নিজস্ব প্রতিবেদক, বাগেরহাট: রবার্ট মোরেলের নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের কুঠিবাড়ির অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। অযত্ন-অবহেলা আর সংস্কারের অভাবে ১৪২ বছরের ঐতিহ্য ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এখনো এ স্থাপনা সংরক্ষণ করা না হলে ইংরেজ শাসনামলের কালের সাক্ষী অত্যাচারী মোরেলের শেষ স্মৃতিচিহ্ন কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। প্রতিনিয়ত ভবনের মালামাল চুরি হয়ে যাচ্ছে। বেদখল হয়ে গেছে অনেক জমি। ১৮৪৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিনিধি মি. মোরেলের মৃত্যু হলে স্ত্রী মিসেস মোরেল তার দুই ছেলে রবার্ট মোরেল ও হেনরি মোরেলকে নিয়ে বসতি স্থাপন করেন পানগুছি নদীর পশ্চিমপাড়ে। সুন্দরবন বন্দোবস্ত নিয়ে শুরু করেন নীল চাষ। বাগেরহাট তখন মহকুমা হয়নি। খুলনা জেলাও ছিল যশোর জেলার অন্তর্গত। আর এর বড় অংশ জুড়ে ছিল সুন্দরবন। মিসেস মোরেল বরিশাল থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করে বন আবাদ করে গড়ে তোলেন বিশাল আবাসস্থল ‘কুঠিবাড়ি’। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবকে দমন করে ইংরেজ শাসকরা এদেশে তাদের শাসন দৃঢ় করার লক্ষ্যে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তার মধ্যে এই কুঠিভিত্তিক শাসনব্যবস্থা ছিল অন্যতম। এরই অংশ হিসেবে এখানে গড়ে তোলা হয় সুরম্য অট্টালিকা কুঠিবাড়ি।
এ কুঠিবাড়ির তলদেশে নির্মিত হয় অশ্বশালা। গোপন সুড়ঙ্গসিঁড়ি দিয়ে সরাসরি নামা যেত অশ্বশালায়। এ ছাড়াও কুঠিবাড়ির অভ্যন্তরে আনন্দ কক্ষ বা নাচঘর, গুদামঘর, নির্যাতন কক্ষ ও লাঠিয়াল বাহিনীর জন্য পৃথক কক্ষ ছিল। মূল এই ভবনটির পাশে ছিল কাচারিঘর, অবাধ্য শ্রমিকদের বেঁধে রাখার ঘর ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত মালামাল রাখার ঘর। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বন্যপ্রাণীর হাত থেকে রক্ষা পেতে কুঠিবাড়ির চারদিকে উঁচু প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। ঐ সময় মূল শাসকের দায়িত্ব পালন করেন রবার্ট মোরেল। তার নাম লেখা হতো ‘দ্বিতীয় এডমন্টন রয়েল মিডেলসেক্স মিলিশিয়া রাইফল পল্টনের কাপ্তান রবার্ট মোরেল।
১৮৬৮ সালের ১৩ মে বরিশালেই রবার্ট মোরেল মৃত্যুবরণ করেন। এরপরে আর বেশিদিন টেকেনি মোরেল পরিবারের শাসন। মোরেলগঞ্জ থেকে ১৮৭৮ সালে শাসন গুটাতে হয় তাদের। তবে কালের সাক্ষী হয়ে এখনো রয়ে গেছে ‘কুঠিবাড়ি’ নামে পরিচিত মোরেলদের নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ। মোরেল পরিবারের বিদায়ের শেষ দিকে মোরেলের ভক্ত ও অনুসারীরা কুঠিবাড়ির অদূরে নির্মাণ করেন মোরেলের স্মৃতিস্তম্ভ। স্তম্ভটি এখনো আছে।
জানা গেছে, মোরেলগঞ্জ পৌরসভায় অবস্থিত মোরেলদের এই ‘কুঠিবাড়ি’ ভবনের পুরোনো আমলের সেই দরজা, জানালা, গ্রিল, সিন্দুক, সিঁড়িসহ বহু মূল্যবান মালামাল ধীরে ধীরে বেহাত হয়ে গেছে। স্মৃতিস্তম্ভ থেকেও চুরি হয়ে গেছে অনেক মালামাল। প্রায় দেড়শ বছর ধরেই পুরোনো ও ঐতিহাসিক এই ভবনটি পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। দীর্ঘ এই সময়ে ভবন বা এর মালামাল রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেউই কোনো দায়িত্ব নেয়নি, উদ্যোগও গ্রহণ করেনি।
ঐতিহ্যবাহী এই কুঠিবাড়িকে নিয়ে গবেষক প্রাক্তন অধ্যক্ষ ম্যাটস্ বাগেরহাট ডা. মো. শিব্বির আহেমদ বলেন, কুঠিবাড়ি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। এটি আজ ধংসের দ্বারপ্রান্তে। ইতিপূর্বে অনেক জমি অবৈধ দখলদারের হাতে চলে গেছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণ করে দেখভালের জন্য দায়িত্ব গ্রহণের দাবি জানান তিনি। পাশাপাশি কুঠিবাড়ির এ জমিতে শিশু পার্ক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে শিশুদের বিনোদনের চাহিদা লাঘব হবে। আয়ের উত্স্য থেকে সরকারিভাবে রাজস্বও আসবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কুঠিবাড়িটি সংরক্ষণের জন্য ইতিমধ্যে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারিভাবে বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :