নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ রাজধানীর বনানীর ১১ নাম্বার রোডে এক যুবকের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তল্লাশি করছিলেন এক ব্যক্তি। একপর্যায়ে সে যুবকের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। যে হাতকড়া পরালেন সে পুলিশের ‘ফর্মা’ শহীদ। তার হাতে ওয়াকিটকি। তার পাশেই ছিলেন বনানী থানার এক কর্মকর্তা। সেই যুবককে তারা হাতকড়া পরিয়ে মোটরসাইকেলে বসিয়ে নিয়ে গেলেন। শহীদের কালার করা চুলের স্টাইল,পোশাক, চালচলন দেখেই মনে হয় অপরাধী। কিন্তু ভাব নেয় পুলিশের। বনানীতে মাঝে মধ্যে-ই এমন দৃশ্য দেখা যায়। নানা ঘটনা-রটনায় যেমন বেপরোয়া বনানী থানার পুলিশ,তেমনি তাদের সোর্স বা ফর্মারাও। গত ২৯ আগষ্ট দুপুরের ঘটনা। বনানী থানাধীন সাততলা বস্তি এলাকা হতে স্থানীয় এক ফর্মার সাথে ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে ওই ফর্মার দেওয়া তথ্যতে চারজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে প্রিপারেশন ডাকাতি মামলা দেয় সাততলা বিট ইনচার্জ এসআই সিদ্দিক। এসময় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে একজনের সাথে থাকা ১৭ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ফর্মার বিরুদ্ধে। মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়, গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে একটি ছুড়ি, দুইটা চাকু, একটি রড এবং চারটি মোবাইল পাওয়া যায়।
এবিষয়ে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা হাসতে হাসতে মন্তব্য করেন, এখনকার সময়ে ডাকাতরা কতটা স্মার্ট এসব সামান্য অস্ত্র নিয়ে ডাকাতি করতে যায়। পুলিশের ভাষায় বোঝা যায় তাদের ফাঁসানো হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাততলা এলাকা হতে চারজনকে গ্রেফতারের ঘটনায় পুলিশ ও ফর্মাদের বিতর্কিত ভূমিকা ছিল। আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ তাদের কাছে কোনো অস্ত্র পায়নি।
ঘটনার দিন এসআই সিদ্দিকের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এবিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাততলা এলাকার এক বাসিন্দা জানান, মহাখালী সাততলা ফাড়ির ইনচার্জ সিদ্দিকের সোর্স, বডু জাকির, পিচ্চি কবির ও আনোয়ার। তারা সাততলা এলাকায় মাদক ব্যবসা ও জুয়ার আসর নিয়ন্ত্রণ করে।
আরিয়ান সুমন নামক এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, বনানী থানার এসআই সিদ্দিকুর রহমান এবং এএসআই এনায়েত সবচাইতে ভয়ংকর চালবাজ। তাদের সাথে কনস্টেবল কাউসার। আরো আছে ফর্মা ওয়াসিম ও ওবায়দুল। তারা সবাই মিলে ভালো মানুষকে অপরাধী সাজিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে এক্সপার্ট। ওবায়দুল হচ্ছে এলাকার একজন পিয়ন সে কোন কনস্টেবল বা আনসার নয় তারপরও সে পুলিশের হ্যান্ডকাপ নিয়ে আসামি ধরে।
বনানীর বহু ফর্মা বেপরোয়া। মদ, গাঁজা, ইয়াবা বেচা-কেনা-সেবনে তারা সিদ্ধহস্ত। পাকা হাতে চালান নানা অপরাধ, ডর-ভয়হীন। তাদের কিছু হয় না। মাথার ওপর পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) সহকারী উপপরিদর্শকের (এএসআই) হাত থাকায় তারা অকুতোভয়।
নির্দিষ্ট এলাকায় নাম ও পরিচয় গোপন রেখে ওই এলাকার বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য নেওয়ার নিয়ম রয়েছে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীতে। অপরাধী শনাক্ত ও বিভিন্ন মামলার তদন্তে পুলিশকে সহযোগিতা করেন যারা তারাই সোর্স বা ফর্মা বিশেষণে পরিচিত। সহযোগিতার বিপরীতে তারা কিছু ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করেন। নিয়মিত তথ্য দাতাদের দেওয়ার কথা ‘সোর্স মানি’। কিন্তু সোর্স মানি না দিয়ে অন্য সুযোগ সুবিধা দেন থানার পুলিশরা। এসবের কারণে বেপরোয়া এই ফর্মারা।
এলাকার দাগী আসামি, মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসীদের মধ্যেই কেউ কেউ সোর্স হন। কোনো বাহিনীর স্বীকৃতি সদস্যও নন তারা। পুলিশ সদস্যরা ‘ব্যক্তিগতভাবে’ তাদের নিজের জন্য নিয়োগ করেন।‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা’ বলে যে একটি প্রবাদ আছে, সেটি প্রতীয়মান হয় এসব সোর্সদের দিকে তাকালে। কেননা, তারা মাদক স্পটসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত।পুলিশের সঙ্গে চলাফেরার কারণে বনানীর সাধারণ মানুষের কাছে এসব সোর্স বা ফর্মা এখন ‘আতঙ্ক’।
বনানী থানা এলাকায় এসব ফর্মারা ফুটপাত থেকে শুরু করে বস্তির নানা পণ্যের দোকানিদের জ্বালাতন করেন। ‘হপ্তা’ না দিলে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া, দলবল নিয়ে ভীতি ছড়িয়ে অর্থ আদায় করেন তারা। এসব ঘটনার নীরব সাক্ষী সাততলা বস্তি এলাকার চা-সিগারেট বিক্রেতা হাসেম। তিনি বলেন, কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে সেখানে পুলিশের চেয়ে তাদের ফর্মাদের ভাবসাব ও দাপট বেশি থাকে। হাসেম বলেন, কিছুদিন আগে আমার দোকানের সামনে থেকে এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ। সে সময় পুলিশের সঙ্গে থাকা ফর্মা খলিল ওই মাদক ব্যবসায়ীকে বেধড়ক মারধর করেন।
বনানীজুড়ে পুলিশের ফর্মা আতঙ্ক বিরাজমান। কখন কাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়, কার কাছ থেকে টাকা আদায় করে- এসব নিয়ে মানুষ ভয়ে আছে। বিশেষ করে বস্তির মানুষ। অসাধু পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে যখন-তখন যে কাউকে ফাঁসানো হচ্ছে। বস্তির অনেক নিরপরাধ মানুষকে মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে ঘর দখল করে নিচ্ছে। ফর্মাদের টাকা দিয়ে যে কেউ প্রতিপক্ষকে মিথ্যা মামলায় পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করাচ্ছে। এমন ঘটনাও অহরহ, কিন্তু প্রকাশ্যে আসে না।
বনানীতে বেপরোয়া পুলিশের যত ফর্মাঃ বনানী থানা পুলিশের অন্যতম সোর্স শহীদ ওরফে ফর্মা শহীদ। গোডাউন বস্তি, এরশাদ নগর বস্তি ও কড়াইল বস্তি এলাকার সব গাঁজার স্পট নিয়ন্ত্রণ করেন।অভিযানে উদ্ধারকৃত গাঁজা মাদক কারবারিদের দিয়ে বিক্রির অভিযোগ আছে তার নামে। মাদক নিয়ে কেউ গ্রেফতার হলে ‘সেটেলমেন্ট’ করেন শহীদ। এছাড়া চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকার ফেনসিডিল ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।অনেক সময় আসামি ধরে থানায় না নিয়ে শহীদের ঘরে নিয়ে যায় পুলিশ। মোটা অংকের টাকা দিতে পারলে সেখান থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।এবং অনেক সময় মিথ্যা মামলা সাজানোর জন্য সাক্ষী ম্যানেজ হয় শহীদের ঘর থেকেই। এসব তথ্য দিয়েছেন কয়েকটি সূত্র।
অনুসন্ধান করে জানা যায়, ভ্রাম্যমাণ ইয়াবা ব্যবসায়ী বনানীর ওয়্যারলেছ গেইটে ২০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় সংলগ্ন বুলুর বাড়ির গাড়ি চালক ও পুলিশের ফর্মা কাশেম। তিনি কৌশলে ড্রাইভারের ছদ্দবেশে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে কড়াইল বস্তিসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা করেন।