• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৪ পূর্বাহ্ন

রাজধানীতে দখলদারদের কবলে ফুটপাথ : ফুটপাথজুড়ে রাজনৈতিক কার্যালয়, অবৈধ পার্কিং, ভ্রাম্যমাণ দোকান, নির্মাণসামগ্রী, গর্ত


প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ৪, ২০২১, ১:৩২ অপরাহ্ন / ২২৬
রাজধানীতে দখলদারদের কবলে ফুটপাথ : ফুটপাথজুড়ে রাজনৈতিক কার্যালয়, অবৈধ পার্কিং, ভ্রাম্যমাণ দোকান, নির্মাণসামগ্রী, গর্ত

ঢাকা : মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করে দফায় দফায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও দখলমুক্ত রাখা যায়নি রাজধানীর ফুটপাথ। আবারও হকার, রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যালয়, অবৈধ পার্কিং, নির্মাণসামগ্রীর দখলে চলে গেছে পথচারীদের হাঁটার পথ। বাধ্য হয়ে মূল সড়ক দিয়ে চলতে গিয়ে অহরহই দুর্ঘটনায় পড়ছেন পথচারীরা। বাড়ছে যানজটও।

৩০ নভেম্বর রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদ গেট থেকে হেঁটে পল্টন মোড় যাওয়ার পথে সিএনজি অটোরিকশার ধাক্কায় ছয় বছরের মেয়েকে নিয়ে রাস্তার পাশে নর্দমার পানিতে পড়ে যান মোয়াজ্জেম হোসেন নামে এক যুবক। বড় কোনো ক্ষতি না হলেও হাতে-পায়ে আঘাত পান দুজনই। উঠে অটোরিকশার চালককে মারতে গেলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন- ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় হাঁটছেন কেন? পথচারীরা বিষয়টার মীমাংসা করেন। ব্যস্ততম সড়কটির পাশে চওড়া ফুটপাথ থাকলেও তা পুরোপুরি হকারদের দখলে। ২০১৯ সালে একাধিকবার অভিযানে এ এলাকার ফুটপাথ অবৈধ দখলমুক্ত করা হলেও আবারও চিরচেনা রূপে ফিরেছে পুরো এলাকা। পথচারীরা বলেন, ফুটপাথের দুই পাশেই কাপড়ের দোকান। মাঝখানে হাঁটার জন্য সরু জায়গা। সেখানে সব সময় ক্রেতার ভিড় লেগে থাকে। চলতে গেলে গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগে। ভিড়ে করোনা সংক্রমণের ভয়েও অনেকে ফুটপাথ ছেড়ে মূল রাস্তায় হাঁটেন।

রাজধানীর শুধু বায়তুল মোকাররম বা পল্টন নয়, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, রামপুরা, বাড্ডা, শাহজাদপুর, কুড়িল, নিউমার্কেট, আজিমপুর, নীলক্ষেত, এলিফ্যান্ট রোড, লালবাগ, হাজারীবাগ, মিরপুর, তেজগাঁও, উত্তরাসহ নগরীর অধিকাংশ এলাকার ফুটপাথ ফের দখল হয়ে গেছে। কিছু এলাকায় শুধু ফুটপাথই নয়, মূল রাস্তার দুই পাশেও বসছে ভ্রাম্যমাণ দোকান, যা যানজট বাড়াচ্ছে। এদিকে ফুটপাথ দখলমুক্ত ও সংস্কার করতে প্রতি বছর দুই সিটি করপোরেশন কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। মাঝে মধ্যেই দুই সিটি এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করে। প্রতিটি অভিযানে ন্যূনতম ৫ হাজার থেকে লক্ষাধিক টাকাও খরচ হয়। উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী সংস্থাটি ২০২০-২১ অর্থবছরে রাস্তা, ফুটপাথ ও সারফেস ড্রেন উন্নয়নে ১৯০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। দক্ষিণ সিটি (ডিএসসিসি) ব্যয় করেছে ৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। তবে ফুটপাথ উন্নয়নে এ অর্থ খরচের সুফল পাচ্ছেন না নগরবাসী।

সরেজমিন উত্তর সিটির কুড়িল থেকে বাড্ডা পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশেই ফুটপাথে ভ্যান ও মোটরসাইকেল পার্কিং করা দেখা গেছে। দোকানের মালামাল বের করে রাখা হয়েছে ফুটপাথে। মাদানি এভিনিউর কয়েক স্থানে নির্মাণসামগ্রীতে বন্ধ ফুটপাথ। বাইক সার্ভিসিং থেকে ফার্নিচারের দোকানগুলোর মালামাল প্রদর্শনীও হচ্ছে ফুটপাথে। শাহজাদপুর থেকে মধ্য বাড্ডা পর্যন্ত প্রতিটি শপিং মলের আশপাশে ফুটপাথের পাশাপাশি মূল সড়কেও দোকান সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। গুদারাঘাটের ঝিলপাড়ে ফুটপাথের তিন-চতুর্থাংশ দখল করে তৈরি হয়েছে ২১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যালয়। একাংশ চলে গেছে কাঁচাবাজারের দখলে। ফলে সেখান দিয়ে পথচারী চলাচল একেবারেই বন্ধ।

তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ফুটপাথ ও সড়কের জায়গায় দেখা মিলল ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের ১৫ নম্বর ইউনিট আওয়ামী লীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের দুটি কার্যালয়। বেগুনবাড়ীর ফুটপাথগুলোয় গড়ে উঠেছে মাংস, হাঁস-মুরগি ও সবজির বাজার। এ ছাড়া মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, বাড্ডা, রামপুরার ফুটপাথগুলোর খুবই খারাপ অবস্থা। কোথাও ফুটপাথের পাশে ময়লার ভাগাড় থাকায় চলাফেরা দায়। আবার মালিবাগে ফুটপাথের কিছু স্থান ব্যবহৃত হচ্ছে মূত্রত্যাগে। গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু এভিনিউর গোলাপ শাহ মাজারের আশপাশের ফুটপাথ সবটাই হকারের দখলে। তবে এসব দোকানে কেনাকাটা করা অনেকেই বলেন, এ হকাররাই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের কেনাকাটার মূল ঠিকানা। এদের ফুটপাথ থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও বসার ব্যবস্থা করা উচিত। অন্যদিকে হকাররা বলছেন, নিয়মিত ভাড়া দিয়েই তারা ফুটপাথে দোকান দেন। কিন্তু ফুটপাথের ভাড়া কাকে দেন এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান সবাই।

অভিযোগ রয়েছে ফুটপাথ ও রাস্তা দখল ঘিরে চলে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি। পুরো প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক শক্তি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ ও সিটি করপোরেশনেরও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। এলাকাভেদে প্রতিটি দোকানে দৈনিক ৫০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। এসব দোকানে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েও আসে আলাদা আয়। তাই উচ্ছেদের পর আবার হয় দখল।

এ ব্যাপারে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও ফুটপাথ দখলমুক্ত করার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দুজন মাত্র ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে খাল উদ্ধার, ফুটপাথ দখলমুক্ত করা, ঝুলন্ত তার কাটা সব কাজ পর্যায়ক্রমে করতে হয়। তাই নিয়মিত সড়কে অভিযান চালানো যায় না। বর্তমানে ঝুলন্ত তার কাটার কাজটা প্রতিদিন চলছে।

ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক বলেন, অভিযান অব্যাহত আছে। কিন্তু আজ ফুটপাথ থেকে উচ্ছেদ করলে কাল আবার বসছে। এজন্য মেয়র মহোদয় এমন একটা সমাধানের কথা ভাবছেন যাতে হকাররাও ক্ষতিগ্রস্ত না হন পথচারীদেরও সমস্যা না হয়। তবে নীতিমালায় হাঁটা ছাড়া ফুটপাথ অন্য কাজে ব্যবহারের সুযোগ নেই। তাই বিষয়টা নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করছেন।

এদিকে বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল ও হকাররা হাঁটার পথগুলো দখল করে রাখছে। হকারদের একদিকে ওঠালে তারা অন্য জায়গায় বসছে। এজন্য তাদের একটি জায়গা দিতে হবে যেখানে তারা উপার্জন করতে পারে। আগামী বছর থেকে আমরা এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখব। বিশেষজ্ঞ মহল ও হকার প্রতিনিধিদের নিয়ে আলাপ করব।