নিজস্ব প্রতিবেদক: পছন্দের পদে পোস্টিং এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য কর্মকর্তাদের ডিও লেটার নেওয়া অব্যাহত রয়েছে। কেউ চাইছেন পদোন্নতি। বিষয়টি সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা অনুযায়ী অসদাচরণ হলেও কেউ তা মানছেন না। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরাও এ ধরনের ডিও লেটার দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি কেউ কেউ কর্মকর্তাদের প্রশংসা করতে গিয়ে তাদের দলীয় আদর্শের কর্মকর্তা বলে অভিহিত করতেও দ্বিধা করছেন না।এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও নিশ্চুপ। মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা আইন ও বিধির স্পষ্ট লঙ্ঘন হলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বরং জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিব বরাবর লেখা এ ধরনের আধাসরকারি পত্র গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেওয়া হচ্ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিশ্চুপ, এমন অভিযোগ মানতে নারাজ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। বিদেশে অবস্থানরত প্রতিমন্ত্রী রোববার বিকালে বলেন, দেখুন আমাদের কাছে ডিও এলেও আমরা পোস্টিং দেওয়ার সময় সব দিক বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। এছাড়া ভবিষ্যতে এমন পদ্ধতি চালু হতে যাচ্ছে যখন এসব ডিওতে আর কোনো কাজ হবে না। সফটওয়্যারের মাধ্যমে যোগ্যতার বিপরীতে কর্মকর্তার তালিকা সংগ্রহ করা হবে। এর ভিত্তিতে যাকে যেখানে পদায়ন করা দরকার তিনি সেখানে নিয়োগ পাবেন।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বুধবার বলেন, এটি সরকারি কর্মচারী আইন ও বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তিনি মনে করেন, যেসব কর্মকর্তা এ ধরনের ডিও লেটার নিয়ে আসবেন বা যাদের বিষয়ে ডিও লেটার দেওয়া হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কেননা এই ধরনের ডিও লেটার দেওয়া বা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকেন। তিনি মনে করেন, কেউ প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও বাস্তবে সেটিই ঘটছে।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক ২২ সেপ্টেম্বর ডিও লেটার দেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীকে। এতে তিনি মো. শহীদ আতাহার হোসেনকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করেন। এই কর্মকর্তা বর্তমানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সুরক্ষা সেবা বিভাগে ১১টি মডার্ন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক হিসাবে কর্মরত আছেন।
পিআরএল বা অবসরোত্তর ছুটি বাতিল করে একজন অতিরিক্ত সচিবকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার জন্য আধাসরকারিপত্র দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। কর্মকর্তার নাম মো. মনছুরুল আলম। তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রপ্তানি উন্নয়নসংশ্লিষ্ট একটি প্রকল্পের পরিচালক পদে কর্মরত। গত ২০ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে লেখা ডিও লেটারে মনছুরুল আলমকে খুবই সৎ, যোগ্য কর্মকর্তা উল্লেখ করে বলা হয়, আগামী ৯ অক্টোবর তিনি অবসরে যাবেন। তাই তাকে প্রকল্পটির বাকি মেয়াদের জন্য চুক্তিভিত্তিক দেওয়া প্রয়োজন। ঢাকা মহানগরী ও পূর্বাচলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ দৃষ্টিনন্দনকরণ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক যুগ্মসচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক পদে পদায়ন করার জন্য বলা হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন ১১ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর একটি আধা সরকারিপত্র দেন। এতে তিনি এক স্থানে উল্লেখ করেন, মিজানুর রহমান বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী একজন কর্মকর্ত। ইতোমধ্যে তিনি তার দাপ্তরিক কাজে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
গত ১২ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে ডিও দিয়েছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। সেখানে তিনি শিক্ষা ক্যাডারের সহযোগী অধ্যাপক গাজী মিজানুর রহমানকে বাংলাদেশ হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক পদে পদায়নের জন্য সুপারিশ করেছেন। আধাসরকারিপত্রে আরও বলা হয়, সম্প্রতি তিনি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে ইনসিটু আছেন। তিনি একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা। গাজী মিজানুর রহমান বর্তমানে প্রেষণে হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক পদে কর্মরত আছেন। শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার ১৯ সেপ্টেম্বর আধাসরকারিপত্র দেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে। সেখানে তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. নুরুল আলমকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কর্মকর্তা বলে অভিহিত করেন। বলা হয়, ২৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)-এর মহাপরিচালক পদটি শূন্য হবে। এই পদে অতিরিক্ত সচিব নুরুল আলমকে পোস্টিং দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে ডিও লেটার দেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্য এবং কুড়িগ্রাম-২ আসনের সংসদ-সদস্য পনির উদ্দিন আহমেদ। চিঠিতে তিনি একজন কর্মকর্তাকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য জোর সুপারিশ করেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নাম মো. সুজাউল ইসলাম। তিনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির একান্ত সচিব।
এদিকে এ ধরনের আধাসরকারিপত্র কিংবা ডিও লেটারের বিষয়ে সরকারি কর্মচারী আইন বইয়ের লেখক সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, আইন অনুযায়ী এ ধরনের ডিও এনে কোনো কর্মকর্তা জমা দিতে পারবেন না। কিন্তু সুচতুর কর্মকর্তারা এখানে আইনের একটি ফাঁক ব্যবহার করছেন। তারা নিজেরা ডিও এনে জমা না দিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন। তবে যেভাবে হোক না কেন, বিষয়টি অনৈতিক। এই ডিও কালচার দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। এতে যোগ্য কর্মকর্তারা পিছিয়ে পড়ছেন। বিপরীতে দলবাজ ও সুবিধাবাদী কর্মকর্তাদের বারো মাস পোয়াবারো। তাই সত্যিকারার্থে প্রশাসনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে চাইলে এটি বন্ধ হতে হবে।