• ঢাকা
  • বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫, ০১:২৭ পূর্বাহ্ন

মব জাস্টিস কি স্বাধীনতা?


প্রকাশের সময় : অক্টোবর ৩০, ২০২৪, ৬:১৯ অপরাহ্ন / ৪৯
মব জাস্টিস কি স্বাধীনতা?

নজরুল ইসলাম সিকদারঃ গত ৫ আগস্ট ২০২৪ইং সোমবার। চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় জ্বলছে আগুন। হাজার হাজার জনতা ঠাঁই দাঁড়িয়ে দেখছে। কারো কিছুই বলার নেই করার নেই। হাজারো জনতা আর আগুনের ধোঁয়ায় পুরো এলাকায় এক ধরণের ভূতরে পরিবেশ। চারিদিকে ধ্বংস ভাঙ্গচুর আর আগুনের চিহ্ন। এটা শুধু চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানা নয় সারা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি থানার একই দৃশ্য। হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি লুটে নেওয়া হয় যানবাহন, অস্ত্র-গোলাবারুদসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। পুরো দুই মাস পোড়া জিনিসের ধ্বংসবাশেষ পড়েছিল থানার সামনে। কেউ প্রবেশ করতে পারেনি থানায়। পরে ভবন সংস্কার করে থানার কার্যক্রম শুরু করা হলেও এখনও পরিবহন, লোকবল ও অন্যান্য সরংঞ্জাম সংকট রয়ে গেছে। হামলার কারণে মানসিক আঘাত এবং ফের একই ধরনের আচমকা আক্রমণের আতঙ্ক রয়ে গেছে পুলিশ সদস্যদের মনে।

সরকার পতনের পর তড়িগড়ি করে থানার ওসিসহ বেশিরভাগ পুলিশ সদস্যদের বদলি করা হয়েছে, দেওয়া হয়েছে নতুন মুখ। যাতে কোন ডকুমেন্ট উদ্ধার করা না যায়। পুলিশের দাবি, বিগত সময়ে পুলিশ সদস্যদের দলীয়ভাবে ব্যবহার করায় জনগণের রোষানলে পড়েছিল পুলিশ বাহিনী। তাই সরকার পতনের পর পুলিশকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে।ইংরেজীতে একটা শব্দ প্রচলিত আছে ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে অথচ কেউ জানে না। এটিই রাজনীতি। আসলে সমাজের মোট জনসংখ্যার কতজন মানুষ রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত আছে? দেখবেন হাতেগোনা কয়েক জন। এই কয়েকজন মানুষ বাংলাদেশের পুলিশকে হাতে নিয়ে কি এলাকার সকল মানুষকে অত্যচার নির্যাতন চালিয়ে ছিল ?

একজন মানুষকে পুলিশ পোশাকে যখন রাস্তায় দেখবেন তখন সাধারণ মানুষের সাহস ও আস্থা থাকে আমাকে কোন বখাটে চোর কিংবা ডাকাত আপাতত আক্রমণ কিংবা ক্ষতি করতে পারবে না। এই টুকু মানসিকতা সাধারণ মানুষের মনে জেগে যায়। যে পোশাকটি দেখলে মানুষের আস্থা ফিরে আসে সেই পোশাকটিকে কারাই ঘৃণা করে বা করবে? এটা বিবেকের প্রশ্ন। মাঝরাতে বিপদের সময় কাউকে না পেলেও ৯৯৯ ফোন করলে অনন্ত পক্ষে একজন পুলিশ এসে বন্ধু হিসেবে আপনার পাশে দাঁড়িয়েছে। পুলিশের উপস্থিতিতে হারিয়ে গেছে অন্যায়কারী। তাহলে মনের মাঝে প্রশ্ন কি জাগে না, কারা পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের শৃঙ্খলাকে ভেঙ্গে দিতে পারে?

সাধারণ মানুষ কি থানায় হামলা করেছে? উত্তরে আসবে না। তাহলে কারাই থানায় হামলা করলো ? দুষ্টের দমন আর সৃষ্টের রক্ষায় হলো রাষ্ট্রীয় ধর্ম। এই রাষ্ট্রীয় ধর্ম পালন করতে গিয়ে যদি পুলিশ কাউকে আটক করে তাহলে কি বাংলাদেশের সকল পুলিশ অপরাধী?

ঠিক আছে আওয়ামী লীগ সরকরের খারাপ পুলিশ প্রশাসন। সেই চিত্র ৫ আগস্ট ২০২৪ইং এর আগ পর্যন্ত দেখেছি। এবার আসেন ৫ আগস্টের পর থেকে আমরা কি দেখলাম? জামাতিরা মনে করছে আমরা সরকার। বিএনপিরা মনে করছে আমরা সরকার। প্রতিদিন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় বিএনপির নেতা কর্মীদের নানা ধরণের লুঠতরাজের চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। জামাতিদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার চিত্র সোসাল মিডিয়াতে প্রতিনিয়ত ভাইরাল হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পনের বছরে যা করেনি। বিএনপি জামাত তিন পনের পঁয়তাল্লিশ দিনে তার তিনগুণ করে ফেলেছে বলে সাধারণ মানুষের অভিমত।

কয়েকগুটি মানুষের দৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ স্বৈরচার ফ্যাসিস্ট। কিন্ত এখন যা হচ্ছে তা কি স্বৈরচার বা ফ্যাসিস্ট নয় ?? আমরা আজীবন শুনেছি বাংলাদেশে সংখ্যালগু নির্যাতন কিন্তু ৫ আগস্টের পর দেখতেছি স্বৈরচারকে হটিয়ে দেওয়া সেই স্বাধীনতাকামীদের দ্বারা মুসলিম নির্যাতন। সংখ্যালগু নির্যাতন সকল রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সারাবিশ্ব সোচ্চার। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম যখন নির্যাতিত হয় তখন কাউকে মায়াকান্না করতে দেখা যায় না। মন্দিরে হামলা আর অগ্নিসংযোগ করছেন ইসলাম কায়েম করতে। মাজারে হামলা মসজিদ দখল ভাঙ্গচুর অগ্নি সংযোগ এতে কি কায়েম করলেন? এটাকি স্বৈরচার বা ফ্যাসিস্ট বা মব জাস্টিস নয়?

বিবেকবান মানুষ সবার অগোছরে বলাবলি করছে। পুলিশের উপর হামলা করে আগেই সর্তক করে দিয়েছেন। সাবধান আপনারা এগিয়ে আসবেন না। আমরা মন্দির মসজিদ ও মাজারে হামলা করবো। এটাই স্বৈরচারের তিনগুণ উপরে মব জাস্টিস। তাহলে নব্য স্বাধীনতার নামে মব জাস্টিস প্রতিষ্ঠাই একমাত্র লক্ষ্য ?

মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জাতিসংঘ থেকে শুরু করে সবাই শেখ হাসিনা সরকারের উপর দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন ধরণের মামলায় জড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এটার সুফলতো ভালো নয়। ৫ আগস্টের পর সরকারবিহীন। তারপর ড.ইউনূস সরকার। তাহলে ড.ইউনূস সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর যে হত্যাগুলো হচ্ছে বা হয়েছে এটাকি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়? এই গুলোর দায়ভার কে নিবে?

আন্দোলনে ছাত্র মারা গেছে তারা শহীদ হয়েছেন। সরকারী আদেশ মানতে গিয়ে যে সকল পুলিশকে হত্যা করা তারা কি? ছাত্র মারা গেছেন থানায় মামলা হয়েছে। বড় বড় আমলা মন্ত্রীরা আসামী হয়ে কারাগারে। সে সকল সম্মানিত পুলিশ সদস্যদের হত্যা করলো তাদের বিরুদ্ধে একটাও মামলা হয়নি। একজনও গ্রেফতার হয়নি। এটাকি স্বৈরচার নয়? নয় কি মব জাস্টিস?

