বিশেষ প্রতিনিধিঃ মহামারি করোনা ভাইরাস প্রায় দেড় বছর ধরে দেশে তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু করোনা সম্পূর্ণ একটি নতুন রোগ, তাই শুরুতে এর চিকিৎসক এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক এবং জনগণের মাঝে ভয়-ভীতি ছিল। ডাক্তার, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা আতঙ্কগ্রস্ত থাকলেও চিকিৎস সেবা দেওয়া থেকে পিছপা হননি। তবে বর্তমানে যেভাবে দেশে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে প্রচন্ড মানসিক চাপে রয়েছেন তারা। লাশ আর রোগী দেখতে দেখতে ক্লান্ত তারা।
জনবল ও অক্সিজেন সংকটসহ নানাবিধ কারণে রোগীরা সুচিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন। প্রতিদিন ১২ হাজারেরও বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এরমধ্যে ১২০০ রোগী প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এমনিতেই হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্য সেবা কর্মী সংকট প্রকট। তার উপর বাড়তি যোগ হয়েছে মহামারি করোনা। এক হাজার মানুষের জন্য একজন ডাক্তার থাকার কথা। কিন্তু দেশে ২৩ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র একজন ডাক্তার। ২০ কোটি মানুষের বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার আছে ৩৪ হাজার। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে মোট ডাক্তারের সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী একজন ডাক্তারের বিপরীতে তিন জন নার্স থাকার কথা। কিন্তু দেশে একজন ডাক্তারের বিপরীতে একজন নার্স আছেন। এছাড়া জনবল সংকটের কারণে দেশের স্বাস্থ্য খাত বিকলাঙ্গ হওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অনেক হাসপাতালে ডাক্তার থাকলেও টেকনিশিয়ান নেই। অপারেশন থিয়েটার থাকলেও এনেসথেসিওলজিস্ট নেই।
মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর খুব কাছের মানুষজনরা যখন চলে যায়, তখন পাশে থাকেন চিকিৎসকেরা। গত প্রায় দেড় বছরে হাসপাতালগুলোয় তারা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজেরা যেমন আক্রান্ত হয়েছেন, পরিবারকেও আক্রান্ত করেছেন। এমনকি অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। তবু দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াননি চিকিৎসকরা। অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেদের প্রাণ উত্সর্গ করেছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএর) তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালীন সময়ে চিকিত্সা সেবা দিতে গিয়ে গতকাল পর্যন্ত ১৬৯ জন ডাক্তার মারা গেছেন। এরমধ্যে ডেন্টাল ৩ জন।
এছাড়া করোনায় ৩১ জন নার্স ও প্রায় সমসংখ্যক অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবা কর্মী মারা গেছেন। আর করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৯৯৯ জন ডাক্তার, ২১০০ নার্স ও ৩৩৫৯ জন অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবা কর্মী। সর্বোচ্চ ঝুঁকি জেনেও জীবনবাজি রেখে করোনাযুদ্ধে এই ফ্রন্টফাইটাররা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মনোবল ভাঙেনি, মৃত্যু ভয়েও ভীত নন তারা। শঙ্কিত পরিবার পরিজন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্যও চাপ সৃষ্টি করছে। কিন্তু দায়িত্ববোধ, সেবাব্রত আর মানবিকতাবোধ তাদেরকে কর্মস্থলে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ভয়ংকর ছোঁয়াচে ভাইরাস জেনে-বুঝেও আক্রান্ত রোগীর গা ঘেঁষে ও মাথায় হাত দিয়ে চলছে তাদের দায়িত্ব পালন।
কোভিড হাসপাতালে কর্মরত ৫ জন চিকিৎসক বলেন, আমরাও তো মানুষ। এক পোশাকে দীর্ঘ সময় ডিউটি করতে হয়। অক্সিজেনের সংকটে রোগীরা মারা যান। জনবল সংকটের কারণে সুচিকিত্সা দিতে পারেনি। কোভিড ছাড়াও সাধারণ রোগের জন্যও হাসপাতালগুলোতে রয়েছে জনবল সংকট। চাহিদার তুলনায় ডাক্তার, নার্সসহ জনবল খুবই সীমিত। এরমধ্যে করোনা রোগীদের জন্য টানা ৮ ঘণ্টা ডিউটি করছি। প্রতিদিন ব্যাপক সংখ্যক রোগী দেখতে দেখতে মানসিক চাপ বাড়ছে। অনেক ডাক্তার টিকা নেওয়ার পরও ৪ থেকে ৫ বার করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ১০ দিন ডিউটি করে ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকছেন ডাক্তাররা। আগে থাকার জন্য হোটেলের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এখন সেই ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসকদের বাসায় আইসোলেশনে থাকতে হয়। এতে ডাক্তারদের স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা সহ পরিবারের অনেকে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। কিছু ডাক্তারের বাবা-মা কিংবা স্ত্রী সন্তানরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন। আইসিইউ বলতে যা বোঝায় সেটা ঢাকার বাইরের অনেক হাসপাতালেই নেই। তারপরও সাধ্যমতো চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার-নার্সসহ স্বাস্থ্য সেবা কর্মীরা।
আলাপকালে কয়েক জন ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মী বলেন, মৃত্যু একদিন আসবে, সবাই মারা যাব। মৃত্যু তো অবধারিত। মৃত্যুর ভয়ে আমরা পিছপা হব না। করোনার এই দুর্যোগকালে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাব। তবে ডাক্তাররা পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট দেখে নতুন ওষুধপথ্যের প্রেসক্রিপশন লিখে খালাস পেলেও রোগীর গা-ছুঁয়ে ইনজেকশন দেওয়া, ওষুধপথ্য সেবন করানোর দায়িত্ব পালন করছেন নার্সরা। নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে টেকনোলজিস্টরা করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরাও চরম ঝুঁকি নিয়েই করোনা রোগীর বিছানাপত্র, পোশাক, ব্যবহার্য্য সামগ্রী সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে করোনা রোগীর আত্মীয়স্বজনরা পর্যন্ত পালিয়ে যাচ্ছে, করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশটাও গ্রহণ করছে না কেউ। কিন্তু সেখানেও এসব পেশার মানুষ সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও মানবিকতা নিয়ে স্বজনদের মতোই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, হাসপাতালগুলোতে জনবল সংকট আছে। চাহিদা অনুযায়ী জনবল নিয়োগ দিতে হবে। জরুরি সেবার ক্ষেত্রে যে জনবল প্রয়োজন, তার পুরোটাই না দিলে সুচিকিত্সা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল জানান, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসকরা অসম্ভব মানুসিক চাপে রয়েছেন। অক্সিজেনের অভাবে অনেক রোগী মারা যাচ্ছে। জনবল সংকটের কারণে সুচিকিত্সার অভাব রয়েছে। আবার চিকিত্সকরা হাসপাতালে ডিউটি করে বাসায় গিয়ে স্ত্রী, মা-বাবা সহ পরিবারের সদস্যদের সংক্রমিত করছেন। এ
আপনার মতামত লিখুন :