এম শিমুল খান, ঢাকাঃ পুলিশি সেবার বাইরে গিয়ে মানবিক কাজ করতে তিনি সব সময় ভালোবাসেন। সময় পেলেই কাছে টেনে নেন সুবিধা বঞ্চিতদের। তিনি বদলে দিয়েছেন সমাজের পিছিয়ে পড়া বেদে সম্প্রদায় ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে। কাজ করছেন যৌনপল্লীর শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াতে। শুধু তাই নয়, ভালো কাজ করতে সহযোগিতার পাশাপাশি দেন দিক নির্দেশনাও। এজন্য খ্যাতি আছে মানবিক পুলিশ অফিসার হিসেবে। তার নাম হাবিবুর রহমান। বর্তমানে তিনি টুরিস্ট পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ সব দায়িত্বে থেকেও নিজেকে কর্মের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান। নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন সাধারণের সেবায়।অবহেলিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে তিনি ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন 'উত্তরণ ফাউন্ডেশন'। বর্তমানে সাভার ছাড়াও মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও সিংড়া এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
মেধাবী, সৎ ও চৌকস এই পুলিশ অফিসার ১৯৬৭ সালে গোপালগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার চন্দ্রদিঘলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৭তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে তিনি সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে যোগ দেন।কর্মক্ষেত্রে সততা, সাহসিকতা, দক্ষতা আর সময়োপযোগী ও দূরদর্শী নেতৃত্বগুণের কারণে এরই মধ্যে সুখ্যাতি পেয়েছেন তিনি। তিনবার বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) ও দুইবার রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পেয়েছেন। গোপালগঞ্জের এই কৃতি সন্তান, পুলিশ বিভাগের আইকন, লেখক, গবেষক, সম্পাদক, সমাজ সংস্কারক এ বছর পেয়েছেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক ২০২৩। পেশাগত কাজের বাইরে লেখালেখিও করেন। এ ছাড়াও তিনি একজন ক্রীড়া সংগঠকও। কাজ করছেন দেশের কাবাডি নিয়েও।
লেখালেখিতে অতিরিক্ত আইজিপি হাবিব: কর্মক্ষেত্রের বাইরে অবসর সময়ে প্রতিনিয়ত বই পড়েন পুলিশের এই কর্মকর্তা। তাছাড়া তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে নিয়ে বই সম্পাদনা করেছেন, যাতে দেখিয়েছেন দূরদর্শিতা। বইটিতে তুলে আনেন মন্ত্রীর বাল্যকাল, পড়াশোনা, মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণসহ রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার বিষয়াবলী। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় ‘নন্দিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান’ গ্রন্থটি। বইটি প্রকাশ করে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড। এছাড়া ২০১৮ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা তুলে ধরে একটি বই সম্পাদনা করেন অতিরিক্ত আইজিপি হাবিব। যার নাম দেন ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ’।
তিনি লিখেছেন বেদে সম্প্রদায়ের বিলুপ্ত প্রায় ভাষা নিয়ে 'ঠার' নামে একটি বই। দেশবরেণ্য গুণীজনের উপস্থিতিতে বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। 'ঠার' এর বেশির ভাগ শব্দই বাংলা ভাষার আদি রূপ থেকে উদ্ভূত। ভাষাটির নেই কোনো বর্ণ বা লিপি। মূলত এটি কথ্য ভাষা। ‘ঠার’ বেদেদের মাতৃভাষা। যা সাধারণ মানুষের বোধগম্যের বাইরে। যদিও ভাষাটি নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। ব্যক্তি উদ্যোগে কয়েক জন গবেষক ‘ঠার’ ভাষা নিয়ে করেছেন গবেষণা। তবে ‘ঠার’ নিয়ে লেখা হয়নি কোনো গ্রন্থ কিংবা পাণ্ডুলিপি।
অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান ‘ঠার’ বই প্রসঙ্গে আজকের বাংলাদেশ টুয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা বইটি দীর্ঘ আট বছর গবেষণার ফসল। যেহেতু 'ঠার' বা 'ঠের' ভাষাটির লিখিত কোনো রূপ নেই, সেহেতু শব্দটির কোনটি সত্য তা বলা মুশকিল। তাদের মাধ্যমে ভাষাটির শব্দ, ব্যাকরণ উদ্ধারের চেষ্টা করেছি। কখনো কখনো বেদে পল্লীতে উপস্থিত হতে না পারলে বেদেদের আমার অফিসে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তাদের সঙ্গে কথা বলে অজানা ভাষাটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ বই হিসেবে লিখিত রুপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
এ বছর বইমেলায় সাড়া ফেলেছে 'ঠার': বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থটি এবারের অমর একুশে বই মেলায় বেশ সাড়া ফেলেছে। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত বইটির পাঠক চাহিদা বেশ ভালো বলে জানিয়েছে প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানটি। তারা বলছে, ক্রেতাদের আগ্রহ বেশ ভালো। প্রতিদিনই কেউ না কেউ এসে বইটি খুঁজছেন।
পাশাপাশি পাঠকরা বলছেন, নানান জনগোষ্ঠীর নানান ভাষা রয়েছে। কিন্তু বেদে জনগোষ্ঠীর যে একটি আলাদা ভাষা রয়েছে, তা আমাদের অজানা ছিল। সেই আগ্রহ থেকেই এই ভিন্নধর্মী বইটি নেড়ে চেড়ে দেখা বা সংগ্রহ করা।
অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবের মানবিকতা: মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুরের হাট বাসুদেবপুর গ্রামে সান্দার বেদে গোত্রের প্রায় ২০০টি পরিবার স্থায়ী ভাবে বসবাস করেন। যাদের শতভাগ মুসলমান। অথচ এই জনগোষ্ঠীর কেউ মারা গেলে মুসলমান হিসেবে তাদের সৎকারটুকুও করতে পারত না। পরিবারের কোনো সদস্য মারা গেলে আশপাশের কোনো কবরস্থানে তাদেরকে কবর দিতে দেওয়া হতো না। এমন করুণ অবস্থা জানতে পরে নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি পুলিশের এই কর্মকর্তা। তিনি সহকর্মীদের সহযোগিতায় একটি জায়গা খুঁজে পান, যেটি কিনে দান করে দেন এই জনগোষ্ঠীর ২০০ পরিবারের কল্যাণে। তাছাড়া ২০২০ সালের শুরুতে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ায় বহু পুরনো যৌনপল্লীতে প্রথমবারের মতো একজন যৌনকর্মীর পুরোপুরি ইসলামি প্রথা মেনে জানাজা পড়িয়ে দাফন করা হয়। পরে চেহলামেরও আয়োজন করা হয়। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হিসেবে করে দিয়েছেন পশু খামার। তাছাড়া অনেককে গার্মেন্টসে চাকরি, পার্লার ও খাবার দোকানের ব্যবসা গড়ে দিয়েছেন অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান।
এসব উদ্যোগের নেতৃত্ব দেন মানবিক পুলিশ হিসেবে সুনাম পাওয়া অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান। এখন নতুন ভাবে দৌলতদিয়ার যৌনপল্লীর শিশুদের জন্য কাজ শুরু করেছেন তিনি। যার সুফলও মিলছে। বিশেষ করে যৌনপল্লীর শত শত শিশুকে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে তার হাতে গড়া ‘উত্তরণ ফাউন্ডেশন।
রাজারবাগে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর: অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমানের একক প্রচেষ্টায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে টেলিকম ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয় পুলিশ মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর, যা এক ঐতিহাসিক স্থাপনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দায়বদ্ধতা থেকেই তার এই উদ্যোগ। ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ এটি সর্বসাধারণের প্রবেশের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি "জাতীয় পুলিশ সপ্তাহ ২০১৭"-এর উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক পাশেই নব-নির্মিত জাদুঘর ভবনের উদ্বোধন করেন।যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, হাতব্যাগ, টুপি, চশমা, মানিব্যাগ, ইউনিফর্ম, বেল্ট, টাই, স্টিক, ডায়েরি, বই, পরিচয়পত্র, কলম, মেডেল, বাঁশি, মাফলার, জায়নামাজ, খাবারের প্লেট, পানির মগ, পানির গ্লাস, রেডিও, শার্ট, প্যান্ট, র্যাঙ্ক ব্যাজসহ টিউনিক সেট, ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, লোহার হেলমেট, হ্যান্ড মাইক, রক্তভেজা প্যান্ট-শার্ট, দেয়ালঘড়ি, এমএম রাইফেলসহ অনেক কিছু সংরক্ষণ আছে।
অধীনস্থদের প্রতি সহমর্মিতা ও নাগরিকদের পুলিশিসেবা: করোনাকালীন প্রায় প্রতিটি পুলিশ সদস্যকে অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান নিজে মুঠোফোনে কল দিয়েছেন, খোঁজখবর নিয়েছেন, মনোবল বাড়ানোর জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে নিরলস ভাবে কাজ করছেন, পাঠিয়েছেন উপহার সামগ্রী। এমনকি সশরীরে মাঠে নেমেছেন জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে। নিজ উদ্যোগ করোনায় কর্মহীন সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে করেছেন খাদ্য সহায়তা। এছাড়াও ঈদে দুস্থদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন 'ঈদ সামগ্রী'। তার স্বকীয় প্রচেষ্টায় পুলিশ সম্পর্কে সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টে দিয়েছেন। প্রশংসিত করেছেন সমকালীন পুলিশের প্রবণতা ও উদ্যমকে। বর্তমানে পুলিশের জনকল্যাণধর্মী ভূমিকার অন্যতম আইকন ডিআইজি হাবিবুর রহমান। তাই তো তিনি হয়ে উঠেছেন পুলিশের রোল মডেল। পুলিশ জনগণের প্রকৃত বন্ধু এই মূল মন্ত্রকে তার দূরদর্শী নেতৃত্বগুণে শতভাগ প্রতিপন্ন করেছেন।
নিজ উদ্যোগ পুলিশের জরুরি রক্ত সরবরাহে খুলেছেন 'ব্লাড ব্যাংক'। নিজ বাহিনীর সদস্যরাই সেখানে রক্ত দেন, পরে তা সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে রাখা হয়। পরবর্তীতে জরুরি প্রয়োজনে তা কাজে লাগান পুলিশ সদস্যরা।
সমাজ পরিবর্তনে, মানুষের কল্যাণে, মানবতার স্বার্থে পুলিশের কার্যকর ভূমিকা রাখতে অবিরাম ভাবে কাজ করে চলেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।