• ঢাকা
  • রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:৫৬ পূর্বাহ্ন

যশোরের ভাই ভাই সিন্ডিকেটে সিআইডির তদন্ত অভিযান


প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারী ৬, ২০২৪, ৯:০৩ অপরাহ্ন / ১২৬
যশোরের ভাই ভাই সিন্ডিকেটে সিআইডির তদন্ত অভিযান

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোরঃ যশোরের বেনাপোল সীমান্তের স্বর্ণ চোরাচালানকারী ভাই ভাই সিন্ডিকেটের লাগাম টানতে শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। শেষ পর্যন্ত এরই মধ্যে তদন্ত থাবা বসিয়েছে তাদের জমি, বাড়ি-গাড়ি এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা কোটি কোটি টাকায়। এসব সম্পত্তি আর ব্যাংকের টাকা যাতে হস্তান্তর বা পাচার করতে না পারে সে জন্য যশোরের আদালত থেকে তা জব্দ (ক্রোক) করা হয়েছে। অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা হয়েছে ৪৬টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। সোমবার ঢাকার সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম স্কোয়াডের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যশোরের আদালত ওই সিন্ডিকেটের স্থাবর সম্পত্তি ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে তত্ত্বাবধায়ক (রিসিভার) নিয়োগ দিয়েছেন।

গত বছরের ২৩ জুন একটি গণমাধ্যমে স্বর্ণ পাচারে সীমান্তে ভাই ভাই সিন্ডিকেট শিরোনামে স্বর্ণ চোরাচালানের ওই চক্রটি নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এরপরই নড়ে চড়ে বসেন সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম স্কোয়াডের সদস্যরা।

স্বর্ণ পাচারে ভাই ভাই সিন্ডিকেটে যশোরের শার্শা উপজেলার পুটখালী এলাকার দুই ভাই নাসিরুদ্দিন ও ওলিয়ার রহমান। একই এলাকার রমজান আলী ও সেলিম হোসেন এবং কুমিল্লার দাউদকান্দির নলচক এলাকার রেজাউল করিম ও রুহুল আমিন রয়েছে বলে জানা গেছে। তিন পরিবারের ওই ছয় ভাই ছাড়াও সিআইডি নাসিরুদ্দিনের স্ত্রী বিলকিস খাতুন এবং শার্শার নাজমুল হোসেন ও দাউদকান্দির আনিসুর রহমানকে সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের সম্পদও জব্দ করা হয়েছে।

সিআইডি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই গ্রুপটি আন্তর্জাতিক সোনা পাচারকারী চক্রের সদস্য। তারা দুবাই থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিমানবন্দর ব্যবহার করে অবৈধপথে সোনা চোরাচালান করে থাকে। পরে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী দেশে তা পাচার করে দেয়। চোরাচালানের অন্ধকার জগতে এরা ভাই ভাই সিন্ডিকেট নামে পরিচিত।

ভাই ভাই সিন্ডিকেটের যেসব স্থাবর সম্পত্তি জব্দঃ  সিআইডি সূত্র জানায়, চোরাচালান চক্রের সদস্য নাসিরুদ্দিনের শার্শার পুটখালী ১১০ নং মৌজায় ১ শতাংশ, ভিন্ন খতিয়ান ও দাগে একই মোজায় ৬ শতাংশ, ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ, ২০১৬ সালের দলিল নং-৭৮১১/১৬ তে ২৮ শতাংশ, ৭৮১২/১৬ নং দলিলে ৪৮ শতাংশ, ৪৮ নং বেনাপোল মৌজায় ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ, পুটখালী মৌজায় ৩৩ শতাংশ, বাগআঁচড়া মৌজায় ১০৬ শতাংশ এবং ভবারবেড় মৌজায় ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ, তার স্ত্রীর নামে ঝিকোরগাছা উপজেলার ৬৭ নং কীর্তিপুর মৌজায় ১৬ শতাংশ এবং শার্শার পুটখালী মৌজায় ৯ শতাংশ জমির সন্ধান মিলেছে। নাসিরুদ্দিনের ভাই ওলিয়ারের শার্শা উপজেলার ছোট আঁচড়া মৌজার জমি, যশোর সদরে রমজানের পাঁচতলা ভবন, সদর থানার বারান্দী ৯১ নং মৌজায় ৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ জমি, ৭৭ নং চাঁচড়া মৌজায় ৪ শতাংশ জমি, সদরে আরও একটি পাঁচতলা ভবন, বিরামপুর ১০৩ নং মৌজায় ৬ দশমিক ৩ শতাংশ জমি, গাজীপুরের কালিগঞ্জে প্লট এবং টয়োটা প্রাইভেটকার (ঢাকা মেট্রো-গ-৪৩-৯৪৫৩) এবং তার ভাই সেলিমের সদর থানার ৯১ নং বারান্দী মৌজায় ৪ দশমিক ৫ শতাংশ জমি, ১০৩ বিরামপুর মৌজায় ১০ দশমিক ৬২ শতাংশ জমি এবং টয়োটা ব্র্যান্ডের একটি প্রাইভেটকার (ঢাকা মেট্রো-গ-৩৩-৯০৬০) জব্দ করা হয়।

