ঢাকা : রিক্রুটিং এজেন্সি খন্দকার ওভারসিজ সৌদি আরবে ৪৫ জন কর্মী পাঠানোর অনুমতি পেয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মসংস্থান শাখার অনুমতিপত্রে বলা হয়েছে, বিদেশ যাওয়ার খরচ বা অভিবাসন ব্যয় বাবদ কর্মীদের কাছ থেকে জনপ্রতি সর্বোচ্চ ৫৩ হাজার ৫০০ টাকা নেওয়া যাবে। গত ২৮ নভেম্বর এ নিয়োগানুমতি দেওয়া হয়। বিদেশগামী কর্মীদের নিয়োগানুমতিতে বরাবরই এভাবে ব্যয় নির্ধারণ করে দেয় সরকার। কিন্ত নির্ধারিত খরচ কখনোই মানা হয় না। নির্ধারিত সীমার চেয়ে কমপক্ষে তিন গুণ বেশি ব্যয় করতে হয় কর্মীদের।
কুমিল্লার ফরহাদ হোসেন শাওন সৌদি আরব যাওয়ার ভিসা পেয়েছেন। তিনি যাচ্ছেন আল জাহান ইন্টারন্যাশনাল নামে রিক্রুটিং এজেন্সির (লাইসেন্স নম্বর-১৩৩১) মাধ্যমে। তাকে সাড়ে চার লাখ টাকা দিতে হয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেল, সৌদি আরব পাঠানোর ব্যয়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ হাজার থেকে এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা। শাওন জানালেন, তিনি জানতেন না সরকার অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করে দেয়।
শাওনের বিদেশযাত্রার আদ্যোপান্ত খুঁজতে গিয়ে তিন গুণ টাকা লাগার কারণ জানা গেল। তিনি যাচ্ছেন এক আত্মীয়ের মাধ্যমে। তাকেই তিনি টাকা দিয়েছেন। পরে ঢাকার মতিঝিলের মিরা ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি এজেন্সির অফিসে মৌখিক পরীক্ষা (ইন্টারভিউ) দিয়েছেন। কিন্ত ভিসা আসার পর দেখতে পান আল জাহান ইন্টারন্যাশনাল বিদেশ পাঠাচ্ছে। মিরা ইন্টারন্যাশনাল এন্টারপ্রাইজের লাইসেন্স নম্বর ৪০১। আল জাহানের মালিক বাকি বিল্লাহ এবং মিরা ইন্টারন্যাশনালের মালিক মতিউর রহমান। তারা নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়ের বেশি টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মতিউর রহমান দাবি করেন, শাওন নামের কেউ তাদের কাছে ইন্টারভিউ দেয়নি।
পরে খোঁজ করে জানা গেল, ভিসা কেনাবেচা এবং বিদেশগামীরা বারবার হাত বদল হওয়ায় খরচ এত বেড়েছে। জনশক্তি খাত সংশ্নিষ্টরা জানান, একজন বিদেশগামী চার-পাঁচ হাত বদল হন। প্রতি ধাপে জনশক্তি ব্যবসায়ীরা নিজের কমিশন রেখে পরের ধাপে পাঠায়।শাওনের ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে। কিন্ত বিদেশ যেতে অসুবিধা হতে পারে ভেবে শাওন বিস্তারিত বলতে রাজি হলেন না।
কেন সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের চার-পাঁচ গুণ টাকা লাগে, তা জানা গেল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মীদের কাছ থেকে। বিএনপি নেতা ও ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান খন্দকার আবু আশফাকের মালিকানাধীন খন্দকার ওভারসিজের বনানী কার্যালয়ে টেলিফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হয় সৌদি যেতে ইচ্ছুক কর্মী সেজে। সেখান থেকে জানানো হয়, তিন লাখ টাকা লাগবে। যখন তাদের বলা হয়, নিয়োগানুমতিতে তো মাত্র ৫৩ হাজার টাকা লেখা। এ কথা শুনেই টেলিফোন লাইন কেটে দেওয়া হয়।
পরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবু আশফাক দাবি করেন, সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের বেশি টাকা তারা নেন না।
গত রোববার বনানীতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ের সামনে দু'জন কর্মী ও কর্মী সংগ্রহের কাজ করা এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। বিদেশ যাত্রা বিঘ্নিত হতে পারে- এ আশঙ্কায় তারা নাম প্রকাশ করেননি। চাঁদপুর থেকে আসা এক কর্মী জানান, তার তিন লাখ টাকা লাগছে।
কর্মীদের সংগ্রহের কাজ করা এক ব্যক্তি বিস্তারিত জানালেন। তিনি বলেন, সৌদি আরব থেকে যে প্রতিষ্ঠান কর্মী নিচ্ছে, তাদের কাছ থেকে প্রতিটি ভিসা এক লাখ থেকে সোয়া লাখ টাকায় কিনতে হয়। আইনে নিষিদ্ধ হলেও রিক্রুটিং এজেন্সি ভিসা কিনেই আনে। নিয়োগানুমতি অনুযায়ী, বিমান ভাড়া নিয়োগকারীর দেওয়ার কথা থাকলেও তারা তা দেয় না। বিমান ভাড়া এখন লাখ টাকার কাছাকাছি। এরপর যারা কর্মী সংগ্রহ বা মার্কেটিংয়ের কাজ করেন গ্রামগঞ্জে, তাদের কর্মীপ্রতি ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দিতে হয়। আবার অনেক রিক্রুটিং এজেন্সির হাতে ভিসা নেই। কিন্তু ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তারা কর্মী সংগ্রহ অব্যাহত রাখে। কর্মী সংগ্রহ হলে যে রিক্রুটিংয়ের কাছে ভিসা রয়েছে, তার কাছে জনপ্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকায় 'বিক্রি' করে দেয়।
কয়েকটি নিয়োগানুমতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে। ৮ ডিসেম্বর এফ এ এইচ ওভারসিজকে এক হাজার দিরহাম বেতনে ৫০ জন কর্মী পাঠানোর অনুমতি দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, ভিসা ও ফ্লাইট নিশ্চিত হওয়া সাপেক্ষে কর্মীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ জনপ্রতি এক লাখ পাঁচ হাজার ৩৪০ টাকা করে নেওয়া যাবে। এ টাকা ব্যাংক চেক, ড্রাফট বা পে-অর্ডারের মাধ্যমে নিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই বাড়তি টাকা নেওয়া যাবে না।
গত সোমবার কথা হয় দুবাইগামী মো. ইমরান হোসেন এবং সিঙ্গাপুরগামী মো. ইলিয়াস ও রাসেল হোসেইনের সঙ্গে। তিনজনই জানালেন, নিয়োগানুমতি বলে যে কিছু আছে, তা তারা জানেন না। তাদের একজন তিন লাখ ৭০ হাজার এবং দু'জন চার লাখ ২০ হাজার করে টাকা দিয়েছেন বিদেশ যেতে। কেউ এজেন্সিকে ব্যাংকের মাধ্যমে নয়, আত্মীয় বা স্থানীয় দালালের মাধ্যমে টাকা দিয়েছেন।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ কমিটির সদস্য। তিনি বলেন, যে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়, তার পুরোটাই কাগুজে। বাস্তবে কেউ তা মানে না। আর যে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়, তা বাস্তবভিত্তিক নয়। সাফল্য দেখাতে কম ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। যদি দুই লাখ টাকা লাগে, তাহলে দুই লাখ টাকাই নির্ধারণ করা উচিত, যাতে সবাই তা মেনে চলে। ৫০-৬০ হাজার নির্ধারণ করে কর্মীর পকেট থেকে চার-পাঁচ গুণ টাকা নেওয়ার সুযোগ বন্ধ করতে হবে।
এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। শোনা কথায় ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। কোনো কর্মী সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিশ্বব্যাংক ও নোম্যাডের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশি কর্মীদের বিদেশ যেতে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয়। নেপালের একজন কর্মী গড়ে এক হাজার ৯৫৫ ডলার খরচ করে কুয়েত যেতে পারেন। সেখানে বাংলাদেশি কর্মীর খরচ হয় পাঁচ হাজার ১৫৪ ডলার (৪ লাখ ১২ হাজার টাকা)। অন্য দেশের কর্মীরা তিন মাস কাজ করে অভিবাসন ব্যয় তুলতে পারলেও বাংলাদেশিদের দুই বছর লেগে যায়।
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সাবেক মহাসচিব মনসুর আহমেদ কালাম বলেন, চাকরির তুলনায় কর্মীর সংখ্যা বেশি। এ কারণে অনেক কর্মীই বেশি টাকা দিয়ে বিদেশ যেতে রাজি। তারা দালাল ধরেন। কয়েক হাত ঘুরে এজেন্সিতে আসেন। এ কারণেই খরচ বাড়ে।
কর্মীরা কেন সরাসরি এজেন্সিতে যায় না, এর কারণ জনশক্তি খাতে ব্যাপক প্রতারণা বলে জানালেন সংশ্নিষ্টরা। এজেন্সিকে টাকা দিলে বিদেশ যাওয়া যাবে- এমন নিশ্চয়তা না থাকায় কর্মীরা আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত কারও মাধ্যমে এজেন্সির কাছে আসেন। গত সোম ও মঙ্গলবার ঢাকার দুই কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১০ বিদেশগামীর সঙ্গে কথা বলে সবার কাছ থেকেই একই উত্তর পাওয়া যায়।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) গবেষণা অনুযায়ী, মাত্র ১৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ কর্মী এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ যান। ৫২ শতাংশ দালালের মাধ্যমে এবং ২১ শতাংশ যান আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে। মোট কর্মীর ৩৪ ভাগই জমি বিক্রি করে বিদেশ যান। আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার (আইএমও) তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশি কর্মীর অভিবাসন ব্যয়ে ৬০ ভাগ দেশি-বিদেশি দালাল-মধ্যস্বত্ব ভোগীদের পকেটে যায়।
কমিশন ঠেকাতে রিক্রুটিং এজেন্সির হয়ে কর্মী সংগ্রহ করা এজেন্টদের বৈধতা ও পরিচয়পত্র দেওয়ার উদ্যোগের কথা বছর দুই ধরে বলছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, বায়রার নির্বাচন হচ্ছে না। সেখানে কমিটি নেই বছরখানেক ধরে। সে কারণে সাব-এজেন্টদের বিষয়টি এগোচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতিতেই আজ শনিবার উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দিবসটি উদযাপিত হবে।শতবর্ষে জাতির পিতা সুবর্ণে স্বাধীনতা/অভিবাসনে আনবো মর্যাদা ও নৈতিকতা' প্রতিপাদ্যে দিবসের মূল ও জাতীয় অনুষ্ঠান এদিন সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।