পুলিশ ১৫ বছর আওয়ামী লীগের সাথে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। জামাততো এখানো সরকারের চেয়ারে বসেননি। চেয়ারে না বসতেই জোর করে মন্দির কোরআন তেলায়াত, ইসলামী সংগীত, হিন্দুদের দুর্গাপুজায় গীতাপাঠ এগুলোকি ক্ষমতার অপব্যহার নয়? ভাতের চাউল সবগুলো টিপটে হয়না। একটা টিপলেই বুঝা যায়। এখনো নির্বাচন হয়নি। ক্ষমতায় বসেনি। এই অবস্থা? ক্ষমতায় বসলে কি করবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জানার বাকি নেই।

এই অপকর্ম গুলো বিগত পনের বছর আওয়ামী লীগ সরকার করতে দেয়নি। জোর করে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে দেয়নি পুলিশ প্রশাসন। তাই থানায় আগুন দিয়ে পুলিশ হত্যা করে পুলিশের ভেতর একটা ভয়ের সংস্কৃতি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলেই দুস্কৃতিকারীরা তাদের ইচ্ছামতো যখন যাই তাই করতে পারবে। মতের অমিল হলে বা মতের বিরুদ্ধে গেলেই তার উপর মব জাস্টিস শুরু করে দিবে। সমাজে এখন এটাই হচ্ছে। কেউ দেখতেছে না। কারণ এখন সব ওপেন সিক্রেট।

নিত্যদিন সমাজের মানুষের নানা ধরণের সমস্যা হয়েই থাকে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছে গিয়ে তেমন সহযোগীতা পাচ্ছে না। পুলিশের সহযোগীতা না পাওয়ার কারণে সমাজে রাষ্ট্রে একটা অরাজক পরিস্থিতি। পুলিশ গেলে অপরাধীরা অন্যায়কারীরা অন্যায় করতে পারেনা। তখন তাদের কাছে পুলিশ হয়ে গেছে ফ্যাসিবাদ !

এই ফ্যাসিবাদ কি আসলে কোন দিন বিলুপ্ত হবে? যে ফ্যাসিবাদের তকমা দিয়ে আওয়ামী লীগকে তাড়িয়ে দিলেন। এখন যা হচ্ছে তা কি ফ্যাসিবাদ নয় বলে মনে করেন? আগে পুলিশ পরিচালনা করতে আওয়ামী লীগ এখন নাকি পুলিশ পরিচালনা করে জামাত। এই কথাটি এখন সমাজের সকলেরই জানা। সবাই জানি কিন্তু কেউ জানেনা। ঐ যে ওপেন সিক্রেট।

শুধু পুলিশ হত্যা নয়। ৫ আগস্ট ২০২৪। এই ২০২৪ পরিস্কার করে দিয়েছে। স্বাধীনতার মূল্যবোধ। ১৯৭১ থেকে ২০২৪ তেপান্ন বছর। এতো বছর পর মুখোশ খুলে দিয়েছে বাংলাদেশে কতজন রাজকার আর কতজন মুক্তিযোদ্ধা? কে এই ভূখন্ডের কে এই ভূখন্ডের দালাল!

যে সরকার আসুক না কেন পুলিশ লাগবেই। পুলিশ ছাড়া রাষ্ট্রের উন্নয়ন কখনো কিছুতেই সম্ভবপর নয়। রাজনীতিবিদেরা যদি গণতন্ত্র, খেলাফতি থেকে শুরু করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাই তাহলে পুলিশকে পুরোপুরি স্বাধীন করে দিন। পুলিশ কারো কথা শুনবে না। পুলিশ শুধু ন্যায় এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে। যে পুলিশ অন্যায় করবে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিবে রাষ্ট্র।

জাতিসংঘের ঘোষণা বাংলাদেশে মানবাধিকার অফিস প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটা খুশির খবর। এই মানবাধিকার অফিস থেকে কি সরকারী ডিউটি পালন করতে গিয়ে যে সকল পুলিশকে হত্যা করা হয়েছে তাদের জন্য কিছু করা হবে? মানবাধিকারের দেশ আমেরিকা। সেই আমেরিকার ঘনিষ্ট বন্ধু ড. ইউনূস। ড. ইউনূস সরকার কি সুষ্ঠ তদন্ত করে পুলিশ হত্যার বিরুদ্ধে আইনানুগ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে? আমরা পুলিশ হত্যা সুষ্ঠ বিচার কামনা করি। নাকি যে লাউ সেই কদু ! ১৯৭১ হটিয়ে ২০২৪ এলো। তাহলে মব জাস্টিস কি স্বাধীনতা?

(লেখক: সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী)