা নেয় কাউন্সিলরের লোকজন।
মহল্লা নিয়ন্ত্রণ কমিটি: মুগদা মান্ডা এলাকার লোকজন জানান, কাউন্সিলর শামীম এবং খায়রুল পুরো এলাকায় তার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে বিভিন্ন মহল্লায় তার অনুসারীদের দিয়ে বিশেষ কমিটি করেছেন। অলিগলিতে দোকান ভাড়া করে বানানো হয়েছে এসব কমিটির ক্লাব। এসব গলি কমিটি তদারকি করেন শুভ এবং ইমন। কমিটির কাজ হচ্ছে, এলাকায় কেউ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে কথা বললেই তা প্রতিরোধ করা। কোনো গলিতে নতুন বাড়ির কাজ শুরু হলে তা কাউন্সিলরের নজরে আনে ওই কমিটির সদস্যরা। কোনো বাড়িতে বিদ্যুৎ, পানি বা গ্যাস লাইন লাগলেও গলি কমিটি তা তদারকির দায়িত্ব নেয়। সব কাজেই তাদের চাঁদা দিতে হয়। এলাকার লোকজনের কাছে এই মহল্লা কমিটি এক আতঙ্কের নাম। কারণ কমিটি যেভাবে চায়, তা না হলে এলাকাবাসীর ওপর নেমে আসে নির্যাতন। বিচার-সালিশের নামে ক্লাবে ধরে নিয়ে টাকা আদায় থেকে শুরু করে নির্যাতনও চালানো হয়।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুভ ছাড়াও মহল্লা কমিটিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ইমন, সুমন, মামুন ও সিরাজুল। তবে পাশের ওয়ার্ডে পলাশ নামের এক সন্ত্রাসীও এই কমিটির অন্যতম সদস্য। সালিশের নামে নির্যাতনের প্রায় সব ঘটনায় এই পলাশের সরব উপস্থিতি দেখা যায়।
জানা গেছে, পুরো এলাকায় মাদক বিক্রির জন্য একটি কিশোর গ্যাং গ্রুপও রয়েছে তাদের সহযোগী শুভর। ওই দলে ১৫-২০ জন রয়েছে। যাদের সবার বয়স ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। এ গ্রুপটি এলাকায় মাদক বিক্রি করে থাকে।ওয়ার্ডের একজন বাসিন্দা বলেন, গোটা এলাকাটি যেন মাদকের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। এখানে ভালোভাবে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
৭১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর খায়রুজ্জামান খায়রুল সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং টানা দুই বারের কাউন্সিলর। প্রতিপক্ষ গ্রুপ সব সময় তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। পলিটিক্যাল কমিটি ছাড়া আর কোনো কমিটির বিষয়ে আমি জানি না। হত্যা মামলার ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা আইনগত বিষয়। এগুলো নিয়ে কথা বলব না। গলি নিয়ন্ত্রণ কমিটিগুলোর বিষয়ে কাউন্সিলর খায়রুল বলেন, আমার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের ১০টি ইউনিট কমিটি রয়েছে। এর বাইরে কোন কমিটি কী করল, সে দায়িত্ব আমি নেব না। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি জনগণের সেবা করি।
৭২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল আলম শামীম অভিযোগের বিষয়ে বলেন, আমার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ মিথ্যা এবং শুভ, ইমন ও সুমন- তারা মাদক বেচা তো দূরের কথা, একটা সিগারেটও খায় না বলে তিনি দাবি করেন।
ভুক্তভোগীদের দাবি ৭১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর খায়রুজ্জামান খায়রুল এবং ৭২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল আলম শামীমের পালিত সন্ত্রাসীদের সালিশের নামে নির্যাতনের হাত থেকে আমরা মুক্তি চাই।
আপনার মতামত লিখুন :