মাঝে মাঝে মাদক সেবীদের ধরিয়ে দিয়ে পুলিশের কাছে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। প্রভাবশালী মালিকের ছত্রছায়ায় থাকার কারনে এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে কাশেম। জানা গেছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে সব মাদক ব্যবসায়ীরা এলাকা ছাড়া হলেও ওয়্যারলেস গেইট এলাকায় বর্তমানে কাশেম একমাত্র মাদক ব্যবসায়ী। খুব কৌশলে পুলিশের সাথে সম্পর্ক রেখে তিনি ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বনানীর বেদে বস্তি এলাকাটিতে অবৈধ পানির ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ফটিক। সে পুলিশের অনেক পুরোনো ফর্মাও। বেদে বস্তিতে জুয়া খেলা ও গাঁজা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। তার আরেক সহযোগী ফর্মা সুমন ওরফে নাডা সুমন এক সময় মহাখালী এলাকার চিহ্নিত চোর ছিল। রাজনীতির সাথেও তারা জড়িত। স্থানীয় যুবলীগের মিটিং মিছিলে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। ফটিক ও সুমনের বিরুদ্ধে বনানী গুলশান থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
মাঈনউদ্দিন ওরফে ভাইগনা বস্তিতে পুলিশের অন্যতম ভয়ঙ্কর সোর্স। তিনি আবার গোয়েন্দা তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মাদক মামলা। তার সাথে রয়েছে ড্রাইভার মহরম। রাস্তায় সাধারণ মানুষকে আটকে তাদের ভয় দেখিয়ে পকেটে ইয়াবা, গাঁজা (চেক করার নামে) গুঁজে দিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগও আছে মাঈনউদ্দিন ও মহরমের বিরুদ্ধে। কিন্তু সোর্স হওয়ায় পুলিশ তাকে কিছু বলে না।
সোর্স পরিচয়ের আড়ালে বনানী এলাকায় ইয়াবা বিক্রি করেন মুন্না। বনানী এলাকার অন্যতম ইয়াবা কারবারি ফর্মা হারুনের সমস্ত চালান বেচাকেনা করেন তিনি। গোডাউন বস্তি ও বেদে বস্তি এলাকায় তার বিচরণ। মুন্না ও হারুন দু’জনেই পুলিশের গাড়ী চালান।
বনানী থানাধীন গোডাউন বস্তির বিতর্কিত পুলিশের ফর্মা হেলাল ওরফে ড্রাইবার হেলাল। গোডাউন বস্তিতে যেকোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডে তিনি প্রধান অংশীদার। বস্তিতে ঘর তুলতে গেলেও চাঁদা দিতে হয় তাকে। এছাড়া নানান রকম অবৈধ বাণিজ্যে তিনি সর্বেসর্বা। বস্তিতে কোথায় কি হচ্ছে সেই খবর তার কাছে পৌঁছে দিতে আবার কয়েকজন লোক রেখেছেন এই হেলাল। বস্তিতে বিচার সালিশের নামে ফিটিং বানিজ্যও করে বেড়ান। সাংবাদিককেও ফিটিং দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বর্তমানে অপরাধের সব সীমা অতিক্রম করে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন তিনি। জানা গেছে,তার অবৈধ আয়ের ভাগ যায় থানার পুলিশের কাছেও। সম্প্রতি অপরাধ বিচিত্রার সাংবাদিক হাবিব সরকার স্বাধীনের কাছ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছে পুলিশের ফর্মা হেলাল। এবিষয়ে বনানী থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন সাংবাদিক স্বাধীন।
স্বাধীন জানান, হেলালের এতোই ক্ষমতা যে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নয়ছয় করছেন পুলিশ। বনানী থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর থেকে অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই হান্নান হোসেন সামনা সামনি আমার সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন কিন্তু অদৃশ্য শক্তির কারনে বাস্তবে হেলালের বিরুদ্ধে এখনো ব্যবস্থা নেয়নি।’
বনানী এলাকার বাসিন্দা সোহরাব হোসেন বলেন, বনানী থানার বর্তমান ওসি শুধু মুখেই বলেন মাদক নির্মূলের কথা। বাস্তবে তার থানারি বেশ কয়েকজন এসআই, এএসআই প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসায়ীদের মদদ দিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বৌদলতে ওসি সাহেবের সাথেও মাঝে মাঝে একাধিক মামলার আসামি মাদক ব্যবসায়ীদের ফুলেল শুভেচ্ছা বিনিময় করতে দেখা যায়।