এ ছাড়া রেজাউল করিমের দাউদকান্দি পূর্ব হাসানপুর মৌজায় ২ দশমিক ৫০ শতাংশ জমি, একই মৌজায় ভিন্ন দাগ ও খতিয়ানে ৫ শতাংশ জমি এবং তার ভাই রুহুল আমিনের একটি প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়। অন্যদিকে তাদের সহযোগী নাজমুল ও আনিসুরের একটি করে প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়। এদিকে ওই ৯ জনের নিজের নামে ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ৪৬টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়।

সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম স্কোয়াডের পরিদর্শক মো: মনিরুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের ওই সদস্যদের বিরুদ্ধে একটি মানিলন্ডারিং মামলা তদন্ত করতে গিয়ে তাদের এসব অবৈধ সম্পদের সন্ধান মেলে। এরপর এসব সম্পদ জব্দ করার জন্য আদালতে আবেদন করা হয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তা জব্দ করে রিসিভার নিয়োগ দিয়েছেন। আসামিরা চোরাচালানের মাধ্যমে অর্জিত এসব সম্পত্তি এখন আর ভোগ বা স্থানান্তর করতে পারবে না।

সিআইডির ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, চক্রটির শত শত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে তথ্য রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এসব সম্পদের হদিস মিলেছে। সামনে আরও তথ্য পেলে সেগুলোও জব্দ করার আবেদন করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বর্ণ চোরাচালানে ভাই ভাই সিন্ডিকেটের সদস্যরা নিজ নিজ এলাকায় ভালো মানুষ আর দানবীর হিসেবে পরিচিত। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খাতায় তারা চোরাচালান চক্রের সিন্ডিকেটের হোতা। এরা চোরাই স্বর্ণের বাহক নয় মালিক।

সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা দুবাই থেকে স্বর্ণ পাচার করে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে আসে। সেখান থেকে বেনাপোল সীমান্তে নিয়ে যায়। সীমান্ত পার করে ভারতে গৌতম নামে একজনের হাতে তা তুলে দেয়। পুরো সিন্ডিকেটের আড়ালে থাকে ওই ছয় ভাই। দীর্ঘ অনুসন্ধান করে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট ওই চক্রটির সন্ধান পায়। এরপর গত বছরের জুনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার প্রস্তুতি নিলে ওই সিন্ডিকেটকে রক্ষায় নানা স্তর থেকে তদবির শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সিআইডি প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়ার নির্দেশে গত বছরের ১৫ জুন যশোরের কোতোয়ালি থানায় ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের পক্ষ থেকে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হয়েছিল।

সিআইডির মামলায় বলা হয়েছিল, দুই ভাই রুহুল আমিন ও রেজাউল করিম মূলত দুবাই থেকে স্বর্ণ পাচার করে দেশে আনে। এরপর তারা বেনাপোলে সিন্ডিকেটের সদস্য অন্য দুই ভাই ওলিয়ার রহমান ও নাসিরুদ্দিন এবং রমজান আলীর কাছে পৌঁছে দেয়। ওই তিনজন মূলত বেনাপোল সীমান্তে গরু ব্যবসার নামে খাটাল স্থাপন করেছে। ওই খাটালের আড়ালে এরা বেনাপোল স্থলবন্দর ও পোর্ট বাগান দিয়ে স্বর্ণ পাচার করে থাকে। চক্রটি শুধু স্বর্ণ চোরচালানকারীই নয়, এরা দেশে অবৈধ ডলার বাণিজ্যের সঙ্গেও যুক্ত।