বিশেষ প্রতিবেদকঃ প্রাথমিক স্কুল, ঔষধ কোম্পানিসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চাকরি দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে অর্ধ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। ৩৩তম বিসিএসের এ কর্মকর্তা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিকল্পনা বিভাগে কর্মরত। তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা চলমান থাকায় গত ৮ জানুয়ারি থেকে তিনি কর্মস্থলে অনুপস্থিত। কয়েক দফায় চিঠি এবং কারণ দর্শানো নোটিশ দিলেও উত্তর মেলেনি। এখন ওই শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রক্রিয়া শুরু করেছে মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, রফিকুল ইসলাম মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণা শাখায় কর্মরত। এর আগেও একাধিক প্রতারণার অভিযোগে তাকে মাউশি অধিদপ্তর থেকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়। তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি চেক ডিজঅনার সংক্রান্ত মামলার রায় চলতি মাসে হওয়ার কথা রয়েছে। অন্য একটি মামলার তদন্ত করছে পুলিশের তেজগাঁও গোয়েন্দা বিভাগ। প্রতারণার আরেকটি মামলা হয়েছে সিএমএম কোর্টে। এদিকে, বেশ কয়েক মাস ধরে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝেমধ্যে মোবাইল ফোন খোলা থাকলেও কল রিসিভ করেন না। না পেয়ে মাউশিতে এসে অনেকে তার খোঁজ করছেন, কিন্তু সহকর্মীরা তার কোনো সন্ধান দিতে পারছেন না।
রফিকুল ইসলাম মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিকল্পনা বিভাগের গবেষণা শাখায় কর্মরত। এর আগেও একাধিক প্রতারণার অভিযোগে তাকে মাউশি অধিদপ্তর থেকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়। তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি চেক ডিজঅনার সংক্রান্ত মামলার রায় চলতি মাসে হওয়ার কথা রয়েছে। অন্য একটি মামলার তদন্ত করছে পুলিশের তেজগাঁও গোয়েন্দা বিভাগ। প্রতারণার আরেকটি মামলা হয়েছে সিএমএম কোর্টে টানা পাঁচ মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার পর গত ১০ এপ্রিল মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি দিয়েছেন মাউশি মহাপরিচালক। ৮ জানুয়ারি থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার কারণ ব্যাখ্যা চেয়ে শোকজ দেওয়া হলেও সেই জবাব পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে তার ব্যক্তিগত ই-মেইল ও ঠিকানায় চিঠি দেওয়া হলেও কোনো জবাব মেলেনি। এখন তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, তিনি টানা চার মাস ধরে অফিসে অনুপস্থিত। শোকজ করার পরও তিনি জবাব দেননি। তাই পুরো বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার নেওয়ার এখতিয়ার মন্ত্রণালয়ের। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লোকজনের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়েছেন এমনটা শুনেছি। কিন্তু কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি।
রফিকুল ইসলাম সম্পর্কে যা জানা যায়ঃ অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন রফিকুল ইসলাম একটি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। ওই সময় থেকে তিনি নানা প্রতারণার জাল বিস্তার করেন। ৩৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দেন। এরপর সরকারের ঊর্ধ্বতন বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে— এমন ছবি দেখিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া শুরু করেন। এমন তিন ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছেন এ প্রতিবেদক। তাদের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা নিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। বাকিরা তার খোঁজে মাউশি, মোহাম্মদপুর ও নিজ জেলা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার কুশিল গ্রামে ধরনা দিচ্ছেন। তিনি টানা চার মাস ধরে অফিসে অনুপস্থিত। শোকজ করার পরও তিনি জবাব দেননি। তাই পুরো বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার নেওয়ার এখতিয়ার মন্ত্রণালয়ের
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ মাউশি সূত্রে জানা যায়, এর আগে চাকরি দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নেওয়া শুরু করেন রফিকুল ইসলাম। কিন্তু কাউকে চাকরি দিতে না পারায় মাউশিতে আসতে শুরু করেন ভুক্তভোগীরা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কয়েক দফা এসব বিষয়ে আপস-মীমাংসাও করে দেন। ২০১৮ সাল থেকে তিনি ফের প্রতারণা শুরু করেন।
অনুসন্ধান করলে ভুক্তভোগীদের তিনি নানা ভাবে হুমকি-ধামকি দিতে শুরু করেন। ওই সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বললে টাকা তো দেবই না, উল্টো তোমাকে গুম করে ফেলব— এমনও হুমকি দেন।’ ভয়ে প্রথম দিকে অনেকে তার বিরুদ্ধে কথা বললেও পরে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা।
তার বিরুদ্ধে যত অভিযোগঃ পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার রতন চন্দ্র একটি বেসরকারি ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সরকারি প্রাথমিক স্কুলে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ২০১৯ ও ২০২০ সালে তিন ধাপে তার কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা নেন রফিকুল। পরে চাকরি না হওয়ায় টাকা ফেরত চান তিনি। কয়েক দফা ঘুরানোর পর টাকা ফেরত না দেওয়ায় ওই ব্যক্তি ২০২২ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) কোর্টে একটি মামলা করেন। সেই মামলায় তার বাবা ও স্ত্রীকে আসামি করা হয়। আদালতের নির্দেশে মামলাটি তদন্ত করছে তেজগাঁও গোয়েন্দা অফিস। মামলা সূত্রে জানা যায়, মামলা করার আগে রতন চন্দ্র রফিকুলের মোহাম্মদপুরের বাড়ির মালিক হারুনের মধ্যস্থতায় পাওনা টাকা ফেরত দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। এরপর তিন বছর নানা ছলচাতুরী করে আজ পর্যন্ত কোনো টাকা ফেরত দেননি। টাকা চাইলে তারিখ দিতেন। কিন্তু ওই তারিখ অনুযায়ী বাসায় গেলে উনাকে পাওয়া যেত না। মোবাইল ফোনও রিসিভ করতেন না। রতন চন্দ্র মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, প্রতারণামূলক বিভিন্ন ধরনের কূট-কৌশল অবলম্বন করে হয়রানি করতেন রফিকুল ইসলাম। গত তিন বছর ধরে কোনো টাকা পরিশোধ করেননি তিনি। বরং টাকা পরিশোধের অনুরোধ করলে অভিযোগকারীকে নানা রকম হুমকি-ধামকি দেন। সর্বশেষ মাউশিতে কর্মরত পটুয়াখালীর আরেক শিক্ষা কর্মকর্তা চন্দ্র শেখর হালদারের (বর্তমানে বহিষ্কার) মাধ্যমে টাকা আদায়ের শেষ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। রফিকুল একজন প্রতারক বলে চন্দ্র শেখর আমাদের জানায়। তার বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করলে ভুক্তভোগীদের নানাভাবে হুমকি দিতে শুরু করেন রফিকুল ইসলাম। ওই সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বললে টাকা তো দেবই না, উল্টো তোমাদের গুম করে ফেলব’— হুমকি দেন রফিকুল। ভয়ে প্রথম প্রথম অনেকে তার বিরুদ্ধে কথা বললেও পরে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন রফিকুল ইসলাম একটি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। ওই সময় থেকে তিনি নানা প্রতারণার জাল বিস্তার করেন। ৩৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দেন। এরপর সরকারের ঊর্ধ্বতন বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে— এমন ছবি দেখিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া শুরু করেন। এমন তিন ব্যক্তির সন্ধান পেয়েছেন এ প্রতিবেদক। তাদের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা নিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। বাকিরা তার খোঁজে মাউশি, মোহাম্মদপুর ও নিজ জেলা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার কুশিল গ্রামে ধরনা দিচ্ছেন । এ বিষয়ে অভিযোগকারী রতন চন্দ্রের ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ভাই ও মামলার সাক্ষী মানিক চন্দ্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গত দুই বছর ধরে আমি ও আমার ভাই রফিকুলের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারিনি। আমাদের ফোন ব্লক করে রেখেছিল। আপনি নিউজ করছেন, এটা জানার পর রফিকুল ফোন করে আমাদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। শুধু রতন চন্দ্র নয়, পরিকল্পনা কমিশনে কর্মরত এক নারী কর্মকর্তার কাছ থেকেও চাকরির কথা বলে ২০১৭ সালে তিন লাখ টাকা নেন রফিকুল। চাকরি না পেয়ে উনি টাকা ফেরত চান। তাকেও নানা ছলচাতুরীর মাধ্যমে টাকা দেওয়া হবে বলে ঘুরাতে থাকেন। ওই নারী কর্মকর্তা বাধ্য হয়ে ২০২০ সালে ২১ জুলাই আদালতে মামলা করেন। মামলা রায় চলতি মাসে হওয়ায় কথা রয়েছে। মামলা সূত্রে জানা যায়, পারিবারিকভাবে কয়েক দফা রফাদফা হলেও টাকা ফেরত দেননি রফিকুল ইসলাম। পরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের তৎকালীন পরিকল্পনা শাখার পরিচালক মো. জাহাঙ্গীরের মধ্যস্থতায় টাকা ফেরত দেওয়ার সমঝোতা হয়। কিস্তিতে টাকা ফেরত দেবেন সেজন্য তিনি শেরেবাংলা নগরের জনতা ব্যাংক শাখায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর, ২০২০ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের তিনটি চেক দেন। এর মধ্যে সমঝোতাকারী পরিচালক বদলি হয়ে গেলে রফিকুল ইউটার্ন নেন এবং ভুক্তভোগীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ওই নারী পরে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গেলে ‘পর্যাপ্ত টাকা’ নেই বলে তাকে জানানো হয়। পরে তিনি চেক ডিজঅনার মামলা দায়ের করেন।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী ওই নারী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এখনও সরকারি চাকরি করি। বিষয়টি জানাজানি হলে আমার চাকরির সমস্যা হবে। তাই আপাতত বক্তব্য দিতে চাচ্ছি না। তবে, রফিকুল ইসলামের মাধ্যমে তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে জানান।
ভোলার সংসদ সদস্যের আত্মীয় কবির আহমেদ। তার কাছ থেকে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে দুই বছর আগে তিন লাখ টাকা নেন রফিকুল। পরবর্তীতে তাকে মোবাইল ফোন বা বাসায় গিয়ে পাওয়া যাচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে রফিকুলের কর্মস্থল মাউশিতে যোগাযোগ করেন। এ বিষয়ে কবির আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার এক আত্মীয়কে একটি ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে এ টাকা নেন রফিকুল ইসলাম। এখন তাকে ফোনে, অফিসে বা বাসায় পাওয়া যাচ্ছে না। পরে জানতে পেরেছি তিনি একজন প্রতারক।
অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে রফিকুল ইসলামের ব্যক্তিগত গ্রামীণ ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। খুদে বার্তাও দেওয়া হয়। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো রেসপন্স (উত্তর) মেলেনি
ওই তিনজন ছাড়াও আরও ডজনখানেক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। মাউশির কর্মকর্তারা ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা মাউশিতে এসে তার খোঁজ নেওয়া শুরু করলে এবং টাকা ফেরত পেতে মাউশির কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলে একপর্যায়ে তিনি অফিসে আসা বন্ধ করে দেন। জানা যায়, গত ৮ জানুয়ারি থেকে রফিকুল ইসলাম অফিসে অনুপস্থিত। ইতোমধ্যে মোহাম্মদপুরের বাসাও বদল করেছেন। স্ত্রীর সঙ্গেও তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে রফিকুল ইসলামের ব্যক্তিগত গ্রামীণ ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। খুদে বার্তাও দেওয়া হয়। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো রেসপন্স (উত্তর) মেলেনি।
আপনার মতামত লিখুন :