• ঢাকা
  • শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০৮ অপরাহ্ন

পাসপোর্ট কর্মকর্তার ‘বহুরূপী’ পাসপোর্ট : এ কেমন তেলেসমাতি 


প্রকাশের সময় : নভেম্বর ২৪, ২০২৪, ১০:০২ পূর্বাহ্ন / ১৮
পাসপোর্ট কর্মকর্তার ‘বহুরূপী’ পাসপোর্ট : এ কেমন তেলেসমাতি 

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বহুরূপ ধারণ করে ইচ্ছেমতো নিজের পাসপোর্ট বানিয়েছেন খোদ পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদফতরের এক কর্মকর্তা। একাধিক পাসপোর্টে পেশার স্থলে কখনও অন্যান্য, কখনও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী কর্মচারী, আবার কখনও সরকারি কর্মচারী অর্থাৎ যখন যা মনে আসে, তা দিয়েই পাসপোর্ট বানিয়েছেন। এমনকি ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেন্ট্রাল সার্ভারের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় থেকে ইচ্ছে মতো নিজের স্ট্যাটাস বসিয়েছেন তিনি।

আমেরিকায় অবস্থান করা স্ত্রী-সন্তানদের দেখতে যেতেই বারবার তিনি এই পাসপোর্ট পরিবর্তন করেছেন বলে জানা গেছে।

অফিসিয়ালি বিষয়টি গোপন করতেই তার এই জালিয়াতি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আলোচিত এই কর্মকর্তার নাম মাসুম হাসান। তিনি বর্তমানে উত্তরার ই-পাসপোর্ট পার্সোনালাইজেশন কমপ্লেক্স শাখায় উপ-পরিচালক হিসেবে কর্মরত।

শুধু পাসপোর্ট জালিয়াতিই নয়, এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির বহু অভিযোগও রয়েছে। ব্যাপক অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এ ধরনের ঘটনাকে পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদফতরের জন্য নজিরবিহীন বলছেন কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, তিনি যে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, এতে তার চাকরি থাকারই কথা না।

পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল নুরুল বলেন, বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি।

গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানি থানার শঙ্করপাশা গ্রামের এম এম হাসানের পুত্র মাসুম হাসান। তিনি ২০০৭ সালের ৮ জুলাই যোগ দেন পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন বিভাগের সহকারী পরিচালক হিসেবে। প্রথম পোস্টিং হয় হবিগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে। ২ বছর পর বদলি হয়ে আসেন সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অ্যান্ড ভিসা অফিসে। পরে ২০১২ সালে আবার বদলি হন যশোরে। সেখান থেকে উপ-পরিচালক পদে পদোন্নতিসহ পোস্টিং পান ময়মনসিংহ কার্যালয়ে। সেখান থেকে রংপুর, পরে আবার ময়মনসিংহ জেলা অফিস। ২০১৫ সালে চলে আসেন ঢাকা বিভাগীয় অফিসে। ২০১৮ পর্যন্ত ছিলেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট পাসপোর্ট অফিসে। ২০১৯ সালে যান ফরিদপুর আঞ্চলিক অফিসে, সেখান থেকে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মাসুম হাসান ২০১২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এনওসি’র ভিত্তিতে প্রথম অফিসিয়াল পাসপোর্ট গ্রহণ করেন, যার নম্বর ওসি৪০০৬৪৪০। পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট সরকারি চাকরির পরিবর্তে পেশা আদার্স (অন্যান্য) উল্লেখ করে এনওসি’র ভিত্তিতে সাধারণ পাসপোর্ট গ্রহণ করেন, যার নম্বর বিএল০৭১২৩১৮। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর সাধারণ পাসপোর্টের পরিবর্তে পেশা সরকারি চাকরি উল্লেখ করে আবারও জিও’র ভিত্তিতে একটি অফিসিয়াল পাসপোর্ট গ্রহণ করেন, যার নম্বর ওসি২২৬২৬১৫। এই পাসপোর্টটির মেয়াদ ছিল ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত। এ সময় তিনি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ফরিদপুরে কর্মরত ছিলেন। এই পাসপোর্ট করার সময় মাসুম হাসান নিজের আবেদন নিজেই গ্রহণ করেন এবং নিজের পাসপোর্টে নিজেই সই করেন।

এরপর তিনি আগের অফিসিয়াল পাসপোর্টের মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, ফরিদপুরের দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই অফিসিয়াল পাসপোর্টের পরিবর্তে পেশা সরকারি চাকরির পরিবর্তে পারমানেন্ট অফিসার বা স্টাফ অব অটোনমাস অরগানাইজেশন উল্লেখ করে আরেকটি সাধারণ পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। যার নম্বর বিওয়াই০৭৫৩৩৯৫।

জানা যায়, এই পাসপোর্টটি গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি যে এনওসি ব্যবহার করেছেন, সেটা ২০১৬ সালে ইস্যুকৃত। এই এনওসি যাচাই করে দেখা যায়, তিনি ওই এনওসি ইস্যুর তারিখ সংশোধন করে হাতে লিখে ২০১৬-কে ২০১৮ করেছেন যা জাল-জালিয়াতির শামিল।

এছাড়াও, তার এই আবেদনটি প্রক্রিয়াকরণে পূর্ববর্তী পাসপোর্ট লোকাল সার্ভারে ওসি২২৬২৬১৫ উল্লেখ থাকলেও সেন্ট্রাল সার্ভারে এই নম্বরটি পরিবর্তন হয়েছে। অর্থাৎ, তিনি অ্যাপ্রুভাল মডিউলের ডিসিএম থেকে আগের অফিসিয়াল পাসপোর্ট নম্বর ওসি ২২৬২৬১৫ পরিবর্তন করে তারও পূর্বের সাধারণ পাসপোর্ট নম্বর বিএল০৭১২৩১৮ ব্যবহার করেছেন, যা তথ্য বিকৃতি এবং তথ্য গোপনের শামিল।

তিনি সর্বশেষ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, চাঁদগাঁওয়ে দায়িত্বরত থেকে ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সরকারি চাকরি উল্লেখ করে এনওসি’র ভিত্তিতে নিজেই নিজের সাধারণ পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণ ও অনুমোদন করে একটি সাধারণ ই-পাসপোর্ট গ্রহণ করেন, যার নম্বর এ০৪৫৯৭৯৩৩। সরকারি কর্মচারীদের অফিসিয়াল পাসপোর্টের পরিবর্তে সাধারণ পাসপোর্ট গ্রহণের ক্ষেত্রে পূর্বানুমতি গ্রহণের নির্দেশনা থাকলেও তিনি তা অনুসরণ করেননি। বরং তিনি অসদুপায়ে একাধিক পাসপোর্ট নিয়েছেন।একজন পাসপোর্ট কর্মকর্তার এমন কীর্তি ফাঁস হওয়ায় খোদ পাসপোর্ট অধিদফতরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি যখন যেখানে পোস্টিং পেয়েছেন সেখানেই হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন সাধারন মানুষ। গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির শক্ত সিন্ডিকেট। মাসুম হাসান যখন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসে ছিলেন, তখনও সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েন পাসপোর্ট করতে আসা সাধারন মানুষ। তার প্রত্যক্ষ মদতে বিস্তার ঘটে দালাল-দৌরাত্ম্যের। চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ কার্যালয়ে পাসপোর্ট করতে আসা মানুষকে পদে পদে গুনতে হয়েছে বাড়তি টাকা। তিনি যশোরে ছিলেন দীর্ঘদিন। সেখানেও ঘুষ দুর্নীতিতে বারবার সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। রংপুর ও টাঙ্গাইল অফিসেও তার কুকীর্তি অব্যাহত ছিল।

জানা যায়, চাকরির বাইরে দৃশ্যমান কোনও আয় নেই তার। কিন্তু তিনি ২০১৪ সালে ঢাকার দক্ষিণ বনশ্রীর ব্লক-কে, রোড-১৮, বাড়ি-১৯২, ‘সিনথিয়া ভিউ‘র ৪ তলায় কিনেছেন ১৯২৩ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট। প্রায় ২ কোটি টাকায় এই ফ্ল্যাট কিনলেও মাসুম হাসান এটির দলিল মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ৪১ লাখ ২২ হাজার ৭৫০ টাকা। দেড় কোটি টাকায় ২০১২ সালে উত্তরায় কিনেছেন (দলিল নং-৬৮৫৫/১২) ৪ কাঠার প্লট (মৌজা-বাউনিয়া, সিএস এবং এসএ-২৪৫৪, আরএস দাগ নং-৬২২২)। রেজিস্ট্রি খরচসহ এটির দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আয়কর নথিতে মাসুম স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য দেখিয়েছেন ৭৭ লাখ ৮৪ হাজার ২২০ টাকা। আর চাকরি জীবনে আয় দেখিয়েছেন ১ কোটি ২১ লাখ ৯৮ হাজার ৬৩৯ টাকা।

স্ত্রী সুমি আক্তার গৃহিণী হলেও ট্যাক্স ফাইলে তার পারিবারিক আয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৫৪ লাখ ৪৮ হাজার ৬৩৯ টাকা। তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মূল্য দেখানো হয় ১ কোটি ১০ লাখ ৩৪ হাজার ২২০ টাকা, পাসপোর্ট হেড অফিসের কাছে ৬০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে মাসুমের। সেটির কোনও তথ্য নেই আয়কর নথিতে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে মাসুমের স্ত্রী-সন্তান আমেরিকায় বসবাস করছেন। আর তাদের দেখতে যেতেই নানা কৌশলে জালিয়াতি করে বারবার পাসপোর্ট পরিবর্তন করেছেন। এমনকি সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা এরই মধ্যে আমেরিকায় গিয়েছেনও কয়েকবার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাসপোর্টের কর্মকর্তারা বলেন, তার বাড়ি গোপালগঞ্জ হওয়ায় তিনি গত সরকারের সময় বেপরোয়া ছিলেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে কেউ ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

অভিযোগ সম্পর্কে মাসুম হাসানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কোন কথা বলেননি। এমনকি তার ফোনে মেসেজ পাঠালেও কোন উত্তর আসেনি।