বিশেষ প্রতিনিধিঃ দেশের প্রাথমিক শিক্ষাই হচ্ছে শিক্ষার মূলভিত্তি। একটি জাতি কি ভাবে গঠিত হবে তা নির্ভর করে প্রাথমিক শিক্ষার উপর। সুশিক্ষিত ও সুনাগরিক গঠনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অনেক। তাই কোমলমতি শিশুদের উপযুক্ত প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা খুবই জরুরী। কারণ আজকের শিশু আগামী দিনে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে অংশ গ্রহন করবে। তবে বর্তমান করোনা পরিস্থিতি ও শিক্ষক সংকটে প্রাথমিক শিক্ষা ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন। প্রতিবছর সরকার এ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ও নানা পরিকল্পনা গ্রহন করেও যথাযথ উন্নয়ন সাধিত না হওয়ার পিছনে শিক্ষক সংকট অন্যতম কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।শিক্ষক সংকটের বর্তমান অবস্থাঃ মানমস্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে শিক্ষক সংকট একটি অন্যতম বাঁধা ।প্রতিবছর যে পরিমান শিক্ষক অবসরে যাচ্ছেন, সে পরিমান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রাথমিকে ২০১৮ সালের মধ্যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১ঃ৩০ অর্জনের যে লক্ষ্য স্থির করা হয়েছিল তা পূরণ করা হয়নি। বরং এর বিপরীতে দেখা গেছে কোনো কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১ঃ৬০। আবার কিছু বিদ্যালয়ে একজন মাত্র শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে যেমন বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার শিবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে একজন মাত্র শিক্ষক আছেন। আবার কয়েকটি বিদ্যালয়ে একজনও শিক্ষক নেই, মসজিদের ইমাম ক্লাস নিচ্ছেন। তাছাড়া অনেক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই, অন্য যে দুই-তিন জন শিক্ষক আছেন তাদের থেকে একজন ভারপ্রাপ্ত হিসেবে প্রধান শিক্ষক এর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রশাসনিক কাজের চাপে নিয়মিত ক্লাস নিতে পারছেন না। যার ফলে অন্য শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত ফক্সি ক্লাস নিতে গিয়ে হাপিয়ে উঠছেন, আর এজন্য শিক্ষার গুনগত মান হ্রাস পাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষিকা বলেন, আমাদের একেকটা ক্লাসে মনে করেন ৫০জন ৬০জন ছাত্র ছাত্রী। এত জন শিক্ষার্থীদের ধরে ধরে বোঝানো তো সম্ভব না।
২০১৯ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৫% শিক্ষার্থীরা বাংলা রিডিং পড়তে পারে না, এর অন্যতম কারণ শিক্ষক সংকট।এক শিক্ষকেই চলছে ৭৫০ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় (১৪ মার্চ ২০২০ সালে বাংলাদেশ জার্নাল) ২০১৯ সালে ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদনে বলা হয় একে তো শিক্ষার্থীদের অনুপাতে প্রয়োজনীয় দক্ষ শিক্ষকের অভাব। তার মধ্যে যে কয়জন আছেন তারাও তাদের পুরো সময় দিতে পারেন না (প্রধান শিক্ষকের প্রশাসনিক কাজের চাপ, মাতৃকালিন ছুটি, প্রশিক্ষণ জনিত ছুটি ইত্যাদি)। এছাড়া শিক্ষক সংকটের জন্য দূর্বল শিক্ষার্থীর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়া যাচ্ছে না।
এ দেশের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া লাল ফিতার দৌরাত্বের কারণে কচ্ছপ গতিতে চলে। একটি নিদিষ্ট সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন করতে যে সময় ব্যয় হয়, সে সময়ে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষক অবসরে চলে যান, যার ফলে ১০০% শিক্ষকের পদ কখনোই পূরণ হয় না। এছাড়া প্রতিবছর সহকারি শিক্ষক নিয়োগের নিয়ম থাকলেও তা দেয়া হচ্ছে না। যেমন, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৭, ২০১৯ সালে কোন নিয়োগ পরীক্ষা হয়নি এবং ২০২০ সালে হবার কোনো আলামতও দেখা যায় না। আর প্রধান শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না প্রায় ১০ বছর যাবত। বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন অ্যানুয়াল সেক্টর পারফরম্যান্স ২০১৯ এর তথ্য মোতাবেক একজন শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত বিদ্যালয় ৭৪৯টি, ২ জন শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত বিদ্যালয় ১ হাজার ১২৪ টি, ৩ জন শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত বিদ্যালয় ৪ হাজার ৮ টি। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক ১৮ হাজার শিক্ষক যোগদান করার কথা থাকলেও বহু মেধাবী বেশি বেতনের সুযোগ পেয়ে অন্য পেশায় যোগ দিয়েছেন। নতুন শিক্ষক যোগদানের প্রক্রিয়া শেষ হবার পর গত ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রশ্নত্তোর পর্বে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন জানান, আরও ২৯ হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য আছে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে যেখানে শূন্য পদে নিয়োগের কথা সুস্পষ্ট লেখা রয়েছে, সেখানে শিক্ষকের শূন্যপদ রাখার যৌক্তিকতা বোধগম্য না। বর্তমানে করোনা পরবর্তীতে নতুন সার্কুলার দিয়ে শিক্ষক চুড়ান্ত বাচাই শেষ করতে আরও কম করে হলেও ২ বছর লেগে যাবে। তখন শূন্যপদ গিয়ে দাড়াবে প্রায় ৮০-৯০ হাজার প্রায়। তখন প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষক সংকটের জন্য ভেঙ্গে পড়বে।প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের প্যানেল পদ্ধতিতে নিয়োগের দাবীঃ সরকার “ভিশন-২০২১” এর আওতায় ২০২১ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের হার শতভাগে উন্নীত করার অঙ্গীকার করেছে। তার জন্য সরকার উপবৃত্তি, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম, বিনামূল্যে বই ও মিডডে মিলসহ নানা কর্মসুচি গ্রহন করছে। প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা অবকাঠামো খাতে খরচ করছে কিন্তু তার পরেও মানুষ সরকারী প্রাইমারি স্কুল বাদ দিয়ে কিন্ডারগার্টেনের দিকে ঝুকছে, এর অন্যতম কারণ শিক্ষক সংকট। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান বুরো (ব্যানবেইস) সর্বশেষ প্রতিবেদনে প্রাথমিক শিক্ষাচক্রে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন কারণে ঝরে পড়ছে। শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সংসদে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ১ম শ্রেণিতে ২ দশমিক ২ শতাংশ, ২য় শ্রেণিতে ২ দশমিক ৮ শতাংশ, তৃতীয় শ্রেণিতে ২ দশমিক ৯ শতাংশ, চতুর্থ শ্রেণিতে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ঝরে পড়ার হার ৩ দশমিক ৩ শতাংশ।এ ঝড়ে পড়ার জন্য শিক্ষক সংকট অন্যতম দায়ী।শিক্ষক সংকটের নিরসনের উপায়ঃ প্রাথমিকে শিক্ষক সংকট সুশিক্ষিত নাগরিক গঠনে প্রধান বাধা। তাই শিক্ষক সংকট দ্রুত কাটিয়ে উঠতে জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। বর্তমানে প্রায় ৪০ হাজারের মত শূন্যপদ রয়েছে। আর বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে মার্চ মাস থেকে ক্লাস বন্ধ রয়েছে বিদ্যালয়গুলোতে।
আপনার মতামত লিখুন :